দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হাঁটছিলাম আমরা। আয়েশি হাঁটা। গাছগাছালীর ছায়া মাড়িয়ে, ঘরদোরের পাশ দিয়ে, শিল্পকর্মের গা ঘেঁষে হাঁটছিলাম। অনুভব করছিলাম প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে। চোখে সাতরাজ্যের বিস্ময় এবং অন্তরজুড়ে ভালোলাগা নিয়ে ঘুরছিলাম শান্তিনিকেতনের পথ থেকে পথে। কোথাও থেকে হারমোনিয়ামের সুর ভেসে আসছিল।
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে’।
গান কোথায় হচ্ছে? জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালাম গাইডের দিকে। তিনি বুঝতে পারলেন। বললেন, চলুন নিয়ে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা গিয়ে হাজির হলাম গাছগাছালী ঘেরা ছোট্ট একটি মাঠে। প্রচুর বড় বড় গাছ জায়গাটিতে। একটি গাছের ছায়ায় বসে বাউল টাইপের একজন মানুষ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাচ্ছিলেন। একজন বাজাচ্ছিলেন তবলা। গেরুয়া রঙের কাপড় পরিহিত শিল্পী আপনমনে গেয়ে চলছিলেন।
‘আছে সে নয়নতারায়
আলোক ধারায় তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক পানে’।
শিল্পী মাদুর পেতে বসেছেন ঘাষের উপর। কোন দিকে তাঁর খেয়াল নেই। তিনি গেয়ে চলেছেন,
‘কে তোরা খুজিস তারে
কাঙ্গাল বেশে দারে দারে।
দেখা মেলে না মেলে না
তোরা আয়রে দেয়ে দেখরে চেয়ে
আমার বুকে ওরে দেখরে আমার দুই নয়নে’।
শিল্পীকে ঘিরে ঘিরে বেশ কয়েকজন মানুষ। নারী পুরুষ। তারাও ঘাষের উপর গোল হয়ে বসে গান শুনছেন। কেউ কেউ শিল্পীর হারমোনিয়ামের উপর বিভিন্নমানের মুদ্রার নোট দিচ্ছিলেন। আমিও রাখলাম। রবীন্দ্রসংগীতের বেশ পুরানো ভক্ত আমি। পাগল টাইপের ভক্ত। রবি ঠাকুরের গানের মতো আর কোন গানই আমাকে টানে না। এত বেশি টানে যে, মাঝে মধ্যে নাওয়া খাওয়া ভুলেও আমি গান শুনি, সময় কাটাই। এমনও সময় ছিল যখন কানের কাছে রবি ঠাকুরের গান না বাজলে আমার ঘুমই আসতো না। নিদ্রাদেবীকে বশে আনতে বহু বহু রাত আমি রবি দাদুর শরণাপন্ন হতাম।
সেই আমি যখন এমন উদোম মাঠে, খোলা আকাশের নিচে গাছের ছায়ায় রবি ঠাকুরের গান শুনার সুযোগ পেলাম তখন আমাকে আর আটকায় কে! ঘাসের উপরই বসে পড়লাম। শিল্পীর মুখোমুখি। আমার দেখাদেখি প্রিয়তমা স্ত্রী এবং গাইডও বসে পড়লেন। একটির পর একটি গান গাচ্ছিলেন শিল্পী। শ্রোতাদের অনুরোধের গানও। তিনি গেয়ে চলছিলেন।
‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’ ‘আমি কান পেতে রই’ ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ ‘জীবনে আমার যত আনন্দ’ ‘বড় আশা করে এসেছি গো’ ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ সহ অসংখ্য গান শুনলাম। প্রেমের গান, বিরহের গান, প্রার্থনার গান, বর্ষার গানসহ নানা গান তিনি শুনালেন আমাদের।
গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর বসে পরম তৃপ্তিতে গান শুনছিলাম। অন্যরকমের ভাবগম্ভীর এক পরিবেশ। অনেক মানুষ আমরা। অচিন সব মানুষ। নানা দেশের মানুষ। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছিলাম না। নিখাদ রবীন্দ্রপ্রেমিকের মতো প্রতিটি মানুষই গান শুনছিলেন। কেউ কেউ চোখ বুজে গানের মর্মার্থ অনুভবের চেষ্টা করছিলেন। চারপাশের পরিবেশ এত মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল রবি ঠাকুর বুঝি পাশে বসে আছেন!
