(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগ্রা ফোর্টের হেথায় হোথায় ঘুরছিলাম আমরা। কত কিছু যে দেখছিলাম। কত যে আয়োজন ছিল রাজা-বাদশাহদের। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর সুখ যেন উপচে উপচে পড়তো। কোন কিছুরই যেন অভাব ছিল না। ছিল না ভোগবিলাসের অন্তও। সীমিত প্রযুক্তির ওই সময়টাতেও জীবনকে উপভোগের কত আয়োজন যে তাঁদের ছিল তা ভাবতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে! এত কিছু কি করে সম্ভব ছিল! আমরা ফোর্টের নানা স্থাপনা ঘুরে ফিরে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কখনো বা বিস্ময়ে বড় হচ্ছিল চোখ। আমরা নিজেদের মতো করে দেখছি। গাইড আমাদের যেখানে যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে সেখানে আমরা অনায়াসে ঘুরছি। কোথাও কেউ কিছু বলছিলেন না, বাধাও দিচ্ছিলেন না কেউ। আমাদের মতো আরো শত শত মানুষ ফোর্টে ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। নিজেদের মতো করে কেউ কেউ বসেও আছেন। সম্রাটের বাসভবন কিংবা রাণীর বেডরুম কোন কিছুই যেন অধরা ছিল না। সবই অবলীলায় স্পর্শ করছিলাম। আহা, এসব স্থানের ধারে কাছেও সাধারণ মানুষ ভিড়তে পারেনি একদিন, আজ আমার মতো অতি সাধারণ মানুষও কত অবলীলায় ঘুরছি, ধরছি, স্পর্শ করছি। সম্রাটের বেডরুম থেকে ওয়াশরুম পর্যন্ত সবই যেন সাধারণ মানুষের সম্পদে পরিণত হয়েছে! সবই বুঝি একদিন এমন হয়ে যায়, সবই বুঝি একদিন জৌলুশ হারায়!
গাইড আমাদেরকে কিছুটা তাড়া দিয়ে বললেন, একটু তাড়া করতে হবে। ফতেহপুর সিক্রি কিন্তু বেশ দূরে। ওখানে যেতে হলে এখানে আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি করতে হবে। না হয় আজ দেখতে পাবেন না। আমার মনে হলো আগ্রা ফোর্টের ভিতরে বাইরে অনেককিছুই আমরা দেখেছি। যতটুকু দেখা দরকার তা হয়তো হয়নি, মন ভরে আগ্রা ফোর্ট দেখতে হলে এক সপ্তাহেও হবে না। সুতরাং এখানে আর অপেক্ষা না করে আমরা দ্রুত সামনের দিকে পা চালালাম।
আমরা যখন ফতেহপুর সিক্রির গেটে পৌঁছলাম তখন বেলা গড়াতে শুরু করেছে। আগ্রা থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে ফতেহপুর সিক্রি। এটি সম্রাট আকবরের স্মৃতিধণ্য একটি শহর। সম্রাট আকবর শহরটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী বানিয়েছিলেন। ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ সাল পর্যন্ত ফতেহপুর সিক্রি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। পরবর্তীতে পাঞ্জাবের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফতেহপুর সিক্রির রাজধানী বাতিল করে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র ১৪ বছরে একটি রাজধানীর জৌলুশ কি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ১ কিলোমিটার প্রস্থের প্রাসাদ এবং শহরটিকে ছয় কিলোমিটারের একটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে নেয়া হয়েছিল। পাহাড়ি অঞ্চলে গড়ে তোলা ফতেহপুর সিক্রিকে মনের মতো করে সাজাতে কোন কিছুরই কার্পণ্য করেননি সম্রাট আকবর। কালের পরিক্রমায় ফতেহপুর সিক্রি থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হলেও এর রাজকীয় জৌলুশ বহু বছর টিকে ছিল। এখন জৌলুশ না থাকলেও প্রাসাদ থেকে শুরু করে প্রায় সব অবকাঠামোই রয়ে গেছে। যা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরো বছর জুড়ে হাজার হাজার দেশি বিদেশি পর্যটক ফতেহপুর সিক্রি ভ্রমণ করেন, ঐতিহ্যের সন্ধান করেন।
অবশ্য সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে রাজধানী করলেও এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে সম্রাট আকবরের দাদা সম্রাট বাবরের ইতিহাস। তিনিই জায়গাটির নাম রেখেছিলেন শুকরী। সম্রাট বাবর এই অঞ্চলে অভিযান চালানোর সময় তাঁর সৈন্যরা স্থানীয় শুকরী ঝিলের পানি ব্যবহার করতো। মহারাজা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে যুদ্ধে সম্রাট বাবর জয়লাভ করেছিলেন। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে তিনি জায়গাটির নাম রাখেন শুকরী। তিনি জায়গাটিতে একটি উদ্যান গড়ে তোলেন। সেই বাগানে চমৎকার একটি প্রাসাদও নির্মাণ করেন। ওই প্রাসাদে বসেই তিনি লেখালেখি করতেন, অবসর কাটাতেন। বাবরের যুদ্ধ জয়ের একটি ইতিহাসও এখানে পাথরে খোদাই করা ছিল। কিন্তু তা ক্রমে নষ্ট হয়ে যায়।
