বিপন্ন শিক্ষা,করোনায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
করোনা চলে গেলেও আমাদের সমস্যা যাবে না। এই কষ্ট এই মৃত্যু এই বেদনার পাশাপাশি আমাদের সহ্য করতে হবে অনেক দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা। উন্নত দেশ নামে পরিচিত দেশগুলো সমস্যার সমাধানে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে তার একটা ধারাবাহিকতা আছে। তাদের দেশে আছে ধারাবাহিক গণতন্ত্র। আছে সুশাসন। আমাদের দেশে একমাত্র শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে কোথাও কোন ভরসা নাই। এই ভরসাহীনতায় কি করে সমাধান মিলবে? দ্বিতীয় স্তর তৃতীয়স্তর বলে কিছু নাই দেশে। আজকাল যেসব সমস্যা সেগুলোর সমাধান কিভাবে মিলবে কেউ জানে না। না রাজনীতিও জানে না। যে সমাজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার আবদার জানায়, একজন বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটারকে চাপাতি বা রাম দা দিয়ে কুপিয়ে মারার ভিডিও ভাইরাল করে সে সমাজে বাকী সমস্যা কি আসলেই কোন মূল্য বহন করে? না তার সাধ্য আছে সেদিকে তাকায়?
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ তার প্রাণ। সে জান আছে আজ হাতের ওপর। মানুষ মৌলিক সমস্যার বাইরে আর যেসব সমস্যা তাকে গ্রাস করছে সেদিকে তাকাবে কি ভাবে? বলছিলাম করোনার প্রভাব নিয়ে। এই করোনা আস্তে আস্তে আমাদের ভবিষ্যতকে গ্রাস করেছে। বলছিলাম বিদেশের কথা। দুনিয়ার উন্নত দেশগুলো স্কুল কলেজ খোলা রেখেছে। তারা চেষ্টা করেছে যাতে লেখাপড়া চালানো যায়। তাদের ভিশন পরিষ্কার। আগামী দিনগুলোতে তারা নতুন প্রজন্মকে বিপদে ফেলতা চায় নি। আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের দেশ জনবহুল দেশ। চাইলেই স্কুল কলেজ খোলা রাখা দায়। এদিক থেকে সরকারের সিদ্বান্তকে স্বাগত জানানো বা সঠিক বলতেই হবে। কারণ তা না হলে করোনা রোগীর সংখ্যা কতো হতো বলা মুশকিল। বিশেষত আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীরা তারুণ্য পড়তো বিপদে। তা ছাড়া অভিভাবকদের জন্য এ হতো কঠিনতম কাজ। জেনে শুনে তারা নিশ্চয়ই বাচ্চাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতেন না। কিন্তু এসব বাস্তবতার আড়ালেই বেড়ে উঠছে এক দানব। একাধিক সব আপদ।
দেখা যাক পূর্বাভাস কি বলছে: করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রচলিত পাঠদান বন্ধে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, গ্রামের বেশিরভাগই এ সুবিধার বাইরে। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে, সেখানেও উপস্থিতি ভালো নয়। এ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও হচ্ছে না। বাতিল হয়েছে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এবং এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও। একের পর এক পরীক্ষা বাতিল আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার রুটিনে ছন্দপতন, লেখাপড়ায় অমনোযোগী এবং পরিবারের আর্থিক সংকটে বাড়বে ঝরেপড়া।
