দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ রাত অব্দি জাহাজে ভাসলাম আমরা। শুধু আমরা নয়, আরো অনেকগুলো জাহাজ নদীর বুকে ভাসছিল। যেন বজরার কাফেলা। প্রতিটি জাহাজ থেকেই ভেসে আসে গান, হল্লা রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছিল। সাথে আলোর ঝলকানিতো রয়েছেই। গুয়াংজুতে একটি কথার বেশ প্রচলন রয়েছে যে, কোথাও গুয়াংজুর গল্প বলতে গেলে পার্ল রিভারের রেড বোটের কিংবদন্তী শুনাতে হবে। পার্ল নদীর বুকে রাতে ভেসে বেড়ানো রেড বোটের নাইট ক্রুজ আসলেই কিংবদন্তী। আর আমরা এখন সেই কিংবদন্তীর অংশীদার হয়ে হাওয়ায় গা জুড়াচ্ছি।
চমৎকার একটি স্থাপনা দেখলাম নদীর পাড়ে। অবশ্য পার্ল রিভারের দুই পাড়েই শত শত চোখ ধাঁধানো স্থাপনা। তবে এটিকে কেমন যেন একটি অন্যরকম লাগলো। রাত নেমে গেলেও ভবনটির নদীর পাড়ের দিকে বহু তরুণ তরুণী বসে বসে গল্প করছিলেন। কেউ কেউ নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলেন। কেউবা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন জাহাজের আলোকছটা। কেউ কেউ শরীর চর্চা করছেন। যেন একটি পার্কে দলে দলে তরুণ তরুণী জীবন সাজাতে ব্যস্ত। আমি ইশারায় ওটি বিল্ডিংটি কিসের জানতে চাইলাম। কায়সার ভাই বললেন, এটি ‘সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াংজুর অতি প্রসিদ্ধ একটি বিদ্যাপীঠ। শিক্ষায় এবং মানে চীনের বেশ প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সুনাম রয়েছে বলেও জানান তিনি। তরুণ তরুণীদের যাদের আমরা জাহাজ থেকে দেখছি তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রছাত্রী। অবসর সময়টা নিজেদের মতো করে কাটাচ্ছে। অবশ্য বাইরের মানুষও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান বলেও উল্লেখ করলেন তিনি।
পার্ল রিভারের বর্ণনা আগেই দিয়েছি। এটি শুধু দেখার বিষয়। লিখে এই নদীর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা কঠিন। নদীকে ঘিরে আলোর যে ঝলকানি তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। নদীর দুই পাড়ে আলোকসজ্জা, আলো নিয়ে অসাধারণ সব আয়োজন। নজরকাড়া আলোকসজ্জায় সজ্জিত দুইপারের স্থাপনাগুলোর প্রতিবিম্ব পড়েছে নদীর পানিতে। মনে হচ্ছে যেন পানির নিচেও একটি আলোকোজ্জ্বল শহর! শুধু নাইট ক্রুজের বড় বড় জাহাজই নয়, ওপরে বয়ে চলছে ছোট ছোট নৌকা, ইয়ট, ক্রজিং ভ্যাসেল। তাতেও আলোকসজ্জা। দেখে মনে হয় রঙিন এক নদী। বর্ণিল এই নদী মনের গভীরে গিয়ে অন্যরকমের এক আবহের জন্ম দিচ্ছিল।
মোহনা থেকে ফিরতি পথ ধরেছে আমাদের জাহাজ। যেখান থেকে আমাদের তোলা হয়েছিল সেই জেটিতে এনে আমাদের নামিয়ে দেয়া হবে। ভয়েজ সম্পন্ন করতে দুই ঘন্টার মতো সময় পার করে দিতে হয়েছে আমাদের। তবে সত্যি বলতে কী, কোনদিক দিয়ে যে এই দুইঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে তা টের পাইনি। একটুও বোর হইনি। নানা দেশের পর্যটকে গিজগিজ করছে বোট। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নেয়া হয়েছে কিনা কে জানে! চীনারাও কী আমাদের মতো ধারণক্ষমতার ধার না ধারার শিক্ষা রপ্ত করেছে! জাহাজ ফিরতি পথে থাকলেও ব্যুফে খাওয়া দাওয়া চলছিল। খাবার সরবরাহ বন্ধ করা হয়নি। গরম গরম কিছু খাবারও এনে দেয়া হলো। নিশ্চয় জাহাজটিতেই রান্নাবান্না হচ্ছে। বিশ্বের নানা দেশের নানা জাতের মানুষ। সাদা কালো বাদামী তামাটে। অথচ সবাই একই ডিস থেকে নিয়ে একই খাবার খাচ্ছে। কী অপূর্ব এক বৈশ্বিক ডিনার!
সবকিছু খেতে না পারলেও বা না খেলেও একথা স্বীকার করতে হবে যে, ক্রজিং ভ্যাসেলের ব্যুফে খাবারটি দারুণ ছিল। নাইট ক্রুজে এসে এত ভালো খাবার দাবার পাওয়া যাবে তা আমার ধারণাতে ছিল না। রাতের খাবার বেশ জমকালোভাবেই শেষ করলাম আমরা। নাচে, গানে, নৃত্যে এবং যাদুতে স্নিগ্ধ রাতটি আরো মোহনীয় হয়ে উঠলো। আলোকোজ্জ্বল পার্ল রিভারের দু’পাড়ে উন্নয়নের জয়যাত্রা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। আমার ভিতরের কষ্টও মাথাছাড়া দিচ্ছিল।
জেটিতে এসে নোঙর করলো জাহাজ। যাত্রীদের রয়ে সয়ে নামার অনুরোধ করা হলো। কিছুটা হুড়োহুড়ি হলেও আমরা সবাই নিরাপদে জাহাজ থেকে নেমে আসলাম। জেটিতেও প্রচুর মানুুষ। তারা অপেক্ষা করছিল জাহাজের জন্য। এই জাহাজ আবার যাত্রা করবে। আবারো একইভাবে সব আয়োজন শুরু হবে। প্রতি ট্রিপে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে। সন্ধ্যা থেকে এক একটি জাহাজ তিন চার ভয়েজ সম্পন্ন করে! রাত যত বাড়ে যাত্রী সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পায়, বাড়ে টিকেটের দামও। খোলা আকাশের নিচে জাহাজে বসে মজাদার খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি পানীয়ের উৎসব ভিন্ন আমেজ তৈরি করে। অবশ্য সব খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা জাহাজেই করতে হয়, বাইরের কোন খাবার কিংবা পানীয় জাহাজে নিতে দেয় না। ব্যুফে খাবারে সব কিছু দেয়া হলেও হার্ড ড্রিংকস দেয়না। সেটি জাহাজেই চড়াদামে কিনতে হয়। ফুরফুরে মেজাজের অনেকেই মদ বিয়ারে মজে নিজেদের মতো করে মজা লুটছিলেন।
জাহাজ থেকে নামার পর কায়সার ভাই এবং জুবায়ের বললেন, এখনি বাসায় যাবেন নাকি আরো একটু ঘুরবেন? ঘুরার জন্য সবসময় এক পা এগিয়ে থাকি আমি। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, এখানে ঘুরে ফিরে দেখার আরো কিছু আছে নাকি? কায়সার ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, কী বলেন! কোথায় বেড়াতে এসেছেন বুঝতে পারেননি মনে হয়। এটি চীন। চীনের অন্যতম শহর এই গুয়াংজু। এখানে পদে পদে বেড়ানোর জায়গা। কয়েক হাজার বছরের একটি শহর এটি। এখানে বেড়ানোর জায়গার অভাব আছে নাকি?
আমি শুধু হাসলাম। কায়সার বললেন, তাহলে ফোন করে স্যারকে বলে দেন যে আপনার ফিরতে দেরি হবে। ‘স্যার’ মানে ইউছুপ আলী ভাই। আমার অতিপ্রিয় একজন বন্ধু। যিনি আজ আমার সাথে পার্ল রিভারে বেড়ানোর জন্য টিকেট করলেও অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। অফিসের কর্মকর্তাদের আমার সাথে দিয়েছেন। আমার বেড়ানোর যাতে কোন সমস্যা না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কায়সার ভাই এবং জোবায়েরকে।
আমি ফোন করে ডিনার শেষ করার কথা বললাম। বললাম ফিরতে একটু দেরি হবে। আপনারা খেয়ে শুয়ে পড়েন। সকালে দেখা হবে। ইউছুপ আলী ভাই মনে হয় খুশী হলেন। কায়সার ভাইকে ফোনে কি কি সব নির্দেশনাও দিলেন।
পার্ল রিভারের পারেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো একটি টাওয়ার। এটিই নাকি ক্যান্টন টাওয়ার। আমরা যখন টাওয়ারের কাছে পৌঁছলাম তখন সেখানে আলোর ঝলকানি চলছিল। কত ধরনের আলোর খেলা যে টাওয়ার জুড়ে চলে তা চোখে না দেখলে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়।
ক্যান্টন টাওয়ার আসলে একটি ভবন। এটি চীনের অন্যতম সুউচ্চ একটি টাওয়ার। একসময় পৃথিবীর উঁচু ভবনগুলোর তালিকায় এই টাওয়ারের নাম থাকলেও ক্রমে তা পেছনের দিকে সরে এসেছে। তবে এর জৌলুশ যেন কেবলই বেড়েছে। চোখ ধাঁধানো এক অপরূপ টাওয়ারকে চোখের সামনে দেখে আমার ভিতরে অন্যরকমের অনুভূতি খেলা করতে থাকে।
বিশাল উচু টাওয়ারটির উচ্চতা ৬০৪ মিটার বা ১৯৮১ ফুট। এটিতে ৩৭ টি ফ্লোর রয়েছে। বিভিন্ন ফ্লোরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, জিম, বিভিন্ন ধরনের রাইডসহ নানা কিছু। ২০১০ সাল থেকে টাওয়ারটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। টাওয়ারের উপর রয়েছে একটি অবজারভেশন ডেক। যেখান থেকে গুয়াংজুর নানা কিছু বেশ স্বাচ্ছন্দে অবলোকন করা যায়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই টাওয়ারে চড়ে দূরের সৌন্দর্য উপভোগ করে।
ক্যান্টন টাওয়ারের সৌন্দর্য রাতে। রাতে যেন রূপের পসরা সাজায় টাওয়ার। পুরো টাওয়ারটি একটি যাদুর বাক্সে পরিণত হয়। কত ধরনের আলো যে এই টাওয়ারে খেলা করে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এই দেখলেন পুরো টাওয়ার লাল, চোখের পলক ফেলতে পুরো টাওয়ার বেগুনী। আবার এই দেখলেন নীল, একটু পরেই হয়ে গেল হলুদ। লাল নীল হলুদ বেগুনী মিলে রঙের কী এক বাহার যে টাওয়ারের অঙ্গে খেলা করে! প্রতিক্ষণে মনে হয় নতুন কোন টাওয়ার দেখছি। আরে এটিতো আগেরটি নয়, এ তো অন্যকেউ! ক্ষণে ক্ষণে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া, নয়ন ভরিয়ে দেয়া টাওয়ারটি আমাদের মতো অক্ষম মানুষের হৃদয়ে কেবলই ঝড় উঠায়! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, দূষণ নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