খালিদ আহসান: বন্ধু যখন তারায় তারায়
আমি তখন সম্ভবত নবম শ্রেণির ছাত্র। তখনই আমার সাথে পরিচয় হয় তার। হবার ই কথা। সে সময় গন্ডায় গন্ডায় লেখক কবি ছিলো না। নতুন দেশে নতুন ভাবে জেগে ওঠা চট্টগ্রামের নবীন ছড়াকার আমরা। তখন ঢাকার পত্র পত্রিকায় দু হাতে লিখছি আমি। লিখছে আমার বন্ধুরাও। আধুনিক লম্বা চুলের এক ছিপছিপে নতুন বন্ধু এলো মনোভুবনে। নাম তার খালিদ আহসান। নামের মতোই প্রেমিক চেহারার কবি। ছড়া খুব বেশী না লিখলেও সব ছড়াই ছিলো অন্যধরনের। এই অন্যধরনের মানে আমরা যখন রাজনীতি সমাজ পরিপার্শ্ব নিয়ে মাতোয়ারা সে বয়সেই তার মনে প্রেম হানা দিয়েছিল। কোন তরুণীর চাইতেও সে ভালোবাসার মূল বিষয় ছিলো আত্মপ্রেম। সাথে স্বপ্ন। অনেকে জানেন না সে একটা ছদ্মনামেও পরিচিত ছিলো। সে নামটির নেপথ্যে কি ছিলো কে জানে। তবে মনে আছে তার নাম ছিলো লাইজু খালিদ। খালিদ অচিরেই তার ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল। শহিদ মিনারের পাদদেশে কিংবা মুসলিম ইনস্টিটিউটের সামনে হাতে লেখা আমাদের ছড়া বোর্ডের অনুপম কারিগর হয় উত্তম সেন নয়তো খালিদ আহসান। অঙ্গসজ্জা আর ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্যে মুগ্ধ পাঠকের দেখা মিলতো যাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব ছড়াগুলো টুকে নিতেন। আর সেভাবেই ছড়া ছড়িয়ে পড়তো চট্টগ্রামে। আমাদের সহযাত্রী চট্টগ্রাম তথা দেশের গুণী প্রচ্ছদশিল্পী কবি খালিদ আহসান সমপ্রতি প্রয়াত হয়েছে। খালিদ আমার বন্ধু। বন্ধু বলতে যা বোঝায় তার চেয়েও অধিক। কারণ এই বন্ধুত্বের ভিত্তি কোন ক্লাশমেট পাড়ার ছেলে কিংবা পরিচিত কেউ বলে না। তার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠার মূল কারণ লেখালেখি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজধানী নির্ভর ছড়াকারদের হাতে গোণা কয়েকজনকে বাদ দিলে চট্টগ্রাম সিলেট আর বরিশাল ছিলো এগিয়ে। স্বাধীন দেশে আমাদের রক্তে তখন টগবগে ছড়া। আমাদের চোখে তখন দেশ ও স্বাধীনতার নতুন স্বপ্ন বুকে হতাশা আর উদ্বেগ। সে সময় স্বাভাবিকভাবেই আমরা সরকারের সবকিছু মেনে নিতাম না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর আদর্শের প্রতি বিশ্বাস রেখেই চলতো বিরোধিতা। সে সময় কালে খালিদ ছড়া লিখেছিল:
ওখানে কে? রাজপুত্তর নয়তো লাট?