গাইড বললেন, এবার না উঠতে হবে। নাহয় অনেক কিছু মিস করে ফেলবেন। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমারও মনে হলো ফিরতে হবে। তবে পরের বার কোন এক জ্যোৎন্সা রাতে শান্তিনিকেতনে থাকার মনস্থির করলাম। রাতভর কোথাও বসে গান শুনবো। দরকার হলে এমন একজন বাউল শিল্পীকে অনুরোধ করে পুরো রাত জাগিয়ে রাখবো। সম্ভব কিনা জানি না, কোনদিন আর শান্তিনিকেতনে আসা হবে কিনা তাও জানি না, তবুও আমি মনে মনে সুন্দর একটি স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম।
আমরা উঠলাম। হাত নেড়ে বিদায় নিলাম শিল্পীর কাছ থেকে। কিন্তু উনার কোন ভাবান্তর নেই। তিনি গেয়ে চলছিলেন, ‘আমার পরান যাহা চাই’ ।
আমরা ছাতিমতলার পাশ দিয়ে সামনে এগুলাম। এই ছাতিমতলা শান্তিনিকেতনের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিন রায়পুরের জমিদার ভূবন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে রাত হয়ে যায়। তখন তিনি মাঠের মাঝখানে এই স্থানটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ওই রাতে ছিল ভর জ্যোৎন্সা। জায়গাটিতে বেশ কয়েকটি ছাতিম গাছ ছিল। জ্যোৎন্সার আলোয় ছাতিম গাছের তলায় বসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর ভরে উঠেছিল শান্তিতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে মনে আওড়ান, ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’। জায়গা উনার এতোই ভালো লেগে যান যে, কলকাতা শহরে দারুণ বাড়িঘরসহ বিশাল সহায় সম্পত্তি থাকলেও তিনি ওই জায়গাটি জমিদারের কাছ থেকে কিনে নেন। অবশ্য এই কেনা নিয়েও আলাদা গল্প রয়েছে। জমিদার টাকা নেবেন না, উনি না দিয়ে ছাড়বেন না। অবশেষে ৫ টাকায় (অবশ্য কেউ কেউ বলেন এক টাকায়) বিশ বিঘা জমি কিনেছিলেন তিনি। পুরানো সেই ছাতিম গাছগুলো মরে গেছে। ঠিক একই জায়গাই নতুন করে দুইটি ছাতিম গাছ লাগানো হয়। যেগুলো এখন বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে, অনেক ঢালা পালা। অবশ্য ছাতিমতলা জায়গাটি ঘিরে রাখা হয়েছে। দক্ষিন পাশের গেটে বেশ বড় বড় হরফে ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ কথাটি লিখে রাখা হয়েছে। ছাতিমতলা জায়গাটি অন্যরকমের নীরব, নিস্তব্দ। যেন অন্যরকমের শান্তি!
আমরা বকুলবীথি এলাকায়ও ঘুরলাম। অনেকগুলো বকুল গাছ রয়েছে স্থানটিতে! শান্তিনিকেতনের প্রথম বাড়ি ‘শান্তিনিকেতন’ও দেখলাম আমরা। রবি ঠাকুর ১২ বছর বয়সে এই বাড়িতে প্রথম এসেছিলেন। পরবর্তীতে এখানেই তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ছাতিমতলার পেছনে উপাসনা গৃহ। সেটিও বেশ দেখার মতো একটি সুন্দর স্থাপনা। দেহলি নামের একটি বাড়িতে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বসবাস করতেন ঠাকুর। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে ওই বাড়িতে ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কবি নোবেল পাওয়ার পর যেখানে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল সেই বিখ্যাত আম্রকুঞ্জও ঘুরে দেখলাম আমরা। বর্ধমানের মহারাজ মহতাব চাঁদ তাঁর মালি রামদাসকে দিয়ে এই বাগানটি তৈরি করেছিলেন। এই আম্রকুঞ্জে ছাত্রদের ক্লাসও হয়। তবে আমরা যখন শান্তিনিকেতনে ঘুরছি তখন ছুটি থাকায় কোন ক্লাস দেখতে পাইনি। পৌষমেলা শান্তিনিকেতনের অনেক বড় একটি উৎসব। টানা কয়েকদিন ধরে চলে। মেলা উপলক্ষে নাকি বহু আয়োজন থাকে। গাইড আমাদেরকে পৌষমেলার নানা বর্ণনা দিয়ে কোন এক পৌষমেলায় সামিল হওয়ারও দাওয়াত দিলেন।
আমরা শান্তিনিকেতনের পরতে পরতে শান্তি খুঁজছিলাম। মনের শান্তি। রবি ঠাকুরের সবকিছু এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমাদেরকে অন্যরকমের শান্তি দিচ্ছিল। আমরা কলাভবন, কালোবাড়ি, তিনপাহাড়, সংগীতভবন, শালবীথি, ঘন্টাতলা, সন্তোষালয়, সিংহসদন, পূর্ব ও পশ্চিম তোরণ, চৈত্য, দিনান্তিকাসহ কত কিছু যে দেখলাম! শুধু কি ভবন! শান্তিনিকেতনে ছায়াঢাকা পরিবেশে রয়েছে অসংখ্য শিল্পকর্ম। যেগুলোর কোন কোনটি রবি ঠাকুরের নিজের হাতে গড়া, কোনটিবা নন্দলাল বসু আবার কোনটি রামকিঙ্কর বেইজ তৈরি করেছেন। কত ধরনের শিল্পকর্ম শান্তিনিকেতনে রয়েছে!
আমরা হাঁটছিলাম। ভুবনডাঙ্গা থেকে শান্তিনিকেতন হয়ে উঠা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য অনন্যসুন্দর নানাকিছু দেখতে দেখতে আমাদের অন্তরও শান্তিতে ভরে উঠছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাবলেই শিহরিত হই
পরবর্তী নিবন্ধজেলহত্যা দিবস আজ