দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মন ভালো করে দেয়ার মতো একটি উদ্যানে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটালাম আমরা। আয়েশী সময়। কিছুই করার নেই, আবার অনেক কিছু করার আছে এমন ভাব নিয়ে ঘুরলাম, ছবি তুললাম। একা একা কোন ভালো লাগার জায়গায় ঘুরতে গেলে মন যখন ভরে উঠে তখন আবার নিজেকে বড় বেশি অসহায় লাগে, একা একা লাগে। কারো কারো কথা খুব মনে পড়ে। আহারে একসাথে এমন রূপ দেখতে পারলে কী অপরূপই না হতো! টেম্পল অফ হেভেন বা স্বর্গের মন্দির এবং এর চারপাশের অনন্য সুন্দর উদ্যানটি এত দেখেও আমার তেমন লাগছিল। ভালো লাগায় মন ভরে যাওয়ার পর নিজেকে আবার অসহায় লাগছিল। যদি সবাইকে নিয়ে এসে একসাথে পাঁচ বছরের পুরানো গাছটির নিচে বসে থাকতে পারতাম! যদি ওই যে মন্দিরের চত্বরটিতে হাঁটতে পারতাম! পারতাম যদি প্রতিধ্বনির দেয়ালটি নিয়ে নতুন খেলায় মেতে উঠতে! কিন্তু কিছুরই উপায় নেই। অনেকের মাঝে একদম একা হয়ে স্বার্থপরের মতো সব সুখ যেনো একাই উপভোগ করছি আমি। কেমন যেনো হাহাকার লাগছিল, ইচ্ছে করছিল বড় বড় গাছগুলোর ছায়ায় বসে থাকতে। তবে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, টেম্পল অফ হেভেন এবং এর চারপাশের নান্দনিক উদ্যান আমার মনটি ভরিয়ে দিয়েছে। আমাদের ফেরার তাড়া দেয়া হলো। গাইড মিজ পিনং বললেন, এখানের নির্ধারিত সময় শেষ। দেরি করলে অন্যস্থানে মিস করবেন! আরো কোথাও নেবে নাকি!! দারুণ তো। একদিনে আর কত ঘোরাবে? ট্যুর অপারেটরগুলো যেখানে কম ঘুরিয়ে বেশি টাকা হাতিয়ে নেয় সেখানে এই কোম্পানি দেখছি অনেকক্ষণ ঘোরাচ্ছে, অনেককিছু দেখাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল টেম্পল অব হেভেন দেখার পর আমাদের হোটেলে নিয়ে যাবে। শরীরও বিশ্রাম চাচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হলো, নতুন আরো কোথায় নিয়ে যাবে। শরীরের দাবি অস্বীকার করে নতুন কিছু দেখার উত্তেজনায় আবারো চাঙ্গা হতে শুরু করলাম। আমরা একে একে সবাই বাসে উঠে নিজেদের সিটে বসে পড়লাম।

মিজ পিনং বাসের লাউড স্পিকার নিলেন। বললেন, সামনে আমরা চমৎকার একটি জায়গায় যাবো। যেটা চীনের আধুনিক স্থাপত্যের সিম্বল। আপনি সিম্বল অব বেইজিংও বলতে পারেন। এই স্থাপনাটিকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে শুরু করেছি। এটি আমাদের অনেক ভালোবাসার এবং অহংকারের ধন। শুধু আমাদের নয়, এটি বিশ্ববাসীরও ভালোবাসা কুড়িয়েছে। বুঝতে পারছিলাম না এমন ইনিয়ে বিনিয়ে কিসের কথা বলছেন পিনং। তিনি বললেন, জায়গাটি খেলাধুলার হলেও গত ক’বছরে এটি শহরের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পর্ট হয়ে উঠেছে। আমার খারাপ লাগছে যে, আপনাদের ভিতরে ঢোকাতে পারবো না। তবে বাইরেও এটি অনেক সুন্দর। নিশ্চয় আপনারা বুঝতে পারছেন আমি কিসের কথা বলছি। আমি খুব অসহায়ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আসলে তিনি কি বা কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কথা বলছেন তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। শুধু কথা শুনে কোন স্থাপনার ব্যাপারে ধারণা করতে পারার মতো অভিজ্ঞতাও চীন সম্পর্কে আমার নেই। তিনি একটু থামলেন। চ্যাপ্টা নাকের সুন্দরী তরুণীর চোখজোড়া যেনো চিকচিক করে উঠলো। তিনি বললেন, আমি বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের কথা বলছি। বার্ড নেস্ট স্টেডিয়াম বলে তিনি এমনভাবে আমাদের সবার দিকে তাকালেন যে, যেনো এই স্টেডিয়াম সম্পর্কে আমাদের সবার সবকিছু জানা উচিত। গর্বে মাথা উঁচু করে পিনং বললেন, ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের অনেকগুলো ইভেন্টসহ উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠান এই স্টেডিয়ামে হয়েছিল। অলিম্পিকের জন্যই স্টেডিয়ামটি করা হয়েছিল।

আমার অসহায়ভাব কেটে গেলো। আমি খেলাধুলার মানুষ না হলেও বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের নাম আগে শুনেছি, ছবিও দেখেছি। দূর থেকে দেখলেও এটি যে বার্ড নেস্ট বা পাখীর বাসার আদলে গড়া স্টেডিয়াম সেটি বুঝতে পারবো। এখানে যে ২০০৮ সালের অলিম্পিক হয়েছিল তাও জানি।

খেলাধুলার প্রতি আমার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই, নেই অভিজ্ঞতাও। বাংলাদেশ টিম ছাড়া অন্য কোন টিমের প্রতি নেই কোন আকর্ষণও। তবে কেমন করে যেনো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লর্ডস স্টেডিয়াম, শারজাহ স্টেডিয়াম, ইডেনসহ দুনিয়ার বিখ্যাত কয়েকটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম আমার দেখা হয়ে গেছে। এখন দেখছি বহুল আলোচিত বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামও দেখা হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলাম যে, স্টেডিয়ামে পৌঁছেই একটি ছবি তুলে আমাদের স্পোর্টস রিপোর্টার নজরুলকে পাঠিয়ে দেবো। কারণ ছোটভাই নজরুলের ধারণা দুনিয়াতে একমাত্র মানুষ আমি যে খেলাধুুলার কিছুই বুঝি না! ক্রিকেট খেলার সময় আমি হুটহাট দুয়েকটি কমেন্ট করলে নজরুল এবং ঋত্বিক এমনভাবে হাসে যে, আরে আকবর ভাইও তো দেখি বুঝে!

পড়ন্ত বিকেল। চারপাশ ভরে আছে কনে দেখা আলোয়। কী যে মোলায়েম প্রকৃতি। এমন দারুণ এক স্নিগ্ধতায় আমাদের বাস এসে থামলো বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের কাছে। আমাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে স্টেডিয়ামের সামনের চত্বরে নিয়ে আসা হলো। চমৎকার একটি চত্বর। দারুণ সব আয়োজন চারদিকে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, তকতক করছিল। আউটার স্টেডিয়ামের নান্দনিক সব আয়োজনের মাঝে বহু মানুষ বৈকালিক সময় কাটাচ্ছে, বেড়াচ্ছে। কলাগাছের আদলে বানানো লাইটপোস্টগুলোও নজর কাড়ছিল। আমরা হেঁটে স্টেডিয়ামের একেবারে কাছে চলে গেলাম। আমি খুব কাছ থেকে স্টিল স্ট্রাকচারের কাঠামোগুলো দেখতে লাগলাম। কী সাংঘাতিক এক ডিজাইন! কী করে যে এই স্থাপনা নির্মিত হয়েছে কে জানে! মাত্র পাঁচ বছরে এমন দুর্দান্ত একটি স্থাপনা কী করে নির্মিত হলো মাথায় ঢুকছিল না। হয়তো চীন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। বছরে পাঁচ লাখের বেশি ইঞ্জিনিয়ার যেদেশে সৃষ্টি হয় সেদেশ তো এমন সব তাক লাগানো নির্মাণ করবেই! স্টিলের খিলানগুলো একটির ভিতর দিয়ে অন্যটিকে এমনভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেখতে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কোনটি যে কোনটির ভিতর দিয়ে কোথায় গিয়ে শক্তি দিচ্ছে তাও বুঝা যাচ্ছিল না। আমার মতো মূর্খ মানুষের পক্ষে এসব বুঝার সাধ্যিও নেই। এমন এলোমেলো একটি স্থাপনা যে কী করে দাঁড়িয়ে আছে তা বিস্মিত করছিল আমাকে। এটির দাঁড়িয়ে থাকার সক্ষমতা নিয়ে সাধারণ দৃষ্টিতে সংশয় দেখা দেয়ার কথা! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি ২০০৮ সাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে!

বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের অপর নাম বেইজিং জাতীয় স্টেডিয়াম। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত চীনের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককে কেন্দ্র করে স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। স্টিল স্টাকচারের চমৎকার স্থাপনাটি চুড়ুইপাখীর বাসার মতো বহু যত্নে করা। আর যত্নের ছাপ এটির পরতে পরতে।

পিনং জানালেন, এটিই চীনের বৃহত্তম স্টেডিয়াম। আগেই বলেছি চীনের সবকিছু বড় বড়। সেই বড়’র বড় যে কত বড় তা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্টিল স্টাকচারের বিশাল স্থাপনাটির দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা আমি যখন শুনলাম যে এটি রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় তখন চোখ কপালে না উঠে কী উপায় থাকে!! এটি নাকি আগামী একশ’ বছর এমন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। বেইজিং এর আগামী ১০০ বছরের খেলাধুলার সব আয়োজন মাথায় রেখে এই স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করা হয়েছে। ধারণক্ষমতা ৯০ হাজার বলা হলেও স্টেডিয়ামটিতে একই সাথে এক লাখের কাছাকাছি দর্শক খেলা উপভোগ করতে পারে। কোন কারনে বড় কোন দুর্যোগ হলে মানুষ যাতে দ্রুত ও নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারে তারও দারুণ সব আইডিয়া এই স্টেডিয়ামে কাজে লাগানো হয়েছে। মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যেই স্টেডিয়াম থেকে এক লাখ লোক নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারবে। বার্ড নেস্টের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের যোগান আসে সৌর শক্তি থেকে। দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় নেয়া এই পদক্ষেপের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ধরে রাখারও ব্যবস্থা রয়েছে। এই পানি দিয়ে স্টেডিয়ামের বাগানসহ চারপাশের বিভিন্ন প্রজাতির গাছগুলোতে পানি দেয়া হয়। বৃষ্টির পানি দিয়ে প্রকৃতিকে সবুজ করার দারুণ আয়োজন স্টেডিয়ামটিতে। শুনে ভালো লাগলো যে, এটিকে বর্তমানে চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া স্থাপনা হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধরাফি স্মৃতি ক্রিকেটে জে.ডি.সি ও ব্রাইট একাডেমির জয়লাভ