দূরের দুরবিনে

যেন ভুলে না যাই শয়নে স্বপনে

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ২ জুন, ২০২৫ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

মব, কিশোর গ্যাং, তৌহিদী জনতা এসব নতুন নামের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের অতীত ও বর্তমান। বলাবাহুল্য ভবিষ্যৎও ছেড়ে কথা বলবে না। সে কারণে আমি আজ এমন তিনজন বাঙালিকে স্মরণ করছি যাঁদের আলোয় আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতি পথ খুঁজে পেয়েছিল । যাঁদের কথা ও কীর্তি আমাদের বহুকাল বাঙালি করে রাখতে পারে।

তখনকার আই সি এস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি। অসামান্য কৃতিত্ব শিক্ষা জীবনে। বিয়ে করলেন অ্যালিস ভার্জিনিয়া আনফোর্ড নামের এক আমেরিকান লেডি। কিন্তু এই ছিপছিপে মানুষটির এমনই প্রভাব তাঁর সান্নিধ্যে লেডি হয়ে গেলেন লীলা রায়। বাংলা শিখে বাংলা বলে স্বনামধন্য বাঙালি লেখিকা। কর্মসূত্রে আমাদের চট্টগ্রামেও ছিলেন তিনি। আমার মতে সুকুমার রায়ের পর ইনি সেরা ছড়াকার। সে যদি নাই হবে এত হাজার হাজার ছড়াকার কবি লিখলেন কিন্তু অমর হয়ে গেলো তাঁর দুটো লেখা।

সাতচল্লিশের পর লিখেছিলেন,

তেলের শিশি ভাঙলো বলে

খুকুর ওপর রাগ করো

তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা

ভারত ভেঙে ভাগ করো

তার বেলা?

শেষ পংক্তিতে আছে,

বাংলা ভেঙে ভাগ করো।

এই মানুষটিই একাত্তরে লিখলেন,

যতো কাল রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী মেঘনা বহমান

ততো কাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান।

কালজয়ী হতে এর বেশী কিছু র দরকার পড়ে না।

রোগা পাতলা হওয়ায় থু থু ফেলে ফেলে দেখতেন রক্ত বেরোয় কি না, যক্ষ্মার ভয়ে গুটিয়ে থাকতেন। অথচ বেঁচেছিলেন ৯৯ বছর।

ভাগ্যিস, তা না হলে কী হতো এসব অমর লেখার জন্ম?

তাঁর একটা কথা খুব মনে রাখি আমি। লিখেছিলেন, ভুল করেও যদি কেউ মাটিতে বিষবৃক্ষের বীজ পুঁতে কোন সময় একদিন তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস আকাশকেও স্পর্শ করে। সমসাময়িক ঘটনাগুলো দেখলে এটাই মনে পড়ে যায়।

প্রয়াণ দিনে শ্রদ্ধা অন্নদা শঙ্কর রায়।

গান শুনতে ভালোবাসি। নিজের ইচ্ছে মতো গাইতেও ভালোলাগে। গানপাগল বলেই হয়তো এমন মানুষের সঙ্গ বা স্নেহ মিলে গিয়েছিল জীবনে। এঁরা বড় মাপের মানুষ। তাঁদের হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসাও বড় কোন আকাশের মতো।

তিনি দেশের সুরও সঙ্গীতের এক নক্ষত্র। যখন যেখানে হাত দিয়েছিলেন সোনা ফলেছিল। সিনেমার গানে, রেডিওর গানে, শেষ বয়সে বাংলা খেয়ালের গবেষণায় তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

সিডনিতে এক অনুষ্ঠানে পরিচয়। সেদিন তাড়াহুড়োয় তেমন কথাও হয় নি। আমিও বলার সুযোগ পেয়েছিলাম সে অনুষ্ঠানে। তাঁর মতো খ্যাতিমান সুরকার, গানওয়ালা মানুষের সামনে কিছু বলা ধৃষ্টতাতুল্য। তবু সেদিনকার সামান্য কথা ও আলাপেই গড়ে উঠেছিল আন্তরিক বলয়।

এরপর যখনই সিডনি আসতেন কথা বা দেখা হতো। শেষবারের দেখাটা ছিল অন্য কিছু। হঠাৎ অচেনা একটা ফোন রিসিভ করে শুনি তাঁর কন্ঠ। তিনি টের পেয়েছিলেন ঐ অনুষ্ঠানে আমি না ও যেতে পারি। যখন তিনি যেতে বললেন তখন তো যেতেই হয়।

কে জানতো সেটাই হবে শেষ দেখা! খেয়াল বিষয়ে তাঁর লেখাপত্র ওপার বাংলার সঙ্গীত বিশারদদের আগ্রহ, শান্তি নিকেতনে তাঁর সমাদর সবকিছু বলেছিলেন এক এক করে।

