(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আদরের কন্যার বহুল প্রত্যাশার পিংক কালারের স্টেথোস্কোপ কিনে ঠকলাম কী জিতলাম তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ফুরফুরে মেজাজে স্টলটি থেকে বের হয়ে আসলাম। ফেরার সময় স্টলের দুই কর্মীকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিলাম। তারাও বেশ বিগলিত হয়ে পাল্টা জবাব দিলেন। চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম যে, আমার হুজুগে সিদ্ধান্তে কায়সার ভাই এবং জুবায়ের ভাই মোটেই খুশি হননি। তাদের ধারণা শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলাম। কিন্তু আমার বুকের গভীরে সুখের যে সুবাতাসের ছড়াছড়ি তা টাকা খরচ করেও পাওয়া কঠিন। মানুষ তো কত কাজেই টাকা খরচ করে! কিন্তু সব খরচের বিনিময়ে কী এমন সুখ জুটে!!
নেই কাজ তো খই ভাজ! আসলে আমাদের তো কোন কাজ নেই। মেলায় কোন কেনাকাটা নেই। অর্ডার দেয়ার ব্যাপার নেই। অর্ডার পাওয়ারও কিছু নেই। কাকতালীয়ভাবে পিংক কালারের একটি স্টেথোস্কোপ পেয়ে যাওয়া এবং তা কিনে নেয়ার মাধ্যমে ক্যান্টন ফেয়ার আমার হৃদয়ে ভিন্ন একটি আবহ তৈরি করলো মাত্র! হাতে স্টেথোস্কোপের প্যাকেটটি নিয়ে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরছিলাম আমরা। দেখছিলাম নানা কিছু। এক কোটি বর্গফুটেরও বেশি আয়তনের কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেলা অঙ্গনটি যে কোন মানুষের চোখে ঘোর লাগানোর জন্য যথেষ্ট!
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। ক্ষুধা নড়েচড়ে উঠছিল। কায়সার ভাই বললেন, চলেন, বাসায় না গিয়ে এখানেই খেয়ে ফেলি! আমার তো কোন কিছুতে কোন আপত্তি নেই। খেতে হবে এমন কোন কথাও নেই। মোটা মানুষের বহুমুখী অসুবিধা আছে এক কথা ঠিক। তবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হচ্ছে সময়মতো খেতে না পারলেও ক্ষুধার কষ্টে কষ্ট করতে হয়না। চর্বি গলে শরীরে সুগারের যোগান দেয়। ফলে শরীর দুর্বল হয়না। হাঁটাচলায় ক্লান্তি আসেনা। অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে দেখেছি যে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল বা সন্ধ্যা হলেও ক্ষুধার কষ্ট আমাকে কাহিল করেনা।
আমরা ফুডকোর্টের পথ ধরলাম। মেলা অঙ্গনের একপাশের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ফুডকোর্ট। শত শত খাবারের দোকান। সামনে ফুটবল খেলার মাঠের মতো খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিল পাতা। বিভিন্ন স্টল থেকে পছন্দের খাবার নিয়ে চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করছেন শত সহস্র মানুষ। আগেই বলেছি যে ফুডকোর্ট তো নয়, যেনো খেলার মাঠ। অন্তত হাজার দশেক মানুষ একই সাথে বসে উৎসবের আমেজে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন এখানে। কত রকমের খাবার যে স্টলগুলোতে বিক্রি হচ্ছে!
আমাদের দলপতি কায়সার ভাই। চট্টগ্রামের সন্তান কায়সার ভাই বেশ কয়েক বছর ধরে গুয়াংজু রয়েছেন। আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাইর গুয়াংজু অফিস পরিচালনার অন্যতম কান্ডারী তিনি। ইউছুপ আলী ভাই হংকং থাকেন। জাহেদ ভাই এবং কায়সার ভাই-ই মূলতঃ গুয়াংজু অফিস দেখাশুনা করেন। চীনের ভাষা এবং খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত অভিজ্ঞ কায়সার ভাই লাঞ্চে কি খাবো জানতে চাইলেন। আমি হাত উল্টিয়ে বললাম, যা ইচ্ছে। খাবারের ব্যাপারে আমার তেমন কোন পছন্দ অপছন্দ নেই। একটি হলেই হয়ে যায়!
একটি দোকানে স্যুপ এবং ফ্রাইড রাইসের সাথে আরো কী কী সব খাবার দিয়ে অথেনটিক একটি চাইনীজ ফুডের অর্ডার দিলেন কায়সার ভাই। প্লেটার টাইপের। বিভিন্ন খাবার দিয়ে প্যাকেজ। টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে আমাদের হাতে একটি টোকেন দিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন তরুণী। আমরা তিনজন সামনের একটি টেবিল দখল করে বসলাম। চারটি চেয়ার রয়েছে টেবিলটিতে। একটি চেয়ারে আমার হাত ব্যাগ এবং স্টেথোস্কোপের প্যাকেট রেখে দখল করে রাখলাম। চারজনের টেবিলটি আমরা তিনজনের দখলে! অতএব আমরা নিজেদের মতো করে গল্প করতে লাগলাম।
আমাদের আগে আরো অনেকেই খাবারের অর্ডার দিয়েছেন। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে টোকেন নম্বর দেখানো হচ্ছিল। অর্থাৎ যে অর্ডারের খাবার সার্ভ হচ্ছিল সেই অর্ডারের টোকেন নম্বর ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত হচ্ছিল। নম্বর দেখে দেখে খাবার আনতে হচ্ছে। এটি এমন কোন নতুন সিস্টেম নয়। বহু বছর আগ থেকে দুনিয়ার দেশে দেশে এই সিস্টেম চালু রয়েছে। আমি প্রথম এই সিস্টেমটি দেখেছিলাম জাপানের টোকিওতে, কেএফসিতে খাবারের অর্ডার দেয়ার পর এমন একটি টোকেন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্বের বহুদেশেই এমনতর টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন আমাদের চট্টগ্রামেও এমনতর টোকেনের জমজমাট কারবার চলে। শুধু খাবারের দোকান নয়, ব্যাংকসহ কিছু কিছু কর্পোরেট অফিসেও সেবা পেতে টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
কেমন যেন গমগম করছিল পুরো ফুডকোর্ট। ছোটবেলায় হাটে বাজারে এমনতর গমগম আওয়াজ শুনতাম। বিশেষ করে মাছ বাজারে। সবাই যেখানে কথা বলে সেখানে মনে হয় এমন শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি হয়!
বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের অর্ডারের খাবার তৈরি হচ্ছে। আর মাত্র একটি টোকেনের পরই আমাদের নম্বর। খাবারের অপেক্ষার পালা বুঝি শেষ হতে চললো! জ্বী, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের টোকেন নম্বর প্রদর্শিত হচ্ছিল। আমরা তিনজনই কাউন্টারে গেলাম। প্লেটার, তাই তিনজনকেই মূলতঃ খাবার টেনে টেবিলে আনতে হবে। সেল্ফ সার্ভিস। খাবারের পর উচ্ছিষ্টও নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে প্লেট নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। টেবিলে টেবিলে খাবার পৌঁছে দেয়া, পানির বোতল দেয়া, চা সার্ভ করা, তরকারির ‘গেটিজ’ দেয়ার কোন সিস্টেম ফুডকোর্টে নেই। এত সার্ভিস দেয়ার মতো লোকবল এখানে নেই। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ হলেও চীনে শ্রমের মূল্য অনেক। আমাদের মতো কাজে অকাজে লোকবল নিয়োগের সুযোগ নেই সেখানে। শুধুমাত্র শ্রমের উচ্চমূল্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বহু ব্যবসা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
দারুণ টেস্টি খাবার। স্যুপটি অসাধারণ। ক্লিয়ার স্যুপ, তবে আমাদের এখানের চেয়ে কোথায় যেনো একটু আলাদা। হাঁসের মাংস ভুনার সাথে ফ্রাইড রাইস। কায়সার ভাই সাথে থাকায় খাবারের ব্যাপারে কোন ধরনের সংশয় বা সংকোচ আমার হচ্ছিল না। অথচ চীনে সাপ ব্যাঙ পোকামাকড় থেকে শুরু করে কত কিছু যে রান্না হয়, পাতে উঠে!
বেশ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হলো আমাদের। কায়সার ভাই বুঝে গেছেন যে, আমি কফি আসক্ত একজন মানুষ। ইউছুপ আলী ভাইও তাকে নিশ্চয় কোন ধারণা দিয়েছেন। তাই খাবার শেষ করার সাথে সাথে কায়সার ভাই বললেন, এটাতে কফি নেই। চলেন, ওদিকে যাই। কোস্টা কফি’র স্টলের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। আমরা গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। দুনিয়ার বিখ্যাত কফিগুলোর মধ্যে কোস্টা অন্যতম। তাই মেলায় এমন ব্র্যান্ডের কফিশপ দেখে খুশি হলাম। পাশেই ম্যাকক্যাফের স্টল রয়েছে, রয়েছে টাল্লিস কফিও। আমরা কোস্টাকফি নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে যখন মেলা অঙ্গন থেকে বেরুলাম, তখন আমার পায়ের তলায় অন্যরকমের জ্বলুনি টের পাচ্ছিলাম। কী পরিমাণ হাঁটাহাঁটি যে হয়েছে তা এই জ্বলুনিই জানান দিচ্ছিল! আমরা মেট্রো স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম। তাও পায়ে হেঁটে। কতক্ষণ আর হাঁটা যায়! প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর মেট্রো! ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তবে কোন বিশৃংখলাও নেই। ধাক্কাধাক্কি নেই। লাইন ধরে দাঁড়ান, সামনের জন যাওয়ার পর আপনি যাবেন। সুশৃংখল কিউ। আমরা গিয়ে কিউ’তে দাঁড়ালাম। তৃতীয় ট্রেনেই জায়গা পেয়ে গেলাম। কখনো উপর দিয়ে আবার কখনো মাটির তলা দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুড়লো মেট্রো। ট্রেনের ভিতরও প্রচুর মানুষ। নারী পুরুষ। মেলা থেকে ফিরছেন সকলে। কিন্তু কোন গোলমাল নেই, নেই গন্ডগোলও। প্রচুর নারী পুরুষ ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ালেও ইভটিজিং টাইপের কিছু চোখে পড়লো না। কোনরকমের ঝগড়া বিবাদ কিংবা হৈ চৈ হলো না। যে যার মতো রয়েছেন। যারা সিটে বসেছেন তারা নিজের মতো বসে আছেন, সহযাত্রীর সাথে কথা বলছেন। গল্প করছেন। কেউ কেউ মোবাইল টিপছেন। যারা সিট পান নি, তারা দাঁড়িয়ে আছেন। নিজেদের মতো করে দাঁড়িয়ে থাকলেও পাশের সুন্দরী তরুণীকে একটু ঠেলা দেয়া, একটু চিমটি কাটা কিংবা ছুঁয়ে দেয়ার কোন ঘটনা ঘটতে দেখলাম না। ট্রেনে সিট পাইনি, দাঁড়িয়ে থেকে গন্তব্যে যাচ্ছি। তবুও যে কোন বিচারে এই যাত্রাকে চমৎকার একটি ট্রেন জার্নি হিসেবে স্বীকার করতে হবে। চট্টগ্রামে চীনা নাগরিকদের বহু ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে। রয়েছে বড়সড় বিনিয়োগও। চাকরি বাকরিও করেন সুদূর চীন থেকে আসা বহু নারী পুরুষ। আমাদের এলাকায়ও বেশ কিছু চীনা নাগরিক বসবাস করেন। কিন্তু এখানকার চীনাদের আচরণের সাথে স্বদেশে চীনাদের চালচলন মিলাতে পারছিলাম না। কেমন যেন খটকা লাগছিল। আমাদের দেশে আইন না মানার যে প্রবণতা, প্রবাসী চীনারাও বুঝি তা খুব সহজেই রপ্ত করেন। আর এতে করে বহু চীনা নাগরিকই আমাদের এখানে বেপরোয়া হয়ে উঠেন, নানাভাবে উচ্ছৃংখল আচরণ করেন! চীনের গুয়াংজুতে মেট্রোভর্তি মানুষ, অথচ কোন ঝামেলা আছে বলে মনে হচ্ছিল না। তবে কায়সার ভাই আমাকে পকেট এবং মোবাইল সাবধানে রাখতে বললেন! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।