ধারণা করা যায় এরপর লেখাপড়ার জন্য সব ছাত্রছাত্রী ফিরে আসবে না। ফিরে আসা সম্ভবও না। বিশ্লেষকরা বলছেন তিরিশ পার্সেন্ট ফিরে আসবে। যদি ধরে নেই ৫০ শতাংশ তাহলেও বাকী অর্ধেকের জীবন অনিশ্চিত। কোথায় যাবে তারা? কি করবে? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া কি কঠিন? আমরা আমাদের সমাজ জানি। সহজেই অনুমান করতে পারি নিম্ন মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত যারা তারা হয়ে পড়ছে বিত্তহীন। দারিদ্র রেখার নীচে চলে যাচ্ছে মানুষ। গরীবের চাইতেও গরীব আজ মধ্যবিত্ত। তাদের সাধ্য নাই যদি সরকারি সাহায্য আর আনুকূল্য পাওয়া না যায়। কিন্তু সরকারের সীমাবদ্ধতা ও মানতে হবে। টাকা থাকলেই সব হয় না। আমাদের দেশে যে টাকার ওপর সরকারের ভরসা তা আসে মূলত রেমিটেন্স থেকে। এখন পর্যন্ত উপচে পড়া রিজার্ভ ভান্ডার কিন্তু কতোদিন? সবকিছুর প্রভাব সব দেশে সব সমাজে। যেসব দেশ থেকে টাকা আসে তারাও কি নিরাপদ? সে অনিরাপত্তা ও কু প্রভাব দেখা যাবে কিছু দিন পর। সরকারের ঘাড়ে আরেক বিপদ লুটপাট।
উন্নয়ন উন্নতি আর দৃশ্যমান সবকিছু ছাপিয়ে যে লুটপাট তার একটুও কমতি নাই। বরং বেড়েছে। তাই আমাদের ভরসার জায়গা সবসময় টলটলায়মান। বিশেষ করে সামাজিক সমস্যার চাপ এখন এমন পর্যায়ে কিছুদিন আগে খবরে দেখলাম কিশোর কিশোরীদের আই ডি কার্ড দেয়ার কথা হচ্ছে। উদ্দেশ্য কি জানেন? যাতে সমস্যা করলে খুনোখুনি বা মারামারি করলে তাদের সহজে ধরা যায়। বুঝতে অসুবিধা নাই কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সমস্যার তলানী। এভাবে চলতে থাকলে আমরা যে বছর না ফুরাতেই আরো কয়েক হাজার কমবয়সী অপরাধ পাবো তা বলার দরকার পড়ে না। আর এসব অপরাধের পেছনে থাকবে অভাব অনটন কাজ হারানো অভিভাবক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা আছে? যাদের আছে তারা সমাজে কখনো অগ্রগণ্য কেউ না। তারা পেছনের সারির মানুষ। সামনের সারিতে যতো অপরাধী দাগী আর ডাকাতের দল। সে সমাজে বাচ্চা কিশোর কিশোরীদের ভবিষ্যৎ কি হবে বলা খুবই কঠিন।
চলমান মহামারীর ফলে অনেক গরিব পরিবার আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে, সে ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাতে চাইবে। এই ৩০ শতাংশ যারা ঝরে পড়তে পারে, তাদের একটা ডাটাবেস সরকারিভাবে এখনই করা দরকার। এ তালিকা শিক্ষকদের দিয়ে করতে হবে। দেশের দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে ৩০০-৪০০ টাকা বৃত্তি ও এক বেলা করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ঝরে পড়ার একটি কারণ দারিদ্র্য। এ জন্য প্রাথমিকের শিশুদের জন্য বৃত্তি, উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দুপুরে স্কুলেই এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা (স্কুল ফিডিং) করা হচ্ছে। এতে ঝরে পড়ার হার অনেকাংশেই কমে যাবে।
মন্ত্রীর কথা যৌক্তিক। কিন্তু বিশ্বাস করা কঠিন। আমাদের দেশে সব পরিকল্পনা আর নিয়ম মার খায় দুর্নীতির কাছে। তাই সবার আগে সেদিকে নজর রাখা জরুরি। করোনা গেলেও এসব সমস্যা যাবে না। সাথে আছে রোহিঙ্গাদের চাপ। এখন যোগ হয়েছে মূর্তি তথা ভাস্কর্য ভাঙ্গা মারদাঙ্গা করে জান কবজ করার উগ্রতা। এসব সামাল দিতে ব্যস্ত সরকারের অগোচরে যদি সমাজের বারোটা বেজে যায় বিশেষত শিশু কিশোর যুবশক্তি পথ হারিয়ে ফেলে এদেশ এ জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথও থাকবে না। আমরা কি সাবধান হবো?
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট