মার্কেটে আগুন, মগজে আগুন, শান্তিতে আগুন
সবাইকে মার্কেটে যেতে হয়। দেশ বিদেশে যখন যেখানে থাকি না কেন বাজারে যাওয়া জরুরি কাজের একটি । দেশে থাকতেও বাজার করা বা আধুনিক কালে যাকে বলে শপিং করা তা করতেই হতো। বাজার বলতে অবশ্য বাঙালি বোঝে মাছ মাংস তরিতরকারী কেনা। সবজী আনা এসব হচ্ছে বাজার সওদা। আর হাল আমলের শপিং মানে মলে দোকানে পোশাক প্রসাধনী সানগ্লাস নেল পলিশ থেকে জুতা কিনতে যাওয়া। এর মাঝকানে একটা ফ্যাকরা আছে। তার নাম মার্কেট। আর এই মার্কেট ব্যাপারটা অদ্ভুত। এখানে সব পাওয়া যায়। ধরেন একদিকে যেমন আলু বেগুন ফুল কপি আছে আরেকদিকে আপনি পোশাক পরিচ্ছদ বা জুতা মোজা সব পাবেন।
যখন চট্টগ্রামে বড় বড় শপিং মলগুলো ছিলো না তখন ছিল নিউ মার্কেট । এই নিঊ মার্কেটের আবার ইজ্জত ছিল বেশী। সেখানে নিউজ এজেন্সি বা খবরের কাগজের দোকান ও ছিলো না। বইয়ের দোকান ছিলো বটেল পত্রিকা বিক্রি হতো মেঝেতে বিছিয়ে। বা মার্কেটের বাইরে । কালক্রমে সে ইজ্জত মার্কেটের হারিয়ে গেলো।
মার্কেট নিয়ে এই লেখাটা কেন? আমি কোন দোকান খুলছি না বা কিনতেও যাচ্ছি না । কথাগুলো বলার কারণ গত কয়েকদিনে উত্তপ্ত রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার সংঘর্ষ । নিউমার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত নাহিদ হাসান (১৮) নামের এক তরুণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি আরেকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।নাহিদ হাসান এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগনাল এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। আজ মঙ্গলবার রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তিনি ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বলে নিশ্চিত করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. তৌফিক ইলাহী। নিহতের বাবা নাদিম হাসান জানান, ‘নাহিদ বাটা সিগনাল এলাকার একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। সকালে কামরাঙ্গীরচর দেওয়ান বাড়ির এলাকার বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নাহিদের হাসপাতালে ভর্তির সংবাদ পাই।’ জানা গেছে, শুভ নামে একজন দুপুরের দিকে আহত অবস্থায় নাহিদকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন শুভ জানান, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘষের্র সময় আহত অবস্থায় তিনি রাস্তায় পড়ে ছিলেন।
লেখাটি লেখার সময় আপাতত একজনের খবর জানলাম আমরা।একজন মানুষ ও কেন জান হারাবেন? এখন তো রমজানের সময়। সংযমের সময়। মানুষ সারা দিন সিয়াম সাধনায় ব্যস্ত থাকার কথা। উত্তেজনা বা সংঘর্ষ পরিহার করে সংযমী আচরণের জন্য বারবার বলা হয়েছে ধর্মে। আমাদের সমাজ এখন এগুলো শোনে বা জানে, কিন্তু মানে না। বলা হচ্ছে তুচ্ছ ঘটনা থেকে এর শুরু। ঘটনা আসলে কি? খবরে দেখছি : নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই ‘ওয়েলকাম’ নামে একটি ফাস্ট ফুডের দোকান। সামনেই ‘ক্যাপিটাল’ নামে আরেকটি দোকান। দুই দোকানের মালিক পরস্পরের চাচাতো ভাই। রমজান মাসে নিউমার্কেটের ভেতরে ফুটপাতের ওপরেই টেবিলে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করে এই দোকানগুলো। সোমবার সন্ধ্যায় টেবিল বসানো নিয়ে ওয়েলকাম ফাস্ট ফুডের কর্মচারী বাপ্পী ও ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। সেটিই বিরোধের শুরু। একপর্যায়ে কাওসারকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বাপ্পী চলে যান।
রাত ১১টার দিকে বাপ্পী ১০-১২ জন যুবক নিয়ে নিউমার্কেটে আসেন। এ সময় তাঁদের দু-একজনের হাতে রামদা ছিল। ক্যাপিটাল দোকানে গিয়ে কাওসারের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ানোর পর মার্কেটের আরও লোকজন একত্র হয় বাপ্পীর সমর্থকদের মারধর করে মার্কেট থেকে বের করে দেয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সে সময় মার্কেটের ৪ নম্বর গেট বন্ধ করে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাপিটাল নামের দোকানটিও। বাপ্পীর সমর্থকেরা কিছুক্ষণ পর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দলকে নিয়ে এসে মার্কেটে ভাঙচুর শুরু করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হেলমেটধারী কলেজ ছাত্ররা এসে ৪ নম্বর গেটে হামলা চালায়। রাত ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা ২ নম্বর গেট খুলে মার্কেটে ঢুকে ভাঙচুর করে বেরিয়ে যায়। মূলত এরপর থেকেই ওই এলাকার ব্যবসায়ীসহ হকাররা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
এর মানে এই না যে দোকানদারেরা খুব নিরীহ বা মারামারি করে না। শেষে যে খবরগুলো বা সংঘর্ষের নমুনা তাতে এটা স্পষ্ট তারা ও কম যায় না। ছাত্রদের এই মারমুখী মনোভাব আর দোকানদারদের ছাত্র পেটানো নিউমার্কেট এলাকায় নতুন ক্িছু না। কিন্তু এ জাতীয় সহিংসতা মূলত আমাদের সমাজের ভেতরে যে পচন আর নীরব প্রতিশোধ স্পৃহা তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
বাজারে বা মার্কেটে গিয়ে অপমানিত হয়ে আসার ব্যাপারটা কি নতুন? চট্টগ্রামের কাঁচা বাজারে দরদাম করলে বা না কিনলে যেসব অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে তা না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। নিরীহ মানুষরা দরদাম করলে সোজা বলে দেয়, কিনিত ন পারিবা, ঘরত য গ ই। এসব গা জ্বালা কথা সহ্য করতে হয়েছে আমাদের। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ ও করতাম বৈকি। ভাগ্য ভালো যে সে সময় মানুষের দিল এতো কঠিন আর মারদাঙ্গায় বিশ্বাসী ছিলো না। না হলে জানে বাঁচতাম কি না কে জানে? আমাদের দেশের নারীরা খুব ভালো জানে এইসব মার্কেটের কর্মচারীরা কতোটা বেপরোয়া আর কি বলে টিটকারি দেয়। মনে রাখতে হবে সব দোকানী বা কর্মাচারী যেমন এমন নয় তেমনি সব ছাত্র বা তরুণ ও মারমুখো নয়। ফলে এ কথা মানতেই হবে যে কোন কারণে হোক পরিবেশ তপ্ত হয়ে উঠেছিল ।
এখন কথা হচ্ছে এই অপসংস্কৃতি বা মারামারির শেষ কোথায়? কে গ্যারান্টি দেবে এই ঘটনা আবার ঘটবে না? টিভিতে যা দেখানো হয়েছে তাতে তো মনে হতেই পারে এটি ছিল কোন যুদ্ধ এলাকা বা রণভূমি? জল কামান টিয়ার গ্যাসগুলি কিছু ই বাদ যায় নি।ঐতিহবাহী ঢাকা কলেজের কি হাল সে তো তাদের প্রিন্সিপালের অসহায়ত্ব থেকেই বোঝা সম্ভব। এই কলেজের নামজাদা সব শিক্ষকের মুখ মনে পড়ছিল আমার। দেশ সংস্কৃতি মনোজগত বদলে দেয়ে এসব শিক্ষকের অনেকেই এখনো জীবিত। এই ঘটনা ও মারামারি দেখে তাঁরা আসলে কি ভাবছেন? জানতে ইচ্ছে হব কি মনে করছেন তাঁরা?
সংস্কৃতিহীনতা আর অনাচার কোনটাই ছেড়ে কথা বলে না। রাজনীতি নাই বলে কি মানুষের রিপু থেমে থাকবে? না মানুষ মন্দকাজ থেকে দূরে থাকবে? পুরা সমাজের কোথাও যখন শিষ্টাচার নাই ভদ্রতা গরহাজির যখন স্কুল শিক্ষক থেকে সুধি সবাই আতংকে সবার মনে ইজ্জত খোয়ানোর ভয় তখন মার্কেটে শান্তি আসবে কি আসমান থেকে? খেয়াল করবেন মূলত দখলদারী আর হামবড়া মনোভাব সবার ভেতর। দূর থেকে আমরা তা টের পাই। অথচ এসব দেশে সিডনিতে পুরুষ নারী আবাল বৃদ্ধ বনিতা গায়ে গা লাগিয়ে বাজার করেন। বাচ্চা তরুণ তরুণী এমন কি বয়স্কজনেরাও শপিং মলে দেদারসে জিনিস দেখছে পরছে আবার খুলে ইচ্ছে মতো রেখেও দিচ্ছে। মনে যাই থাক মুখে একগাল আসি ঝুলিয়ে দোকানের কেউ একজন এসে সেটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে থ্যাংক ইউও বলবে। অতোটা নাই মানলাম অন্তত এটুকু তো হতে পারে যে খারাপ ব্যবহার বা দুর্ব্যবহার বন্ধ হবে। আইন করে তা সম্ভব না। এটা মানার জন্য নৈতিকতা আর শ্রদ্ধাবোধ থাকাটাই জরুরী। সেটা লোপ পেয়েছে বলেই আজ এমন করুণ পরিণতি দেখতে হচ্ছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সব বিষয়ে সংযম আর ধৈর্য না ধাকলে কেউ ই ভালো থাকবে না। এখন এমন হয়ে গেছে এতো বড় ঘটনাও মানুষের বিবেকে নাড়া দেয় না। পাশ ফিরে ঘুমাতে ঘুমাতে বাড়িঘরে আগুন লাগলেও কি খবর হবে না? সবার মঙ্গল হোক নিরাপদে থাকুক মানুষ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট