(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একে একে আমাদের পাঁচটি গাড়িই পৌঁছে গেল। ট্রলিতে লাগেজ নিয়ে আমরা বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। সদলবলে প্রবেশ বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই করলাম আমরা। এগার জনের ছোটখাটো একটি দল, যেনো একটি কাফেলা। দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। হাজার হাজার যাত্রী কিলবিল করছে। বাংলাদেশে বাস বা রেলওয়ে স্টেশনেও এত যাত্রী দেখা যায় না। ডোমেস্টিক টার্মিনালে এত যাত্রী!! চমকে উঠারই কথা। ভারতের প্রতিটি বিমানবন্দরেই যাত্রী এভাবেই কিলবিল করে। আন্তর্জাতিক নানা গন্তব্যের পাশাপাশি বিশাল দেশটির বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হরদম বিমান উড়ছে। একই সাথে নানা স্থান থেকে এসে নামছেও। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যাত্রীরা এখানে নেই। তারা অন্য ফ্লোরে। এটা শুধু যাওয়ার যাত্রীতেই ঠাসা!
ভারতে প্রচুর যাত্রী এয়ার ট্রাভেল করে। ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকরি বাকরির জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই দেশের অভ্যন্তরে নানা গন্তব্যে ছুটেন। বিপুল জনসংখ্যার বিশাল দেশ। কাজেরও অভাব নেই, অভাব নেই যাত্রীর। গন্তব্যেরও বুঝি কমতি নেই। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ফ্লাইট অপারেটর অতি সস্তায় টিকেট বিক্রি করে। দিল্লী থেকে কলকাতার ফ্লাই টাইম দুই ঘণ্টার বেশি হলেও হাজার তিনেক রুপিতে টিকেট পাওয়া যায়। যাত্রার দিনকয়েক আগে টিকেট কিনলে বেশ সস্তায় জুটে ভারতের বিভিন্ন ফ্লাইটের টিকেট। অথচ ঢাকা চট্টগ্রামে মাত্র আধা ঘণ্টার ফ্লাই টাইমে আমাদেরকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় টিকেট করতে হয়। প্রায়শ এই টিকেটের দাম পাঁচ ছয় হাজার টাকায় গিয়েও ঠেকে।
ভারতে প্রচুর যাত্রী থাকায় কম দামে টিকেট দিতে পারে ফ্লাইট অপারেটরেরা, বাংলাদেশে যাত্রী কম থাকায় সস্তায় টিকেট বিক্রি করতে পারে না। যাত্রী কম বলে আমাদের টিকেটের দাম চড়া, আবার টিকেটের দাম চড়া বলেই আমাদের যাত্রী কম। যাত্রী বাড়লে টিকেটের দাম কমবে, আবার টিকেটের দাম কমলে যাত্রী বাড়বে। এই এক দুষ্টু চক্র। এই চক্র থেকে বের হওয়া আমাদের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অপারেটরদের জন্য কঠিন, কঠিন আমাদের যাত্রীদের জন্যও। আহা, এই দুষ্টু চক্রে পড়ে দেশে গত এক যুগে কতগুলো বেসরকারি ফ্লাইট অপারেটর লালবাতি জ্বালালো! ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা খেলাপি করে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে অপারেটর। পুঁজিবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েও কেটে পড়েছে রাঘব বোয়ালদের কেউ কেউ। যাত্রী সংকটে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা বিমানবন্দরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বহু এয়ারক্রাফট। শত শত কোটি টাকা দামের এসব উড়োজাহাজ নাকি কেজি দরে লোহা হিসেবে বিক্রি হবে! আহারে দেশের সম্পদ, আহারে জনগণের টাকা!
আমরা দিল্লী থেকে কলকাতা যাচ্ছি। অভ্যন্তরীণ রুট। এতে ইমিগ্রেশনের কোন ঝামেলা নেই। তবে লাগেজ বুকিং দিয়ে সিট নেয়ার চেকইন করার ঝামেলা রয়ে গেছে। যাত্রীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় চেক-ইনের লাইনও বেশ দীর্ঘ। বিভিন্্ন ফ্লাইট অপারেটরের বুথের সামনে যাত্রীদের সারি কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। আমরা নির্দিষ্ট বুথে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। ধীরলয়ে এগুচ্ছিল লাইন। এগার জনের ছোটখাটো একটি গ্রুপ আমাদের। গ্রুপ চেক-ইন করতে পারলে অনেক ঝামেলা কমে যেত। তাই কাকে ধরলে সুযোগটি পাওয়া যায় তা মনে মনে হাতড়াচ্ছিলাম। আমার চোখ পড়লো অনন্য সুন্দরী এক তরুণীর উপর। বব কাট চুলের সাথে পোশাক আশাক মিলে চোখে লাগার মতো স্মার্ট। গলায় স্পাই জেডের আইডি কার্ড। যাত্রীদের দেখভাল করছিলেন। কিছু কিছু নির্দেশনাও মনে হয় একে ওকে দিচ্ছিলেন। তরুণী স্পাই জেডের স্টেশন ম্যানেজার না হলেও বড় কোন কর্মকর্তা হবেন বলেও মনে হলো আমার। আমি আস্তে করে লাইন থেকে বেরিয়ে গেলাম। সামনে পেছনে আমাদের লোক থাকায় লাইন ছাড়লেও কোন সমস্যা হবে বলে মনে হলো না। কারণ তরুণীকে ঠিকঠাকভাবে ম্যানেজ করতে না পারলে ফিরে এসে লাইনের মাঝখানে ঢুকে গেলেই হবে। ততক্ষণে লাইন যতটুক এগুবে সেটিই বরং লাভ।
আমি তরুণীর কাছে গিয়ে ‘হাই’ বলে উইশ করলাম। বেশ মন ছোঁয়া হাসিতে তরুণীও উইশ করলেন। নিজেদের ট্যুরিস্ট পরিচয় দিয়ে নারী এবং সিনিয়র সিটিজেনসহ এগারজনের একটি গ্রুপ থাকার কথা জানালাম। কলকাতার জন্য একই সাথে গ্রুপ চেক-ইন করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা জানতে চাইলাম। ‘ অফকোর্স’ বলে তরুণী সবাইকে নিয়ে এক পাশে সরে আসার অনুরোধ করে বললেন, সবার পাসপোর্ট দিন। তিনি নিজে একটি ডেস্কে গিয়ে উঠলেন এবং ওই ডেস্কে যিনি কাজ করছিলেন তাকে কি কি সব নির্দেশনা দিলেন।
আমি আমাদের গ্রুপের সবাইকে লাইন থেকে বেরিয়ে একপাশে সরে যেতে বললাম। সবার পাসপোর্ট নিয়ে তরুণীর হাতে দিলাম। অনলাইন টিকেটিং সিস্টেমে চেক-ইন করতে শুধু পাসপোর্ট দিলেই হয়, টিকেটের দরকার হয় না। আমাদের লাগেজগুলো সব একসাথে তুলে নেয়া হলো। এতে করে ওজন সমস্যারও সমাধান হয়ে গেল। কারো লাগেজের ওজন বেশি, কারো লাগেজের কম নিয়ে আর কোন সমস্যা হলো না। সবার লাগেজই একসাথে ওজন দিয়ে গড় হিসেব করা হলো। নির্ধারিত ওজনের দু’চার কেজি বেশি হলেও এই ধরনের গ্রুপ চেক-ইনে তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানো হয় না। তরুণী বেশ আন্তরিকতার সাথে আমাদের চেক-ইন করে দিলেন। আমার হাতে এগারটি বোর্ডিং কার্ড তুলে দিয়ে আবারো মন ছোঁয়া একটি হাসি দিলেন। আমি বেশ আন্তরিকভাবে তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
লাগেজ বুকিং দিয়ে দেয়ার পর শুধু কেবিন ব্যাগটি নিয়ে সামনে এগুলাম আমরা। আমাদের আর তেমন কোন কাজ নেই। সিকিউরিটি চেক সম্পন্ন করে ফ্লাইটে তোলা হবে আমাদের। অবশ্য বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখেও আমাদেরকে একবার চেক করা হয়েছে। বডি স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে পার হয়েছি আমরা। আমাদের লাগেজগুলোকেও স্কেনিং করা হয়েছে। সিকিউরিটি চেকের নামে আমাদের জুতা মোজা থেকে কোমরের বেল্ট, পকেটের মানিব্যাগ থেকে শুরু করে সবকিছুই তন্নতন্ন করে চেক করা হয়েছে। যাত্রীদের স্বার্থেই কাজটি করা হলেও এয়ার ট্রাভেলে সিকিউরিটি চেকের পুরো ব্যাপারটিকে একটি উটকো ঝামেলার মতো মনে হয়, বিরক্ত লাগে।
আমাদের সবকিছু সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু ফ্লাইটে উঠার অপেক্ষা। আমরা ওয়েটিং লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। খুব কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বিদেশে বেড়াতে গেলেই কফির নেশা পেয়ে বসে আমাকে। রাতে দিনে চলে কফি। সকালের নাস্তার পর থেকে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কত কাপ কফি যে খায় তার কোন ইয়ত্তা থাকে না। বিষয়টি আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বেশ খেয়াল করেন। তিনি সুযোগ পেলেই আমাকে কফি খাবো কিনা জানতে চান। একই সাথে স্যারও কফিতে চুমুক দেন। অলস এই সময়টাতে আমি কফি খাবো কিনা জানতে চাইলেন স্যার। আমি কিছু বলার আগে কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া দাদা কফি খাবেন বলে দাঁড়িয়ে গেলেন। সাথে দলের সকলেই কমবেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। লাউঞ্জের এক পাশেই বেশ কয়েকটি দোকান। কফিও রয়েছে। এডিটর স্যার আমাদের প্রত্যেকের জন্য কফির অর্ডার দিলেন।এক একটি কফির দাম শুনে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার দশা। অবশ্য আমার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার কোন কারণ নেই, এই ধরনের সব ট্রাভেলেই এডিটর স্যারই পেমেন্ট করেন। জোর করে করেন। এবারের সফরে এডিটর স্যার এবং লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া বিভিন্ন খরচের বিল পরিশোধ নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করেন! মনজু ভাই মাঝেমধ্যে দুজনইকে টক্কর মারেন। আমি ছোট হিসেবে সবকিছু থেকে দূরে থাকি। অবশ্য এভাবে দূরে থাকার ফলে প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রায়শ বকা শুনি।
আমাদের ফ্লাইটের বোর্ডিং শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলো। নির্দিষ্ট গেট নম্বর উল্লেখ করে যাত্রীদের বোর্ডিং করে নেয়ারও অনুরোধ করা হলো। বোর্ডিং এর জন্য গেট খোলার সাথে সাথে কিছু মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, যেন তাকে ছেড়েই উড়াল দিচ্ছে ফ্লাইট। আমি কখনো তেমন হুড়োহুড়ি করিনা, করার দরকারও হয়না। অবশ্য এজন্য মাঝে মধ্যে ভোগান্তিতেও পড়তে হয়। বিমানের সিটে গিয়ে দেখি কেবিন ব্যাগ রাখার জায়গা নেই, আমার মাথার উপর অন্যজনে ব্যাগ রেখে দিব্যি নিজের আসনে গিয়ে বসে আছে। আমাকে এদিক ওদিক খুঁজতে হয়। অনেক সময় কেবিন ক্রু’কে দিয়ে দিতে হয়। আমাদের এগারজনকেই একই সাথে সিট দেয়া হয়েছে। দুই রো’তে আমাদের সবার সিট হয়ে গেছে। আমি আইল সিটে বসেছি, স্ত্রীকে উইন্ডো সাইটে। বিমানযাত্রার ঝক্কি অনেক। মাঝে মধ্যে মনে হয় ট্রাকে ড্রাইভারের সাথে বসে আছি। কোন কোন এয়ারক্রাফটের সিটগুলো এত চাপিয়ে দেয়া যে আমাদের মতো একটু স্বাস্থ্যবান মানুষের (মোটা লিখলাম না) পক্ষে একটু ধাতস্থ হয়ে বসা কঠিন। বিশেষ করে আসন সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কোন কোন অপারেটর এমনটি করে থাকে। যাতে টিকেটের দাম কমাতে পারে। স্পাই জেডের এই ফ্লাইটটিতেও একবারে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে সিটগুলো বসানো হয়েছে। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। দুই ঘন্টারও বেশি সময় কয়েদির মতো বসে থাকতে হবে ভাবতে গিয়েই আমার পরাণটি কুচকে যেতে শুরু করলো। স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে আমি কিছুটা প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা এবং ফ্লাইটের আকাশে উড়াল দেয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।