সম্রাট বাবরের স্মৃতিধণ্য স্থানটি অনেকটা অলক্ষ্যেই পড়েছিল। কিন্তু সম্রাট আকবরের সন্তান কামনার জের ধরে স্থানটি আবারো সবার নজরে ফিরে আসে। মুঘল সম্রাট আকবরের বেশ কয়েকজন সন্তান জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। একটি সন্তানের আশায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। ওই সময় তিনি জানতে পারেন যে, তার দাদা বাবরের স্মৃতিধণ্য শুকরীতে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন দরবেশ রয়েছেন। যিনি দোয়া করলে ‘ নিঃসন্তানের সন্তান হয়, নির্ধনের ধন হয়।’ কথাটি শুনে সম্রাট আকবর আগ্রা থেকে পায়ে হেঁটে শুকরীতে আসেন এবং দরবেশ শেখ সেলিম চিশতীর দরবারে যান। তিনি দরবেশের নিকট নিজের আকুতি জানান এবং একটি সন্তানের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন। এর কিছুদিন পরই সম্রাট আকবরের স্ত্রী আম্বাররাজা ভর্মলের কন্যা মরিয়ম-উজ-জামানি ( যোধা বাঈ) সন্তানসম্ভবা হন। সম্রাট আকবর ওই দরবারের পাশেই যোধা বাঈর জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন। সেখানে ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেন এক পুত্র সন্তান। সম্রাট আকবর দরবেশ শেখ সেলিম চিশতীর নামে নিজের পুত্রের নাম রাখেন শেখ সেলিম। ওই সেলিমই সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ অধিপতি হয়েছিলেন। সম্রাট আকবর অতি আদরের এবং আরাধ্য এই পুত্রকে সারাজীবন ‘শেখ বাবা’ বলে ডাকতেন। শুকরীতে দরবেশে শেখ সেলিম চিশতীর প্রতি সম্রাট আকবরের শ্রদ্ধা এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, তিনি ওখানেই রাজধানী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন এবং শেখ সেলিমের জন্মের দুই বছরের মাথায় ১৫৭১ সালে শুকরী হয়ে উঠে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। এখানে রাজধানী স্থানান্তরের দুই বছর পর ১৫৭৩ সালে আকবর গুজরাত বিজয় করে ফিরে এসে শহরটির নাম দেন ফতেপুর সিক্রি বা বিজয়ের শহর’।
ফতেহপুর সিক্রির দুর্গ ও প্রাসাদগুলো লাল রঙের বেলে পাথর দিয়ে তৈরি। পুরো অঞ্চলটি যেন লালসে হয়ে রয়েছে। আসার পথে পাহাড় থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট যা দেখলাম তাতেও লালসে একটি ভাব রয়েছে। রয়েছে মরুর মতো একটি আবহও। আমরা ফতেহপুর সিক্রির প্রধান গেট ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ পার হলাম। এটি প্রায় ১৭৮ ফুট উঁচু গেট। এটি নাকি এশিয়া সবচেয়ে উঁচু গেট। এত উঁচু যে নিচ থেকে উপরের দিকে তাকাতে ঘাড় বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। গাইড আমাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। শুরুতে তিনি আমাদেরকে দুর্গ ও প্রাসাদ সম্পর্কে একটি ধারণা দিলেন। বললেন, এটি সম্রাট আকবরের রাজধানী। সুতরাং একটি রাজধানীর যা দরকার তার সবই এখানে তৈরি করা হয়েছিল। দুর্গের চারপাশে সুগভীর পরিখা রয়েছে। ভিতরে রয়েছে লেকের মতো জলাধার। অনেকগুলো প্রাসাদের পাশাপাশি রয়েছে মসজিদ এবং মাজারও।
সম্রাট আকবরের তিন ধর্মের তিনজন সম্রাজ্ঞী ছিলেন। তবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন যোধা বাঈ। যোধা বাঈর প্রাসাদটিই সবচেয়ে বড়। নান্দনিকতাও কিছুটা বেশি। হিন্দুধর্মের দেব দেবীর মূর্তি, পূজোর আসনসহ নানা কিছু। যোধা বাঈ নিয়মিত পূজা অর্চনাও করতেন এখানে। তুলশী তলাও ছিল প্রাসাদের সামনে। ফতেহপুর সিক্রির স্থাপনাগুলো অনন্য। দারুণ সব আয়োজন চারদিকে। কিন্তু এমন পাহাড়ী জায়গায় এতগুলো স্থাপনা গড়ে তোলা কি করে সম্ভব ছিল সেই প্রশ্নটি সারাক্ষণই দর্শনার্থীদের মাথায় ঘুরঘুর করে। বিশাল বিশাল সব স্থাপনা! বিশাল সব আয়োজন!! জামে মসজিদে একই সাথে দশ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। নামাজের সময় এই প্রাসাদের একটি বিশেষ দেয়ালে হাত দিয়ে আঘাত করলে বিশেষ একটি শব্দ হতো। ওই শব্দ শুনেই সম্রাট আকবর নামাজ পড়তে মসজিদে আসতেন। এখনো স্থানটিতে আঘাত করলে ওই বিশেষ শব্দটি হয়। কি ম্যাগানিজমে এত কিছু করা হয়েছিল কে জানে!
আমরা ঘুরছিলাম প্রাসাদের এখান থেকে ওখানে। দেখছিলাম নানা কিছু। হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রীষ্ট্রান ঘরনিকে কি করে যে সম্রাট ম্যানেজ করতেন কে জানে! কোন যাদুবলে সম্রাট তিনজনের কাছেই প্রিয়পাত্র থেকেছিলেন তাও অজানা রয়ে গেছে। গাইড কত কথা যে বলছিলেন! কত কত ঘটনা! কত কত ইতিহাস!! আমি মানসচক্ষে যেন মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় অধিপতি সম্রাট আকবরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।