বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য আর অনিবার্য অংশের নাম চট্টগ্রাম। কিন্তু ভেতরে থেকেও আলাদা। আলাদা নানা কারণে । ভাষা মানুষের মৌখিক ভাব প্রকাশের বড় বাহন। চট্টগ্রামের মানুষেরা নিজের ভাষায় কথা বললে বাকীরা মূক ও মৌন দর্শক। উপায় নাই। যারা বলেন এই ভাষা কঠিন বা দুর্বোধ্য তাদের কেউই হয়তো আরবী ফার্সী বা ফ্রেন্চ বোঝেন না। তাই বলে কি ঐ ভাষাগুলো আসলেই দুর্বোধ্য। আমরা যারা চট্টগ্রামে জন্মেছি যাদের বাড়িঘর চট্টগ্রামে এই ভাষায় কথা না বলা পর্যন্ত গলার কাছে যে অসুবিধা কাঁটার মতো আটকে থাকে তাকে সরানো যায় না ।
বলছি গত ৯ তারিখ রোববার সিডনির ফেয়ার ফিল্ড শো গ্রাউন্ডে আয়োজিত চট্টগ্রাম উৎসবের কথা। ধারণাতীত জনসমাগম আর ভালোবাসায় উপচে পড়া এই আয়োজন ছিল দেখার মতো। আমি জানতাম সভাপতি শাহ আলম সৈয়দ কাজের মানুষ। বহুকাল থেকে তাঁকে চিনি। আর সাধারণ সম্পাদক ইফতু? ইফতেখার উদ্দীন ইফতু আমার যৌবনে দেখা তুর্কি তরুণ। যারা চট্টগ্রামের মানুষ তারা সিটি কলেজ যে কী খুব ভালো জানেন। যারা জানেন না তাদের বলি, এই তরুণ সেই ঝড়ের মিছিলে নির্বাচিত নেতা। তার সাংগঠনিক শক্তির আরো একবার প্রমাণ মিললো রোববারের এই উৎসবে ।
মেজবান বা মেজ্জান আসলে কি? দেশের আর কোন এলাকার মানুষ এমন বিচিত্র খাদ্যভূক নয়। শুটকি মাছের কত রকমের পদ হতে পারে তা অন্যরা কল্পনাও করতে পারবেন না । এই খাদ্যের এক মহা উৎসবের নাম মেজবান। কী এই মেজবান? এ নিয়ে যা জানা যায় তা হলো:
“ঐতিহ্যবাহী মেজবান সম্পর্কে জানা যায়, ১৮ দশকের দিকে চট্টগ্রামে মেজবানের প্রচলন শুরু হয়। অতীতে চট্টগ্রামের ধনী লোকেরা বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে গরিব লোকদের উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করতেন। সেই থেকে মেজবানের প্রচলন চলে আসছে। মেজবান শব্দটি একটি ফারসি শব্দ। এই মেজবানকে মেজ্জানি বলা হয়ে থাকে। সাধারণত কারো মৃত্যুবার্ষিকী, কুলখানি, চল্লিশা, ওরশ শরিফ, মিলাদ মাহফিল, নতুন বাচ্চার আকিকা, গায়ে হলুদ, নতুন ঘরে ওঠা অথবা নতুন ব্যবসায়–বাণিজ্য শুরু করার আগে মেজবানের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানে যেসব খাবারদাবার পরিবেশন করা হয়, সেগুলো অসাধারণ সুস্বাদু হয়ে থাকে। এই মজাদার খাবারের প্রতি সবার বেশ আকর্ষণ থাকে। মেজবানের খাবারের সঙ্গে অন্যান্য খাবারের তুলনা চলে না। মেজবানে সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে, রান্না করা গরুর মাংস, চনার ডাল, গরুর নলা, মাষকলাই ডাল, গরুর কালোভুনা তৈরি করা হয়ে থাকে।
মনে করতে হবে শুধু মুসলমান সমপ্রদায় না হিন্দু বৌদ্ধ বা অন্য সমপ্রদায়ের মানুষের জন্য ও মেজবান অবারিত।
সিডনির এই মেজবানে এসেছিলেন দেশ সেরা পৃথিবীখ্যাত বাবুর্চি আবুল বাবুর্চি। আমাদের এই সিডনি শহরে দেশ থেকে যারা আসেন তারা সাধারণত: সাহেবি পোশাকেই আসা যাওয়া করেন। নেহাৎ না হলেও দামী সার্ট প্যান্টতো থাকবেই। অথচ কাল বিকেলে সিডনির ফেয়ারফিল্ডের মঞ্চে আবুল বাবুর্চি উঠলেন লুঙ্গি পরিধান করে। একেবারে খাঁটি চাটগাঁইয়া স্টাইলে। বহুজাতিক দেশ অস্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গ মান্যবরেরা তাঁর হাতে সম্মাননা পদক দিতে গিয়ে অবাক হলেও খুশী হয়েছেন ব্যাপক। আমার মনে হয়েছে এই হচ্ছে স্বীকৃতি। পেশা কি কোন পেশা সেটা বড় না বড় হচ্ছে আপনি সে পেশায় কতটা সার্থক। কতটা উজ্জ্বল। আবুল বাবুর্চী রন্ধনশিল্পী। তাঁর সুনাম দেশ পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ায় চট্টগ্রামও আজ তাকে নিয়ে গর্বিত।
এই উৎসবের শুরুতে অর্থাৎ ঢোকার পথে আমাদের প্রিয় শহরের সুবিখ্যাত চেরাগি পাহাড়ের ছবি এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার বিশেষ আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই চেরাগি পাহাড় নানা কারণে বিখ্যাত। এর পাদদেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হয়। আমার জন্য এ এক তীর্থ। এর সাথেই লাগোয়া আমাদের প্রাণায়াম কেন্দ্র। আরেক পাশে সুবিখ্যাত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রিত দৈনিক আজাদী অফিস। আপনি চেরাগি পাহাড় মানেই জানবেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো। ইতিহাস বলে এই চেরাগি পাহাড়ে আলো জ্বেলে জীন ভূতদের বশ করেছিলেন আউলিয়ারা। সে থেকে এ আমাদের আলোর উৎস। সেই ছবিটির সামনে কাল ফটো তোলার ধুম লেগে গিয়েছিল।
আমাদের অঙ্গরাজ্যের প্রিমিয়ার ক্রিশ মিনস সশরীরে হাজির না হলেও ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ক্যাম্বলে টাউনের মেয়র ডার্সি লাউন্ড ডেপুটি মেয়র খলিল ভাই ছিলেন উপস্থিত তারকা। আমাদের বাঙালিকমিশনারেরা সহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের সয়লাব ছিল এই শো গ্রাউন্ড। নামে চট্টগ্রাম উৎসব হলেও এর মূল শিকড় ছিল দেশের গভীরে। আমি বিস্মিত হয়েছি এই কারণে উদ্যোক্তারা আমাদের পুত্র অভিনেতা নির্দেশক অর্ক দাশকেও সম্মান জানিয়েছে। দিয়েছে Hall of Honour Award. চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নেয়া অর্কের এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।
আমার বন্ধু সহপাঠী গায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন সবসময় সপ্রতিভ। কাল তাকে দেখেই বুঝেছি সে নেপথ্যে প্রচুর পরিশ্রম করছে। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আন্তরিকতায় এই উৎসবে গান গাইতে এসেছিল আমাদের আরেক বন্ধুপ্রতিম সহপাঠী দেশ বিদেশে একনামে পরিচিত কন্ঠ শিল্পী রেঁনেসা খ্যাত নকীব খান। উপস্থাপিকা জুই সেন পল আমাকে যখন মঞে ডেকে নকীব কে আমন্ত্রণ জানাতে বললেন আমি যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছিলাম। বহুকাল পরে আমি মামুন আর কিংবদন্তী তুল্য শিল্পী নকীব খান যখনএক সাথে দাঁড়িয়ে তখন মনে হচ্ছিল জীবন গোধূলি বেলায় এসেও কত সুন্দর আর মনোরম হতে পারে। সন্ধ্যা অবধি তার বিখ্যাত গানগুলোর পাশাপাশি নকীব সোলসের সোনালী দিনের গানগুলো গেয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল মন শুধু মন ছুঁয়েছে রূপালী সৈকতে।
আর সৈকত মানেই চট্টগ্রাম পাহাড় মানেই চাটগাঁ। ইতিহাস বলে সমুদ্র আর পাহাড় যেখানে একসাথে সেখানকার মানুষ হয় পর্বতের মতো দৃঢ় আর সাগরের মতো উদার। সিডনির চট্টগ্রাম উৎসব ছিল তার জীবন্ত চলমান এক উদাহরণ। জানা অজানা চেনা অচেনা যাদের যোগে এটি সার্থক হয়েছে তাদের সবাইকে ভালোবাসা।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক।











