দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ১১ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

দেশে নারী জাগরণ অভূতপূর্ব। এটা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। বীরকন্যা প্রীতিলতা বেগম রোকেয়া থেকে জাহানারা ইমামে এর উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে নারীর অধীনে। এরশাদ পতনের পর সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান হলে বেগম খালেদা জিয়া দেশ শাসনে আসেন। এরপর শেখ হাসিনা। ভালোমন্দ মিলিয়ে এরা দু জন দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করে গেছেন। শেখ হাসিনাকে এক সময় অপরিহার্য এবং অপরিবর্তনীয় মনে হলেও তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। যা পলায়ন বলেও চিহ্নিত করা চলে।

এরপর থেকে নারীর অবস্থান নাজুক। কথাটা আমার নয়। এখন যে সব তরুণী ও উঠতি বিপ্লবীরা কথা বলেন তারা সবাই একমত যে দেশে নারীদের অবস্থা সুবিধার না। এমনকি এটাও বলা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ভাবে নারীদের বাদ দেয়াও একপাশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তারা পদ পদবীও নিজেদের অবস্থান হারাচ্ছেন।

কথা মিথ্যা নয়। বিশেষ করে শহরের বাইরে নারীদের অবস্থা করুণ। গত কিছুদিন কয়েক মাস থেকে দেশব্যাপী শুধু মারামারি আর হানাহানি। এই হানাহানি অনেকটা গরম মেজাজও সুবিধা নেয়ার মারামারি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে কোথাও কোন প্রতিরোধ নাই।

নারীর প্রতি এত রাগ এত বিদ্বেষ সমাজে আগে দেখা যায় নি। এখানে যে সব কারণ জড়িত তার ভেতর ধর্মের নামে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও কম নয়। এরা যে কোনভাবে নারীকে দুশমন এবং ত্যাজ্য বানাতে বদ্ধপরিকর। এর ভেতর যে ষড়যন্ত্র বা উসকানি তার নাম রাজনীতি। রাজনীতি না হলে কথায় কথায় আফগানিস্তানের নাম আসবে কেন?

রাজা বাদশা সম্রাট দাউদ শাহ জহির শাহর কাবুল চলে গেছিল কমিউনিস্টদের হাতে। আমাদের যৌবনে বারবাক কারমাল, নূর মোহাম্মদ তারাকি ছিলেন এশিয়ার আদর্শ। অথচ কাউন্টার রিভিলিউশনের নামে তাদের সরানো হলো। দিবালোকে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে অন্যরা দমে যায়। সাহস হারিয়ে ফেলেন। তাই হয়েছিল আফগানিস্তানে। এরপর তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি। সবচেয়ে বিপাকে আছেন নারীরা। সে দেশে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। বাজার হাটে একা যেতে পারে না। ইদানীং তাদের পার্কে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এই তালেবান কিন্তু আমেরিকার কোলে জন্ম নেয়া এক শক্তি। যারা এখন পুরো দেশ কব্জা করে রেখেছে। লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে আমেরিকা। আমেরিকা যাবার আগে তাদের স্বভাবমত সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। এখন সে দেশে নারী কেবলই অসহায় গোষ্ঠী।

এই অসহায়ত্ব রপ্তানি বা আমদানি কোনভাবেই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। অথচ এই ধারণার জোর প্রচার চলছে দেশে। পাকিস্তানের কথা বলাও দরকার। এদের নারীদের একাংশ আপার ক্লাশের। এরা তালেবানি শাসন মানবে না। আমার অভিজ্ঞতা বলে পাক এলিট নারীরা বাংলাদেশের নারীদের চাইতে অনেক অগ্রসর। তারা পারিবারিক ঘরোয়া আড্ডায় পুরুষের সাথে বসে আড্ডা দেয়। গল্প করে খাবার খায়। অথচ বাংলাদেশের এলিট নারীরা পানাহার করলেও মূলত অবরোধ বাসিনী। এজন্য আমাদের অন্ধরা রাজনীতিতে পাকি প্রেমী হলেও আখেরে চায় আফগানী বাস্তবতা। দেশে যতদিন নারীর শাসন ছিল ততদিন এরা ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় ছিল। এখন এরা যা করছে তাতেই এটা স্পষ্ট।।