ওখানে কে? শ্রেণী শত্রুর মুন্ডু কাট…
এ কয় পংক্তিতেই বোঝা যায় তার ভেতর দানা বেঁধেছিল সাম্যবাদ। খালিদ কিন্তু কখনো রাজনীতি করে নি। বরং আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাথে ঘুরছি, ও তখন সযত্নে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দূরে থাকতো। সেই ৪৫ বছর আগে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নন্দনকাননের বাসার জানালায় হঠাৎ ভেসে আসতো ওর মুখ। কৌশলে ঘর ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়তাম আড্ডা দিতে। জুবিলী রোডের মুখে সাধুর দোকান, সেখানে একখানা নিমকি আর চা সেই ছিলো অমৃত। কবিতা শোনানো নতুন ছড়া পড়া সবমিলিয়ে একটা কথা বলতেই হবে ডিজিটালহীনতা আমাদের যন্ত্রের দাস করে নি। আমরা ছিলাম পরস্পর বা সবাই মিলে দেখা করার মানুষ। আমাদের আড্ডা জমতো চায়ের কাপে। কবি খালিদ আহসান তখন আমাদের আগেই কবিতা লেখায় মন দিয়েছে। তার পদ্য অথবা কবিতায় কেমন যেন কামঘন একটা আকুতি থাকতো সবসময়। ও লিখছে:
কাকীর পীরোত বাপের ঘর
একলা ঘরে কাকার জ্বর
রাত্রে কাকার হয় না ঘুম
পায় না কাকীর স্বর্ণচুম।
সময়ের তুলনায় সাহসী এমন পদ্যের জনক খালিদ ব্যক্তিজীবনেও ছিলো স্টাইলিস্ট। নানা কায়দায় ছবি তুলতো। মোবাইলহীন বা আজকের মতো সহজলভ্য ক্যামেরা ছিলো না হাতে হাতে। সে সময় একের পর এক সাদাকালো মনোরম ছবি তুলতো ও। এমন একটা ছবি কেমন করে যেন আমার হাতে পড়েছিল। পত্রমিতালী আর লেখালেখির বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম তখন চিঠি লেখা। কার সাথে কখন দেখা হয় আদৌ হবে কি না তার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। সে সময় সিলেটের একঝাঁক তরুণী লেখকের আবদার আর সবার মন যোগাতে ছবি যখন পাঠাতেই হবে কোন রিস্ক না নিয়েই পোস্ট করে দিলাম খালিদের ছবি। সব ঠিকঠাক চলছিলো বটে এর ভেতর হঠাৎ ও গেলো সিলেট বেড়াতে। ব্যস। ফিরে এসেতো মহা রাগ। যেখানে যায় সবাই নাকি ওকে সম্বোধন করেছে অজয় বলে। সে সমস্যাও আমরা কিন্তু মিটিয়েছিলাম মজা করেই।
বহুমাত্রিক খালিদ আহসানের আঁকার প্রতি ঝোঁক আর অনায়াসে তা করা তাকে তখনই খ্যাতিমান করে তোলে। সে কতো আগের কথা তার উৎসাহে তার অঙ্গসজ্জায় একটি গল্পের বই বের করেছিলাম আমরা। শিশুসাহিত্যিক দীপক বড়ুয়ার আনুকূল্যে প্রকাশিত এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে এক অমূল্য সম্পদ। খালিদের আঁকাউঁকি তখন জাতীয় পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে। দেশের খ্যাতিমান কবিদের কবিতার বইয়ের পাশাপাশি দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদেরও একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছে খালিদ। মুক্তধারা পুরস্কার সহ নানা স্বীকৃতিও ধরা দিয়েছিল তার হাতে।
খালিদ আহসান চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতো। কিন্তু চট্টগ্রাম না ছাড়ায় বাংলাদেশ তাকে তেমন ভাবে পায় নি। পেলে তা জীবনটাই হতো অন্যধরনের। খালিদ আমাকে সবসময় এমন কিছু মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা ভেতরে থেকেও মূলত একা। লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি অসাধারণ আগ্রহ আর শিল্পকলার ঝোঁকে উদাসীন খালিদ কোন কালে চারুকলায় পাঠ নেয় নি। তার পঠিত বিষয় ছিলো বাংলা ভাষা-সাহিত্য। কিন্তু সে কেবল নিয়ম। মূলত শিল্পী আর অন্তর্লীন এক বৈরাগী খালিদ। প্রেম করা তার প্রিয়তম বিষয় ছিলো। তার প্রেমিক রোমান্টিক মনের বহু কাহিনী আজ কেবলই স্মৃতি। ভালোবাসায় সফল খালিদ বিয়ে করেছিল আমাদের বন্ধুর ভগ্নি গুণী ডিজাইনার আইভিকে। আজ সে একা হয়ে গেলো। অনেকেই হয়তো জানেন খুব সাধারণভাবে তার লিখে দেয়া তার একটি গান বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় গান। নদী এসে পথ সোলসের এই গানটির মূল শিল্পী আমাদের বন্ধু তপন চৌধুরী -গীতিকার খালিদ আহসান যে গান লিখলেও বিখ্যাত হতেন এটা তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চারদিকে শুধু খারাপ খবর চলে যাবার তাড়া। করোনা তথা কোভিডের মরণ ছোবল এড়াতে পারে নি ও। যখন থেকে গুরুতর অসুস্থ আর নিবিড় পরিচর্যায় মন খারাপ কিছু ভাবা থেকে বিরত থাকে নি। শেষপর্যন্ত সে সন্দেহ সত্য করে দিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলো খালিদ আহসান। এক জীবনে এমন বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। খালিদ আহসান আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রথম পাড়ি দিলো তারার দেশে। শুভবোধ ও রুচির আকালে তার অভাব সবসময় মনে বাজবে। বিদায় বন্ধু। তোকে ভোলা অসম্ভব। সুদূর সিডনিতেও আমার খাঁ খাঁ বুকজুড়ে তোর অস্তিত্ব। ভালো থাকিস খালিদ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট