(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বেশ রাত অব্দি আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরেছিলাম আমরা। জমজমাট আড্ডায় কত কিছু নিয়ে যে আলোচনা হয়! এই ধরনের আড্ডাগুলোতে আমাদের মতো মানুষের অনেক কিছু শেখার থাকে, শেখা যায়। তাই অধিকাংশ সময়ই চুপচাপ থেকে শুধু শুনে যাই। মাঝে মধ্যে নিজেও যোগ দিই। দুয়েকটি প্রশ্ন ট্রশ্নও করি। পুরো পৃথিবী চষে বেড়ানো গুণী মানুষগুলোর কাছ থেকে নানা বিষয়ে জেনে নিই, নিজের কৌতুহল মেটাই। লায়ন্স ক্লাবের ট্যুরগুলোতে এ ধরণের আড্ডা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে থাকে। শুধু স্থানই নয়, লোভনীয় স্থান। প্রতিটি প্রোগ্রামেই হোটেলের লবিতেই এমনতর আড্ডা চলে। রাতের তিনটা পর্যন্ত আড্ডা দেয়ার রেকর্ডও রয়েছে। দুবাইর নভোটেল হোটেলের লবিতে এমনতর এক আড্ডা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে রয়েছে। বর্ণিল সেই মুহূর্ত আমাকে চমকিত করে, করে পুলকিত। আমার বিবর্ণ সময়গুলোকে এই স্মৃতি এখনো রাঙ্গিয়ে দেয়, মুগ্ধ করে। জীবনে কোনদিন নিজের জন্মদিন পালন করিনি। তবে ওই বছর ফাইভ স্টার হোটেলে কেক কেটে উদযাপিত হয়েছিল আমার জন্মদিন। আমার স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, ম্যাডাম কামরুন মালেক, লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া, লায়ন নাসিরউদ্দিন চৌধুরীসহ গুণী সব মানবিক মানুষগুলোর হাতে হাত রেখে আমি কেক কেটেছিলাম। ওদিনও এমনতর আড্ডা চলছিল হোটেলের লবিতে। রাত বারোটার পরে কেউ একজন আমার জন্মদিনের কথাটি আড্ডায় জানিয়ে দিলেন। সম্ভবত ফেসবুক নোটিফিকেশনে তিনি বিষয়টি জেনেছিলেন। আর তিনি বলার সাথে সাথে আড্ডাজুড়ে কেমনতর একটি রৈ রৈ পড়ে গেলো। সেই মাঝরাতেই হোটেল নভোটেল থেকেই কেক যোগাড় করা হলো। দারুণ একটি ফ্রুট কেক। চেরি বসানো সেই কেকটি আজো চোখে ভাসছে। অতপর কাটাকুটি এবং উৎসব! আহা, কি যে আনন্দ হয়েছিল জীবনের প্রথম জন্মদিন পালনের উৎসবে!
