দূরের দুরবিনে

প্রবাসী নারীশক্তি : জয়তু বেগম রোকেয়া

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

আমি যখন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাই তখন শুরু হয়ে গেছে বেগম রোকেয়া পাঠ। মঞ্চ ঠিক নয় দর্শকের মুখোমুখি এক ঝাঁক সিডনি তথা প্রবাসী রোকেয়াদের অনেককেই আমি চিনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় পড়ুয়ার আসরএর অন্যতন কর্ণধার বা চালিকা শক্তি যারা তাদের একজনের নামও রোকেয়া আহমদ। এই ধারাবাহিকতা অলৌকিক বলে পাশ কাটানো বা কাকতাল বলে এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু একবার ভাববেন, কানাডার যে বাঙালিরা আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদা এনে দিয়েছেন তাঁদের নামও ছিল সালাম রফিক। এর মানে কি এই, ইতিহাস তার বহনের দায় দিতে তৈরী করে কাউকে? আমি এর উত্তর জানি না কিন্তু সিডনির রোকেয়াদের দেখে আমি বুঝেছি এরা দমার কেউ নয় । বাইরের দেশে নিজেদের ভাঢ়া সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের উত্তরণ বিস্তার এবং জানার আগ্রহে এরা ধাবমান।

বেগম রোকেয়া আমাদের দেশে কতটা দরকারী বা তাঁর জীবনচরিত ও লেখা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা বুঝিয়ে বলার কারণ নাই। মুশকিল হলো আমরা অনেক কারণে মূল জায়াগায় হাত দিতে পারি না। রাজনীতি সমাজ ধর্ম সব মিলে এমন এক পরিবেশ চাইলেও সব কথা বলা যায় না। রোকেয়া ঠিক তখনই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। কারণ তিনি সে সময়কালে যা বলেছেন ভেবেছেন এবং চিন্তা করেছেন তাকে অবরোধ বাসিনীর খোলা আকাশ বললে কি ভুল বলা হবে?

আমি আগে লিখেছি আমাদের এই প্রবাসে বহুমাত্রিক সৃজন ও ভালোবাসায় আমাদের বাংলাদেশ বাঙালি মূর্ত হয়ে উঠছে। সেই কবে বেগম রোকেয়া লিখলেন আর আজ এতো বছর পর সুদূর সিডনির রোকেয়ারা তা পাঠ শ্রুতি নাটক ও আলোচনায় ফের ফিরিয়ে আনলেন। কি করেছিলেন তারা? ঢুকতেই চোখে পড়লো মাদার তেরেসার মতো সাদা শাড়ি নীল পাড়ের জননী ভগনীরা আলোকিত করে রেখেছেন দৃশ্যপট। এ কথা তো মানতে হবে নারী পারে। নারীরাই পারে। যখন আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বোনার শুরু তখন পেরেছিলেন প্রীতিলতা । পেরেছিলেন কল্পনা দত্ত যোশী। এরপর ও পেরেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। এই যে মুক্তিযুদ্ধ সে যুদ্ধে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর তার সমান সমান করিয়াছিল নারী এবং নর। সে ইতিহাসে আমাদের সংহতি বীরাঙ্গনা আমাদের জননী সাহসিকার দল। তারামন বিবি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণি বা আমাদের দেখা রমা চৌধুরী। সর্বস্ব বিলিয়েও তাঁরা ছিলেন বাংলার ঝাঁসীর রাণী। মনে রাখবো আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও পুরুষতন্ত্র যখন বশীভূত তখন সবার বুকের তলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এক নারী । নাম তার শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কীভাবে আপনি বলবেন তিনি বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী নন?

সিডনির রোববারের অপরাহ্নটি যারা আমাদের কাছে মূর্ত করেছিলেন পাঠক তাদের চেনার কথা না। কিন্তু জানতে পারলে সকলের মঙ্গল। তাদের কথা থেকেই উদ্ধৃত করছি: ‘পড়ুয়ার আসর’ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সবাই মিলে বই পড়ার কার্যক্রম শুরু করেছিল; প্রতি দুই মাসে একটি বই পড়ার আসরের আয়োজন ছাড়াও পড়ুয়ার আসর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বেগম রোকেয়া নিয়ে একটি বিশেষ পাঠসভার আয়োজন করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায়, ২০২৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর রবিবার পড়ুয়ার আসর আবারো যথাযোগ্য মর্যাদায় বেগম রোকেয়া কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে।

বিশেষ এই স্মরণসভা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল বেগম রোকেয়ার রচনাবলী থেকে পাঠ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের বর্ণনা। নাসরিন মোফাজ্জল ও রোকেয়া আহমেদের সঞ্চালনায় এই বিশেষ পাঠপর্বে অংশগ্রহণ করেন আজিজা শাদাত, নুরুন্নাহার বিউটি, রুমানা ফেরদৌস লনী, রওশন পারভীন, কাশফি আসমা আলম, রাণী নাহিদ,শামসুন্নাহার বিউটি, লায়লা লজি, সাকিনা আক্তার ও ইসরাত মুনির। সঙ্গীত পরিবেশনায় ছিলেন রুমানা ফেরদৌস লনী। এই পর্বের একটি বিশেষ পরিবেশনা ছিল কাশফি আসমা আলমের ধারা বর্ণনায় এবং নাসরিন মোফাজ্জল ও ইসরাত মুনিরের অংশগ্রহণে শ্রুতি নাটক। বেগম রোকেয়ার “সুলতানার স্বপ্ন” উপন্যাস অবলম্বনে সারা ও সুলতানার দ্বৈত সংলাপের মাধ্যমে এই শ্রুতি নাটকটি পরিবেশন করা হয়।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে ছিল সিডনীর বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক লেখক ও সুধীজনদের অংশগ্রহণে বেগম রোকেয়া কে নিয়ে পর্যালোচনার একটি বিশেষ পর্ব। এই পর্বের প্রধান বক্তা ও আলোচক ছিলেন অজয় দাশগুপ্ত, তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদান তুলে ধরেন এবং তাঁর সাহিত্য কর্মের পর্যালোচনা করেন। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সর্বজনাব শাফিন রাশেদ, গামা আবদুল কাদির, . কাজী আলী, . খাইরুল চৌধুরী, আব্দুল জলিল, আনীলা পারভিন, শাখাওয়াত নয়ন, নোমান শামীম, মোহাম্মদ শফিকুল আলম, ফারিয়া নাজিম, শো কানিজ আহমেদ, এহসান আহমেদ। এছাড়া “বিভাবরী” জামদানি শাড়ি বুটিকের স্বত্বাধিকারী সামিনা মাশা ও আভানী রিয়াল এস্টেট এর পক্ষ থেকে মুনীর সিরাজুম ও ইসরাত মুনীর তাদের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। পুরো অনুষ্ঠানের শব্দ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন মেহেদী হাসান এবং মঞ্চ সজ্জায় ছিলেন শামীম হাসান।

আমি এ ধরনের নাম ও সংবাদ পরিবেশনকে খবর মনে করি। লেখার অংশ নয়। তারপরও আমি লিখলাম এই কারণে এই অনুষ্ঠানটির সারা অঙ্গে এক টুকরো পবিত্রতা ছিল। যা কোন ভাবেই খন্ডিত করা অনুচিত। অনুষ্ঠানের বিবরণ নয় মূল কথায় বলি, যারা আমাদের বেগম রোকেয়ার বাণী ও যুগাগ্রবর্তী ধারণার সাথে আবারো পরিচয় করিয়ে দিলেন তারা নারী মুক্তির অগ্রদূত। এই প্রবাসে ও আমাদের অন্ধত্ব বা চোখের ঠুলি যায় নি। বরং বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে তার প্রকোপ দেখতে পাই। মাঝে মাঝে মুষড়ে পড়ি। বয়সের এই প্রান্তে এসে আমরা কী এমন সমাজ এমন পরিবেশ দেখতে চেয়েছিলাম? তারচেয়েও বড় কথা সভ্য দেশ সভ্য সমাজের এতো স্পর্শ এতো ভোগ এত প্রযুক্তির সাথে থেকেও কি আমাদের চোখ খুলবে না? সিডনির পড়ুয়ার আসর সে অভাব সে খেদ কিছুটা হলেও লাঘব করেছে। সেদি হলরুম থেকে বেরিয়ে দেখি বড়সড় একটি টেবিলে অনেকগুলো বই। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে এতগুলো বই আর মানুষের আগ্রহের আরেকটা কারণ বই বিনিময় বা বই বদল। দারুণ সে ধারণা। আপনি পাঠ করেছেন এখন আপনি চান আর কেউ তা পাঠ করুক এই ধারণার বিনিময়। পর্দাময় ছোট পর্দা বড় পর্দা মোবাইলের যুগে এর চাইতে ভালো বিনিময়প্রথা আর কী হতে পারে? বলাবাহুল্য আমি নিজেও নিয়ে এসেছি ঠাকুরমার ঝুলি অন্নদাশংকর রায়ের, যুক্ত বঙ্গের স্মৃতি। পড়ুয়ার আসরের সবাইকে আমি জানি না। তবে চিনি। যাদের ভালো চিনি তাদের তেজ ও সাহস আমাকে দীপ্ত করে। আমি সবিনয়ে বলি তাদের আঁচলে সান্তি অবয়বে মায়া সাহসে বেগম রোকেয়া। প্রবাসী নারীশক্তির জয় হোক। জয়তু রোকেয়া।

লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মসম্মানই ব্যক্তিত্বের প্রকৃত ভিত্তি
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল