দূরের দুরবিনে

আসন্ন শারদ উৎসব, যুক্ত হোক প্রাণে প্রাণ

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথের ঋতু বন্দনা আমরা জানি। বসন্ত হেমন্ত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতু নিয়েই কবিতা আর গান আছে তাঁর। অথচ এই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে। তার মানে কী অন্য ঋতুতে তাঁর রাত পোহায় নি? আসলে এই একটি ঋতুই আমাদের কাব্য কলা শিল্পে সমাদৃত বেশি। তাই কবি লিখেছেন, ‘ভালোই হয়েছে শরত এসেছে মেঘের সিংহ বাহনে’।

এই শরতকালের আনন্দ পূর্ণ করে শারদ উৎসব। যা বাঙালি হিন্দুর জন্য দুর্গাপূজা। শারদীয় দুর্গা পূজার লেখা মানে কি শুধু ই দেবীকে নিয়ে লেখা? তার বাইরেও পা ফেলার দরকার আছে। কারণ দুর্গা যে শক্তি আর সাহসের উৎস তার সাথে যোগসূত্র না থাকলে বাঙালির উত্তরণ হবে না। উত্তরণ কোথা থেকে ? কেন তার প্রয়োজন এই উত্তরণ ?

আমি যেটা বলতে চাই অধিক হারে কমে যাওয়া একটি জনসংখ্যার জীবনে পূজার আনন্দ আসলে কতটা? সংখ্যাধিক্য যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে তাও কিন্তু নয় । তবে কথা হচ্ছে সংখ্যাগুরু যদি কোন দেশে সংখ্যালঘুকে পায়ে দলে আনন্দ পায় তাদের জীবন ও সম্মান সব সময় ভয়ের কাছে জিম্মি থাকে তাহলে সে দেশে আনন্দ সর্বজনীন হয় কি ভাবে ? এরপর ও আমরা দেখি পূজা আসলেই আনন্দ আর পূজার ঢল নামে। আনন্দটা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়তো তাই এটা চলমান। কিন্তু এতো এতো পূজা কি প্রমাণ করে?

প্রধান উপদেষ্টা ড: ইউনূস জাতিসংঘের অধিবেশনে যাবার আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলেন। ভালো লেগেছে যখন তিনি বললেন, দেশে থাকা হবে না বলেই তিনি আগে ভাগে এসেছেন তাঁর সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে। এই প্রথম কেউ খুব সাধারণ ভাষায় নমস্কার জানিয়ে ভাষণ দিলেন। তাঁর এই শুভ চিন্তার সাথে সরকার বা প্রশাসনের যোগ ঘটলেই কাজ হবে। আমাদের কোন খারাপ বা বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে না। এই স্বাভাবিক ও সাধারণ বিষয়টা আমরা ভুলে যাই। সংবিধান স্বীকৃত সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার পালন করা না গেলে কি হয় তা আমরা আগেও দেখেছি।

খুব বেশিদিনের কথা নয় দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর আমলে কুমিল্লার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে পূজা বিঘ্নিত হয়েছিল। আক্রমণের শিকার হয়েছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। নারীর কান্না শিশুর আর্তনাদ আর বয়স্কদের ভয়ার্ত মুখ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই দেশ যেন আমাদের নয়। অথচ সেটা ছিল কথিত সেকুল্যার আমল। কথিত বললাম এই কারণে সে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার কিছুই দেখি নি আমরা। এরপর জাতীয় টিভির এক টক শোতে আমার সাথে অতিথি ছিলেন স্বনামধন্য বর্ষীয়ান অধ্যাপক প্রাক্তন ভিসি সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। এই ভদ্রলোক মিতভাষী। যুক্তি দিয়ে কথা বললেও সে রাতে তিনি ঘটমান বাস্তবতার কথা মানতে চান নি। এই যে চোখ বুজে অস্বীকার এর ফলাফল হাতে হাতে পেয়েছে স্বদেশ। মজার বিষয় হচ্ছে কুমিল্লার এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা তখনকার সরকারি দলের যে নেতা তাকেও পালাতে হয়েছে। এবং পালিয়ে কোথায় আছেন তিনি? সেখানেই জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচা এসব নেতারা কোনদিন ই বাস্তবতা মানে নি। মানলে আজকে দেশের এই হাল দেখতে হতো না।

আমরা যারা প্রবাসী বিদেশে আছি আমাদের জীবন এখানে নিরাপদ। আমাদের জীবন ও সম্মান হারানোর ভয় কম। কিন্তু আমরা যে দেশে জন্মেছি যে দেশে বড় হয়েছি সে দেশে আমাদের স্বজনরা না নিরাপদ না আতংকমুক্ত। এই আতংকমুক্তির উপায় কি আমাদের অজানা?

দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে বিদেশে যে উৎসব বা আয়োজন তার ভেতর সংহতির বিষয়টা এখনো অনুপস্থিত। দেশে নির্যাতিত হিন্দু বা মুসলমান কিংবা যে কোন গোষ্ঠীর জন্য দাঁড়াতে হবে আমাদের। গণতান্ত্রিক উন্নত দেশগুলোর সমস্যা হচ্ছে তারা আন্তর্জাতিকতার নামে এমন সব বিষয় অনুমোদন করে যা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমা দেশ নামে পরিচিত অনেক দেশ এখন এর মাশুল দিচ্ছে। তারপর ও তাদের চোখ খোলে না ।

শারদ উৎসব শুধু পূজায় সীমাবদ্ধ কিছু না। এর সাথে সাহিত্য সংস্কৃতি বিনোদনের যোগ নিবিড়। বাংলাদেশ বা পাশের বঙ্গে পূজার বাজার অর্থনীতি তে রাখে ব্যাপক অবদান। সেই কবে থেকে পূজা সংখ্যা মানেই হচহচে বাঙালির ঘরে ঘরে লেখক শিল্পীদের জয় জয়াকার। এক সময় পূজার গান ছিল আমাদের আনন্দের উপকরণ। আমাদের দেশেও তার প্রভাব আছে। আছে নিজস্ব ভঙ্গিতে গড়ে ওঠা গান কবিতা অন্যকিছু। বাংলাদেশ বারবার প্রমাণ করেছে তার জীবনে অন্ধত্বের জায়গা নাই। যুগ যুগ ধরে মানুষ এখানে যার যার বিশ্বাস ও প্রথা মেনে জীবন যাপন করছে। তার ব্যতিক্রম হলেই নিয়তি আমাদের ছেড়ে কথা বলে না। আজ যে সব উৎপাত বা ঝামেলা তা সাময়িক। ইতিহাস আর ঐতিহ্য তাই বলে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাদের মূল শক্তিই হচ্ছে বিশ্বাস পারস্পরিক সম্মান আর সহাবস্থান। এখানে রাজনীতি মূখ্য হতে পারে না। তার জায়গায় সে থাকুক। আমাদের দরকার সমাজ সম্মিলন যা শারদীয়ার মাধ্যমে পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। দেশ সবার। সমাজ সবার। আনন্দ ও সবার। পূজায় আমাদের সংকল্প হোক মাতৃভূমির পবিত্রতা ও সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। শুরুতে যে পরিসংখ্যান দিয়েছি তা ভয়াবহ।

শান্তি কামনা করা আর শান্তি স্থাপন করা দুটো ভিন্ন বিষয়। শান্তি কামনা করলেও শান্তি আসবে না যদি মানুষ নিজে নিজেকে বাঁচাতে না পারে। এই আত্মত্রাণের উপায় সংঘবদ্ধ হওয়া। তারপর নিজেরা নিজেদের এবং অপরের কল্যাণে কাজ করা। মনে রাখতে হবে ভগবান রামচন্দ্রকেও দেবী দুর্গার শরণ নিতে হয়েছিল। তাঁর করুণা আর কৃপাতেই সম্ভব হয়েছিল রাবন বধ। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে? উগ্রতা সন্ত্রাস ও হানাহানির বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ এখন জরুরি।

আসন্ন শারদীয় উৎসবের এই লেখাটি ভক্তিরসের বিপরীতে শক্তিরসে জাগ্রত করুক সবাইকে। দেবী মাতা দুর্গার আর্শীবাদে দুর্গতি কাটুক।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধন্যাটোর আদলে আরব সামরিক জোট! বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি নেতা শামসুল আলমের ইন্তেকাল