দিল্লীতে অবশ্য এমন কোন উৎসবের উপলক্ষ নেই। আমরা শুধু শুধু আড্ডা মারছি। আড্ডার বিষয়গুলোর মধ্যে লায়নিজম থেকে শুরু করে শপিং পর্যন্ত সবই রয়েছে। রয়েছে বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমনের গল্পও। নানা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন আমার এডিটর স্যার এম এ মালেক এবং লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া। লায়ন মনজুর আলম মনজুও বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন। আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক বা সুপ্রভা বৌদিও যোগ দিচ্ছিলেন নানা বিষয়ে। শপিং এর অভিজ্ঞতায় একেবারে টুইটুম্বর লায়ন রাশু মনজুর এবং লায়ন নিশাত ইমরান। অবশ্য এখন এমনভাবে আলোচনা শুরু হলো যেন আমরা স্বামী স্ত্রীই শপিং এর রাজা রাণী। আজ আমরা কি কি শপিং করেছি তা জানতে চাওয়া হলো। তা নিয়ে আলোচনাও হলো। চাঁদনী চৌক মার্কেটের ভিড়ভাট্টা নিয়েও গল্প হলো। দিল্লীর অতি জনপ্রিয় এই মার্কেটের আদি ইতিহাস নিয়েও গল্পটল্প করলাম আমরা।
আমি এডিটর স্যারকে ফোন করলাম। মনে হয় তিনি আমার ফোনেরই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘বল।’ আহারে, নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম। নিশ্চয় স্যার ম্যাডাম অনেক আগেই জেগেছেন। আমাদের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছেন। নাস্তার কথা বলতেই বললেন, ‘সবাইকে ডেকে নাও। আমরা আসছি।’ আমি সবাইকে ফোন দিলাম। শুধু মনজুর আলম মনজু ছাড়া আর সবাই মনে হলো ফোনের অপেক্ষা করছিলেন। মনজু ভাই ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললেন, আপনারা যান, আমরা আসছি। মনে হয় আমার ফোনেই বেচারার ঘুম ভেঙ্গেছে।
নাস্তার পর্ব শেষ করার আগেই ফোন পেলাম। আমার চালক হাজির। তিনি জানালেন, হোটেলের পার্কিং এ আছেন। আমি ফোন করলে লবিতে চলে আসবেন। তিনি আমরা কি সরাসরি এয়ারপোর্ট যাবো, নাকি আগে কোথাও ঘুরতে বা কিছু কিনতে যাবো জানতে চাইলেন। বেশ খোশ মেজাজে আছেন বলে মনে হলো। গতকাল টিপস না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে টিপস দিয়ে দিলেও সমস্যা ছিল না। তিনি ঠিকই আসতেন। পৃথিবীর সব মানুষ আসলে একরকম নন। বম্বের ড্রাইভার প্রতারণা করেছেন বলে দিল্লীর ড্রাইভারও একই কাজ করবেন এমনটি ভাবা আমার ঠিক হয়নি। হঠাৎ আমার মনে হলো, বম্বের ড্রাইভারকেও বা প্রতারক বলছি কেন। ওই ঝড়-বাদলের দিনে উনি হয়তো এমন কোন বিপদে পড়েছিলেন যে আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করার জন্য আসতে পারেননি। হয়তো এমন কোন বিপদে পড়েছিলেন যে, আমাকে ফোন করতেও পারেননি। লোকটি বেঁচে আছেন তো! বুকের ভিতরটাই কেমন যেন করে উঠলো! আসলে কিছু না জেনে মানুষকে বিচার করা ঠিক নয়। আমিও এতদিন ঠিক কাজ করিনি। আমি মনে মনে বম্বের ড্রাইভারকে ক্ষমা করে দিলাম এবং গতরাতে এই ড্রাইভারকে টিপস না দেয়ায় নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলাম। দুনিয়াতে আসলে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। দুচারজন নষ্ট মানুষই মানবসমাজকে কুলষিত করে, বিব্রত করে। আমাদের ড্রাইভারকে আজ বাড়তি টিপস দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিলাম মনে মনে। ড্রাইভারকে বললাম যে, ‘আপনি থাকেন, আমরা এখন কোথাও যাবো না। একবারেই এয়ারপোর্ট যাবো।’
রয়ে সয়ে নাস্তা সারলাম আমরা। নাস্তার পরে রেস্টুরেন্টে বসে গল্পগুজবও চললো। এই ফাঁকে আমি কফির সেকেন্ড রাউন্ডে চুমুক দিলাম। রাতের মতো না জমলেও সকালে নাস্তার টেবিলের আড্ডাও লায়ন্স ক্লাবের সদস্যদের একটি প্রিয় জিনিস। প্রতিদিনের প্রতিটি সকালই আমরা উপভোগ করি, নতুনভাবে আবিষ্কার করি।
আমরা কলকাতায় যাবো। ডোমেস্টিক ফ্লাইট। ফ্লাইট টাইমের ঘন্টা খানেক আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছলে হবে। তবে দিল্লীর রাস্তায় জ্যামের যেহেতু কোন মা বাপ নেই তাই কিছুটা সময় নিয়ে বের হওয়া ভালো বলেও মত দিলেন লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া। আমার এডিটর স্যারও তাতে সায় দিলেন। বললেন, ‘হোটেলে বসে থাকার চেয়ে এয়ারপোর্টে গিয়ে চক্কর মারলে ভালো হবে। বহু কিছু দেখার আছে।’ সিদ্ধান্ত হলো, আমরা বারোটা করে চেকআউট করবো। লবিতে চলে আসবো।
দিল্লী বিমানবন্দরের দিকে ছুটছে আমাদের গাড়ি। পাঁচটি পৃথক গাড়ির একটি বহর। একসাথে যাত্রা করেছি আমরা। তবে প্রায় ২০ কিলোমিটারের এই পথে আমরা যে একসাথে থাকতে পারবো না তা আমি নিশ্চিত ছিলাম। কেউ আগে চলে যাবেন, কেউবা পেছনে পড়ে যাবো। তবে বিমানবন্দরের তিন নম্বর টার্মিনালের গেটে আমরা পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করবো। তাছাড়া ফোন তো রয়েছে। দিল্লীর পালাম এলাকায় পালাম বিমানবন্দর। ২০০৯ সালে এটি ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে নামকরণ করা হয়।
একসময় ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর ছিল মুম্বাই। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে মুম্বাইকে টপকে যায় দিল্লী। এটিই এখন ভারতের প্রধান এবং সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর। বছরে সাত কোটিরও বেশি যাত্রী হ্যান্ডলিং করে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২০৩০ সালে এই বিমানবন্দরে দশ কোটি যাত্রী হ্যান্ডলিং-এর লক্ষ্য নিয়ে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তখন এই বিমানবন্দর চীন দক্ষিন কোরিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের আরো আরো কয়েকটি বিমানবন্দরকে টপকে যাবে। বর্তমানেও পৃথিবীর প্রথম ১০/১২টি বিমানবন্দরের মধ্যে এটির নাম রয়েছে। এশিয়ার ৬ষ্ঠ ব্যস্ত বিমানবন্দর এটি। এশিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর হচ্ছে সিংগাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। যথারীতি জ্যামও আছে। তবে ভয়াবহ রকমের কোন জ্যামে পড়লাম না আমরা। বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে এক দুই মিনিট করে আটকা পড়ছিলাম। কোথাও কোথাও এমনিতেই গাড়ির জটলা। তবে বিমানবন্দর সড়কটি বেশ প্রশস্ত এবং কড়া নজরদারিতে থাকায় আমরা ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলাম। অন্তত ধারণার চেয়ে আগে পৌঁছলাম বলেও আমার মনে হলো। তিন নম্বর টার্মিনালের গেটে আমাকে নামানো হলো। লাগেজে আমাকে হাত লাগাতে দিলেন না ড্রাইভার। তিনি সব নামিয়ে দিলেন। ট্রলি টেনে তাতে তুলেও দিলেন। বিদায় নেয়ার আগে আমি ড্রাইভারকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিলাম। তাকে বুকে নিয়ে টিপস হিসেবে কিছু রূপী পকেটে পুরে দিলাম। কত রূপী টিপস দিলাম তা না দেখেও তিনি বেশ খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। গত এক সপ্তাহ বেচারা আমাকে সময় দিয়েছেন। কোথাও গাইড হয়েছেন, কোথাও বন্ধু হয়েছেন। অতি আপনজনের মতো সবকিছু থেকে আগলে রেখে পথ থেকে পথে নিয়ে ঘুরেছেন। এমন স্বজনকে বিদায় দিতে বুঝি একটু বুকে নিতে হয়, আমিও নিলাম। আর এটিই যে রূপীর চেয়ে বড় টিপস হয়ে যাবে সেটি আমার ধারণাতেই ছিল না। কিন্তু তার চোখ বলে দিচ্ছে তিনি আমাদের ভালোবেসেছিলেন। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।