চলে আসার আগে কিছু কথা বলতেই হলো। ছবিটা দেখে এখন মনে হয় কী পরিমাণ ভালোবাসা নিয়ে শুনতেন। যা এখন কেউ শোনে না। তাঁর মতো প্রমিত বাংলায় বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার বাঙালিও বিরল। সেদিন স্বয়ং সেলিনা আজাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে গেয়েছিলাম,

মনের রঙে রাঙাবো

ফুলের ঘুম ভাঙাবো

আজাদ রহমানের যাদুকরী সুরে ঐ এক গানেই সেলিনা আজাদ কিংবদন্তীতুল্য।

মানুষ এই পৃথিবীর যাযাবর। আসে যায়। কেউ কেউ এমন ছাপ রেখে যায় সময়ও তা মুছতে দিতে চায় না।

তিনি সুরে সুরে অমর করে রেখে গেছেন

জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো

এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো

এমন জন্ম দাগ মোছে কার সাধ্য?

প্রয়াণ দিনে প্রণাম। আপনার সঙ্গসুধা আজীবন মনে রাখবো প্রিয় আজাদ রহমান।

আজকের ভূঁইফোড় রাজনীতিবিদদের পক্ষে এ জাতীয় মনীষার মূল্যায়ন অসম্ভব। ঝোপ বুঝে কোপ মারা কূটনীতিক বা দলীয় লেজুড় হয়ে কূটনীতিক হওয়া এক কথা, মেধা, শ্রম ও দেশপ্রেমে তারকা হওয়া ভিন্ন বিষয়।

এখন যাঁরা কূটনীতিক তাঁরা বাস করেন আপার ওয়াল্ডে। তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন।

জানি না, মাটির কাছাকাছি এক কূটনীতিকের গল্প এখন কাউকে টানে কি না? যাঁর কথা বলছিতাঁর কন্যা থাকতেন অস্ট্রেলিয়ায়। এই আত্মজা কে লেখা চিঠিগুলো ছিলো অসাধারণ গদ্যের এক ঐতিহাসিক দলিল। একটিতে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু তখন নবীন রাষ্ট্রের নতুন প্রধানমন্ত্রী। কোন এক আন্তর্জাতিক সভায় তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল আরেকটি মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধানের। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, এটা তুমি কি করলে মুজিব? একটি মুসলিমদেশ পাকিস্তানকে দু টুকরো করে দিলে? এতে আমরা হীনবল হয়ে যাবো না?

ইনি লিখছেন, আমরা উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে। কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন বঙ্গবন্ধু কিভাবে এর জবাব দেন। বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তোমার কথা যদি মানি বন্ধু আরবের দেশগুলো একসাথে থাকতে পারলে একদেশ হলে কি আরো ভালো হতো না? তারচেয়ে কি আরো ভালো হতো না দুনিয়ার সব মুসলিম দেশগুলো একটি রাষ্ট্র হলে? সেটা কি হয়েছে? এরপর তিনি বাংলাদেশ হবার কারণগুলো তুলে ধরেন। ততক্ষণে প্রশ্নকর্তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

এমন অজস্র বাস্তব অজানা কাহিনীর বই ‘প্রিয় ফারজানা’। বইটি আমি সময় পেলে ইতিহাস জানতে হলেই ফিরে ফিরে পড়ি। নেহেরুর ইন্দিরাকে লেখা চিঠি ভারত দুনিয়াকে জানিয়েছে। আমরা পারি নি।

এই ভদ্রলোক বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিন তাঁর সাথে ছিলেন। দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধু কলকাতা না গিয়ে কেন সরাসরি ঢাকায় এসেছিলেন সে কাহিনী তিনি না বললে কোনকালেও জানা হতো না। তিনিই জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কতোটা দূরদর্শী আর মহানুভব। তিনি তাঁকে ডেকে বলেছিলেন ঢাকায় তখন পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক আলোর অভাব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঢাকায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হলে আলোহীনতায় জনগণের কষ্ট হবে। তারা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাই তিনি কলকাতা না গিয়ে সরাসরি চলে এসেছিলেন ঢাকায়।

লেখক, পররাষ্ট্র সচিব ও ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বাংলা ভাষণের ইংরেজী অনুবাদের পাঠক ফারুক চৌধুরী আজকের দিনে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। খুব কম মানুষই তাঁকে জানে। বঙ্গবন্ধুর দলের লোকেরাও জানায় নি, চেনায় নি কোনদিন। সজ্জন, ধীমান, মেধাবী বাঙালির শেষ প্রজন্মের এই গুণীকে জানাই প্রণাম। প্রয়াণের দিনে শুভ বিদায় ফারুক চৌধুরী।

লেখক : কবিছড়াশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃত শিক্ষা খোঁজাও একটা দায়িত্ব
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাইয়ে দরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করল বিজিবি