সংযত, সংহত ও আত্মপ্রত্যয়ে বাঁধা ভবিষ্যৎ
অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কম বয়সীদের ওপর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত ঘিরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন আইনে ১০ ডিসেম্বর থেকে মেটা, টিকটক, ইউটিউবসহ সব বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিশ্চিত করতে হবে, অস্ট্রেলিয়ার ১৬ বছরের কম বয়সী কেউ তাদের প্ল্যাটফর্মে নেই। বিষয়টি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলছে– শিশুরা যেন ক্ষতিকর কনটেন্ট, অ্যালগরিদমিক ঝুঁকি ও অনলাইন শিকারিদের হাত থেকে নিরাপদ থাকে, সেই লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছে নোয়া জোন্স ও ম্যাসি নেইল্যান্ড নামে ১৫ বছর বয়সী দুই কিশোর–কিশোরী। নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজনীতিবিদ জন রাডিকের নেতৃত্বে অধিকারভিত্তিক সংগঠন ডিজিটাল ফ্রিডম প্রজেক্ট (ডিএফপি) তাদের এই আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করছে। কিশোরদের যুক্তি, এই নিষেধাজ্ঞা তাদের বাক্স্বাধীনতা ও স্বাধীন যোগাযোগের অধিকারকে খর্ব করবে।
অস্ট্রেলিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী আনিকা ওয়েলস সংসদে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার অবস্থান পরিবর্তন করবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা হুমকি, মামলা কিংবা বিগ টেকের চাপ’ কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। অস্ট্রেলিয়ার অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আমরা কঠোর অবস্থানে থাকব।’
এবার আসুন আমাদের দিকে ফিরে তাকাই:ঘটনাবহুল দেশ আমাদের। কখন যে কি ঘটে বলা মুশকিল। বহুকাল আগে স্বয়ং আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট বলেছিলেন, কী বিচিত্র এই দেশ! সে দেশ এখন আরো বিচিত্র। বদলে যাওয়া সমাজ দেখে এটা অনুমান করা কঠিন এদেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল। সে যুদ্ধ আমাদের স্বাধীন ভূখন্ড স্বতন্ত্র পতাকা আর সঙ্গীত এনে দিয়েছিল। সে পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে সে মাটিতে দাঁড়িয়ে আজকাল যারা এর অতীত স্মরণ করে না স্বীকার করে না তাদের পরিণতি কী হবে ভাবাও কঠিন ।
এই পরিবেশ আর যাই হোক মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিকূল। আমি যে বিষয়টা বলতে চাই সেটা হচ্ছে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির নিরাপত্তা। আজকাল তারুণ্যকে দেখলেই ভয় লাগে। যারা এ বয়সে মাঠে খেলার কথা, কবিতা লেখার কথা, গান গাইবার কথা, তরুণীর প্রেমে মজে জীবন গঠনের কথা তারা কী বীভৎস ভয়ংকর চেহারা নিয়ে ঘুরছে। সেটা কেমন ভয়াবহ তার প্রমাণ ভুরিভুরি। এই সেদিন একটি কিশোর বালককে দেখলাম বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।
নিরাপরাধ বলার আগে তার কৃত অপরাধ বিষয়ে বলি। তার কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ আর সে ব্যাগে ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গোটা কয়েক ব ই। আর হ্যাঁ দু একটা ইটও ছিল তার সাথে । সে ইটগুলো কিশোরের মতে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কথা লিখছি তার নেতা অবিসংবাদিত একজন মহান পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের এই মহানায়কের সমতুল্য কোন নেতা এখনো জন্মায় নি। ভবিষ্যতে যে জন্মাবে তার ও কোন নমুনা দেখি না। সে মানুষটি সারাজীবন জাতিকে উৎসর্গ করার পর ও বাঙালির মন জয় করতে পারেন নি। এটাও নতুন কিছু না। বাঙালি কোন মানুষকে মাথার ওপর রাখতে পারে না। বরং বলা উচিৎ যখন তারা কাউকে মাথায় তোলে তখন ধরে নেয়া যায় সেটা আছড়ে ফেলার জন্য।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুল ইসলাম দুজন ই এই প্রক্রিয়ার শিকার। বিশেষত এখন রবীন্দ্রনাথ আছেন ঘোর দুর্বিপাকে। লেখক অলেখক, নাম কেনা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী সবাই তাঁর বিরুদ্ধে। একজন কে দেখি কথা বলার মেশিন, এ এক টকিং মেশিন, চালু হয়ে গেলে আর থামে না। মুখস্ত কিছু পাশ্চাত্যের বুলি আর কোটেশন এই যার সম্বল তিনিও নেমেছেন রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায়। উদ্দেশ্য একটাই যেন তেন প্রকারে রবীন্দ্রনাথের বিস্তার বন্ধ করা। অবুঝ তারুণ্যের মনে ভয় আর বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেয়া। আজকাল তাঁর নাম ছোট করে র ঠা বলার যে প্রবণতা তা শুনলেই গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। এমন এক সমাজে ঐ মহান মানুষটি যার অঙ্গুলি হেলনে পাকি‘রা কাত হয়ে পড়েছিল তাঁর কোন কিছুই যে আস্ত থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সে ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হয়েছিল।
যে কথা লিখছিলাম, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা জগাখিচূড়ির চাইতেও বিপজ্জনক। কথায় বলে মিথ্যার চাইতে ভয়ংকর অর্ধসত্য। ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনা এসব মুছে দেয়ার ভেতর যে অন্ধকার তা আমাদেরকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। মধ্যযুগ কী কেমন সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। এটা মনে হতে পারে কথিত আদর্শ আর বাহ্যিক সজ্জন বা ভদ্র বলে পরিচিতদের হাতে পাওয়ার গেলে আর যাই হোক ঢালাওভাবে চুরি ডাকাতি টাকা পাচার হবে না। হয়তো হবে না। কিন্তু অর্থনীতি যদি ব্যাকফুটে চলে উন্নয়ন যদি হাতছাড়া হয়ে যায় সে নিরাপদ নীরবতা কি কবরের মতো হয়ে উঠবে না ?
বাংলাদেশের যে সব উন্নতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল সেগুলো এখন অতীত। অতীতের দু:শাসন, জবরদস্তি, টিকে থাকার জন্য বলপ্রয়োগ সব ই সত্য। যে হারে পাখির মতো মানুষ জান হারিয়েছিল তাও সত্য। সে সবের বিচার আর অবসান হতেই হবে। এ নিয়ে বলার কিছু নাই। বরং তা যত তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ নিবে তত ই মঙ্গল। তার পরিবর্তে নিজেরা যদি হানাহানি আর মারামারির পথ খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করে তখন নিশ্চিত ভাবেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
শুরুতে টিচারদের অপমান অসম্মান আর নির্যাতন করার ভিতর দিয়ে যে অরাজকতা তা কমলেও প্রবাহিত হয়ে গেছে ভিন্ন খাতে। সে খাতগুলো একটি গভীরভাবে তাকালেই চোখে পড়বে। বনিবনা না হলে বা পছন্দ না হলেই ট্যাগ দেয়া তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ভেতর যে বন্য আদিম হিংস্রতা দেশ কি সেদিকেই ধাবিত হবে বারবার? আমাদের ধারণা ছিল উচ্চপদমর্যাদার মানুষের মন হয় আকাশের মতো বিশাল। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিখ্যাত বাঙালি হয় আকাশের মতো উদার। কিন্তু তা হলো না ।
এখন সময় তারুণ্যকে সুপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসার। বিশেষত তাদের ঘর মুখি করতেই হবে। পড়ার টেবিলে গানে কবিতায় প্রেমে ফিরাতে না পারলে এ জাতির হাল ধরবে কে? দু দিন পর পর রাস্তায় মাতম আর বন্য আদিমতার নাম বিপ্লব হতে পারে না। সুসংহত আর সংযত জাতিসত্তা ব্যতীত আমরা কিছুতেই মাথা তুলতে পারবো না।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট।