নারীদের আসন নিয়ে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার বৈঠকে কোন নারীকে রাখা হয় নি। তারা মনে করেন নারীর দরকার নাই। পুরুষ শাসিত সমাজও দেশে পুরুষই ঠিক করবে নারীরা কি করবে। নারীর এতো কথা বলার কী দরকার।

তারা টিপ পরবে না। চুড়ি পরবে না। কালে কালে শাড়ি ও পরবে না। এই অপপ্রক্রিয়া কতটা ভয়ানক তার প্রমাণ এখনকার সমাজ। যে সমাজে নারীদের কেউ কেউ নারীর বাইরে যাওয়া বা সহজ জীবন মানে না। তারা এও বলে নারীর কাজ ঘরে থাকা সন্তান জন্ম দেয়া। চাকরী তার জন্য নয়।

এই যে বলছিলাম নারী জাগরণের দেশ বাংলাদেশ এটা এরা বোঝে কিন্তু মানে না। অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালেই জানতো কী শক্তি রাখে নারীরা। হঠাৎ করে নারী জাগরণ নারী অংশগ্রহণ বন্ধ করা যায় না। এটা নারীর চাওয়া। এসব তার অধিকার। জুলাই বিপ্লব বলা মানুষেরা নারীর সাহায্য নিয়ে গদীতে চড়ে এখন বেমালুম তা ভুলে গেছে। তা বলে কি সময় চুপ থাকবে?

নারীদের ও মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আজকাল তাদের মুখে এমন সব ভাষা ও স্লোগান শুনি যা কখনো চিন্তাও করা যায় নি। অনেকে বলবেন আমি পুরুষবাদী। না মোটেও তা নয় । সব সমাজ ও সভ্যতার একটা নিয়ম থাকে। জনপদ প্রকৃতি আর আবহ মিলে যে পরিপার্শ্ব তৈরী হয় তার নাম ই নিয়ম। সে নিয়ম অনুযায়ী আমাদের নারীর ঘরমুখি এবং শালীন। শালীন বলতে সমাজের বাদ প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে সমান অংশ নিয়েও তারা হয় অন্তর্জগতচারী। তাই তাদের প্রিয়ংবদা বলা হতো এককালে। অর্থাৎ যে বা যারা প্রিয় বাক্য বলে। পুরুষ যত নরম আর প্রিয় কথা বলুক তা নারীর মতো হয় না। সে কারণেই আমাদের সমাজে নারী হচ্ছে মিষ্টি কথাও শালীনতার প্রতীক। সে নারীদের মুখ ছুটে গেছে এখন। তাদের এমন সব ভাষা যা শুনলে কান গরম হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য জুলাই মাসে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তারা এসব শুনলে লজ্জায় মাথা নোয়াতেন। নারীদের একাংশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে কি বোঝে সেটাই বুঝতে পারি না। তারা যদি মনে করে থাকে এই স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে বলা বা আজে বাজে অশ্লীল কথা বলার অধিকার তা হলে বলার কিছু নাই। নারীদের অন্তর্জগতে যে পরিবর্তন ই ঘটুক না কেন বাহ্যিক সরলতা নষ্ট হলে সমাজে অশুভ ছায়া পড়বেই। এবং তা এখন স্পষ্ট।

বলছিলাম শালীনতা আর সভ্যতার ভেতরে থাকা বাঙালি নারীরাই আমাদের জয় এনে দিয়েছে বারবার। সেটা প্রীতিলতা বেগম রোকেয়া থেকে সুফিয়া কামাল বা জাহানারা ইমাম সর্বত্র দেখা যায়। আজ হঠাৎ করে বিপ্লবী বনে যাবার কালে আমরা নারীদের একাংশে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ আর সমাজের বিরুদ্ধাচারণ দেখছি। এদের বাদ দিলে বাকী যারা তারাই মূল শক্তি। আবারো বলি, নারীদের অংশগ্রহণ আর সামর্থন বা ভূমিকা ছাড়া বাংলাদেশের গৌরব অকার্যকর। অতিসমপ্রতি আমাদের নারী ফুটবলাররা ই এর বড় উদাহরণ। জীবনের সবর্ত্র তারাই আমাদের এগিয়ে রাখে। এই নারী শক্তিকে মৌলবাদ আর অন্ধশক্তি ব্যতীত আর কেউ ই ভয় পায় না। বাদবাকী সবাই ভালোবাসায় রাখুন তাদের। তাদের জয়ই আমাদের দেশের জয়।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যক্ষ রওশন আখতার হানিফ : অনন্য যিনি
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল