দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনা তরুণী নানা খাবার ভর্তি ক্যারিয়ারটি ঠেলেঠুলে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঠেলেঠুলে বলতে বেশ কষ্টসাধ্য মনে হলেও আসলে ব্যাপারটি তা নয়, বিমানের ট্রলির চেয়ে অনেকবেশি অনায়াসে তিনি ট্রলিটি নিয়ে আমার সিটের পাশে দাঁড়ালেন। কি নেবো জানতে চাইলেন। তার কাছে কি কি সব খাবার আছে তার একটি বর্ণনাও দিলেন। আমি শুধু এক কাপ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। দামটা আগেই বাড়িয়ে ধরলাম। তরুণী আমার হাত থেকে ক্যাশ ইউয়ান নিয়ে কফি তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন। ওয়ান টাইম কাপ, মোটা বোর্ডের। এটি কাগজের নাকি প্লাস্টিকের বুঝতে পারছিলাম না। নাকি কাগজের সাথে প্লাস্টিকের মিশেল দিয়ে কাপটি তৈরি করা হয়েছে তাও জানি না। তবে বেশ শক্ত এবং পোক্ত। আমি সামনের সিটের সাথে লাগোয়া মিনি টেবিলটি খুলে তার উপর মগটি রাখলাম। কী আশ্চর্য! তিনশ’ আট কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলছে অথচ কফির মগটি সবকিছু নিয়ে উল্টে পড়ছে না। এমনকি একটু কাঁপাকাঁপিও করছে না! আধো আধো আলতো চুমুকে আমি তৃঞ্চার্ত মানুষের মতো কফির তৃপ্তি নিতে লাগলাম।

ছুটছে আমাদের ট্রেন। বিপুল গতিতে এগুচ্ছে সামনে। কিন্তু আগেই বলেছি যে, এই গতির কিছুই আমি টের পাচ্ছি না। সত্যিই বলতে কি ডিজিটাল স্পিড মিটারে ট্রেনটির গতিবেগ প্রদর্শিত না হলে আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না যে আমাদের ট্রেনটি এত গতিতে ছুটছে। অবশ্য এখন স্পিড মিটার না দেখেও বাস ট্রেন কিংবা প্রাইভেট কারে বসে গতির হিসেব পাওয়ার নানা এ্যাপস আবিস্কৃত হয়েছে। যে গাড়িতে আপনি বসে আছেন সেটি কত বেগে ছুটছে তা মোবাইল এ্যাপসই বলে দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই গতির হিসেবে পেতে এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। গাড়ির গতি বাড়লে মোবাইলের এ্যাপসে গতি বাড়ে, গতি কমলে মোবাইল এ্যাপসেও কমে যায়। কী আশ্চর্য সব আয়োজন জগতজুড়ে!!

কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছিলাম জানালার বাইরে। বাইরের সবুজ গাছ, কমলা বাগান, ধানের জমি, মাঠের গরু, বৈদ্যুতিক খুঁটি সবই ছুটছে। সবই দৌড়াচ্ছে পেছনে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এমন তীব্র গতিতে বাইরের কোন কিছুই ঠিকঠাকভাবে দেখার কথা নয়, চেনা তো দূরের কথা। অথচ আমি সবকিছুই চিনতে পারছি, দেখছিও বেশ স্পষ্ট। বেশ খটকা লাগলো। এত গতিতে ছুটছি আমরা, অথচ সবকিছু কতই না স্বাভাবিক দেখাচ্ছে! বিষয়টি নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে জানলাম যে, এই ধরনের উচ্চগতির ট্রেনের জানালার কাচে বিশেষ ধরনের একটি উপকরণ থাকে। যা ভিতরের যাত্রীকে ট্রেনের গতি বুঝতে দেয় না। বাইরের সবকিছু স্বাভাবিকভাবে এডজাস্ট করে। পুরো ব্যাপারটিই কাঁচের কেরামতি! নাহয় যে গতিতে ট্রেনটি ছুটছে তাতে বাইরের সবকিছু এত স্পষ্ট দেখার কথা নয়। ট্রেনের ভিতরে বসে বাইরের এমন গতি টের পেলে মাথা চক্কর দিয়ে ভিমরি খাওয়ার কথা! অথচ কী আরাম করেই না আমি কফি খাচ্ছি!

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। আরাম করে ঘুমানোর ব্যবস্থা না থাকলেও সিটে হেলান দিয়ে অনেকেই ঘুমুচ্ছেন। বসে থাকার মাঝেও বুঝি ক্লান্তি আছে! তাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছেন অনেকেই, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমিও। কিন্তু ঘুম কেন যে ভাঙ্গলো তা বুঝতে পারলাম না। পুরো বগিতে কোন সাড়াশব্দ নেই, ট্রেন চলারও কোন আওয়াজ নেই। নিরবে ছুটে চলছে আমাদের হাইস্পিড বাহন। নিঃশব্দ এই যাত্রায় ঘুম কেন ভাঙ্গলো কে জানে!

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম কে জানে! কোন স্বপ্ন দেখেছিলাম কিনা তাও খেয়াল করতে পারলাম না। কফি খেতে খেতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়লো। কফির মগটি সামনের মিনি টেবিলে অলস পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে নিলাম। চুমুক দিতেই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবে কেমন যেন কোল্ড কফির ভাব চলে এসেছে। আমি আস্তে আস্তে কফির মগটি উজাড় করছিলাম।

ট্রেনে বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। ছুটছে ট্রেন। কোথাও থামছে না, কোথাও যাত্রী উঠানামা নেই। নেই হকারের হাঁকডাক। কেবলই ছুটছে, কেবলই ছুটছে। কত জনপদ যে পার হলাম কে জানে! পার হলাম কত শহর! ধানী জমি, ফসলের মাঠ, সুউচ্চ পাহাড় সবই পেছনে ফেলে সামনে এগুচ্ছিলাম আমরা। পাহাড়গুলো গাছে গাছে ভরে আছে, সবজু। কী সুন্দর এক একটি পাহাড়! পাহাড়ের ভাজে ভাজে বাড়িঘর গড়ে তোলা হয়েছে, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার মতো। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে হলেও রাস্তা রয়েছে। বিভিন্ন বাড়ির সামনে এবং রাস্তায় গাড়িও দেখা গেল। পাহাড়কে পাহাড়ের আদলে রেখে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার নান্দনিক আয়োজনগুলো সত্যিই ভালো লাগলো। আহা, আমাদের কেন যে হয় না! কেন যে পাহাড়ের পর পাহাড় উজাড় করে আমাদের বাড়ি করতে হয়, রাস্তা করতে হয়!! বেশ বিরক্ত লাগছিল। ইচ্ছে করছিল ট্রেন থেকে নেমে যেতে! কতক্ষণ আর এভাবে বসে থাকা যায়! এমিরেটস এয়ারলাইন্সের দুবাই থেকে লসএঞ্জেলস ফ্লাইটের কথা মনে পড়লো। ১৭/১৮ ঘন্টা বিমানের ইকোনমি ক্লাসে বসে থাকার কষ্টের কথা মনে পড়লে অন্তর কেঁপে উঠে। ফ্লাইট থেকে আটলান্টিকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে! এখানেও ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। তবে ট্রেনে একটু হাঁটহাঁটি করলে মনে হয় ভালো লাগবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতে গিয়ে টের পেলাম যে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় শুধু পায়েই নয়, কোমরেও একধরনের জড়তা তৈরি হয়েছে। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলাম। অতঃপর সামনে পা বাড়ালাম।

ট্রেনের ভিতরে হাঁটতে বেশ লাগছিল। দুইপাশের মানুষের চেহারা দেখে দেখে মাঝের রো ধরে হাঁটছিলাম। সিটে সিটে বসে আছেন বহু নারী পুরুষ। কেউ ঘুমুচ্ছেন, কেউ পাশের জনের সাথে গল্প করছেন, কেউবা বই পড়ছেন। হ্যাঁ, চীনের মানুষ প্রচুর পড়েন। এখানে এসেছি পর্যন্ত বাসে ট্রেনে বিমানে প্রচুর লোককে বই পড়তে দেখেছি। এগুলো কি গল্পের বই, নাকি পাঠ্যবই তা বুঝতে পারিনি। তবে হাতে হাতে বই দেখে বেশ ভালো লেগেছে আমার। এত লেখাপড়া করলে তারা তো জ্ঞানী হবেই। বিশ্বের মেগাকারখানা তো আর তারা এমনি এমনি হয়নি। প্রতি বছর পাঁচ লাখ নতুন ইঞ্জিনিয়ার যুক্ত হন তাদের কর্মক্ষেত্রে! বছরে পাঁচ লাখ ইঞ্জিনিয়ার!

আমি ট্রেনের ভিতরে এক বগি থেকে অন্য বগিতে হাঁটতে লাগলাম। আরো কয়েকজন হাঁটছেন। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলছেন না, বাধা দিচ্ছেন না। ওয়াশরুমের সামনেও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল। একটি ‘কিউ’ তৈরি হয়েছে। আমি আড়চোখে দেখে সামনে এগুলাম।

আহা, পুরোদিন কেটে গেল ট্রেনে। কেমন করে আস্ত একটি দিন ট্রেনের সিটে বসে কাটিয়ে দিলাম! এখন অন্ধকার নেমে গেছে। বাইরের আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মধ্যে দূরে দূরে বৈদ্যুতিক আলোর এক একটি ঝলকানি চোখে পড়ছিল। ট্রেনের ভিতরে রাত এবং দিনের কোন পার্থক্য দেখা যাচ্ছিল না। প্রচুর লাইট রয়েছে বগিতে। শুধু বাইরের অন্ধকার বেশ চোখে পড়ছিল। আর ট্রেনের বাইরে অন্ধকার যত বাড়ছিল ততই বাড়ছিল আমার ভিতরের শংকা। বেইজিং পৌঁছানোর পর এমন রাতে কোন পথে কোথায় যে যাবো! আমাদের ট্রেনের গতি বেশ কমছিল। একেবারে হুট করে না কমিয়ে দশ বিশ কিলোমিটার করে কমিয়ে আনা হচ্ছিল। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার আগ থেকে যাত্রা করে দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে একেবারে সেকেন্ড মিনিট হিসেব কষে পূর্বঘোষিত সময়ে স্টেশনে ঢোকা আসলেই একটি কঠিন ব্যাপার। বিদ্যুৎ চালিত এই ট্রেনটি যিনি চালাচ্ছেন তিনি ঠিক কিভাবে যে এই কঠিন কাজটি প্রতিদিনই এত সহজভাবে সম্পন্ন করেন কে জানে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আমি কোন্‌ ব্যাচের?
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