(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছুটছিল আমাদের বাহন। সম্ভবত একশ’ কিলোমিটারের কাছাকাছিতে ছুটছি আমরা। বেশ ফ্রি মহাসড়ক, চার লেনের। ওয়ান ওয়ে ড্রাইভ। মুখোমুখি সংঘর্ষের কোনো শংকা নেই। এমন রাস্তায় দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালালেও ভয় লাগে না। তবে এই রাস্তায় সম্ভবত স্পিড লিমিট রয়েছে। তাই সুযোগ থাকলেও চীনা তরুণী নিয়ন্ত্রিত চাপ দিচ্ছে এঙেলেটরে। অথবা গাড়ির স্পিড লিমিট করে রাখা হয়েছে। একশ’ কিমির উপরে গতি উঠবে না। ভাষাগত সমস্যার কারনে তরুণীর পাশে বসলেও একটি কথাও হচ্ছিল না আমার সাথে। তবে গাড়িটি বেশ চমৎকার। চাইনিজ গাড়ি হলেও চড়তে বেশ আরাম। অবশ্য চড়ার আরামের সাথে শুধু গাড়িই নয়, রাস্তারও বেশ ঘনিষ্ট একটি সম্পর্ক থাকে। রাস্তার পিচ যত মসৃন হয় গাড়ি ততই নির্ঝঞ্জাটে চলে, চড়তে তত আরাম লাগে। রাস্তা যদি খানাখন্দকে ভরা কিংবা অসমান হয় তাহলে ধাক্কাধাক্কিতে গা গতরই শুধু ব্যাথা নয়, হাড্ডিও গুড়ো হওয়ারও আশংকা থাকে। অবশ্য ধনীদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তাদের জন্য আলাদা গাড়ি আছে। রাস্তার ধাক্কাধাক্কি বহু গাড়িই নিজে নিজে হজম করে ফেলে। যাত্রীরা টের পান না। এসব গাড়ির শকস-এবসরভার অন্যরকম। স্প্রিং অনেক শক্তিশালী। এই ধরনের উন্নতমানের গাড়িগুলো রাস্তার সব ধাক্কা নিজে নিজে ধারণ করে যাত্রীকে অন্যরকমের মোলায়েম একটি ভ্রমণ উপহার দেয়। চড়া দামের বিলাসবহুল গাড়িগুলো শুধু খারাপ রাস্তাতেই নয়, পাহাড় পর্বত কিংবা মরুর বুকেও যাত্রীর গতরে চোট লাগতে দেয় না। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানের গাড়িগুলো খারাপ রাস্তায় যাত্রীর হাড্ডি চুরমার করার তোড়জোর শুরু করে।
চীনের তাইজুর পাহাড়ী জনপদের গুহা দর্শণ শেষে ফেরার রাস্তাটি একেবারে মসৃন। এত মসৃন যে সাধারণ মানের মাইক্রোবাস হলেও আমরা গা গতরে বেশ চনমনে ছিলাম। মনে হচ্ছিল রেঞ্জরোভার বা মার্সিডিজ টাইপের কোন গাড়িতে বসে আছি!
চার লেনের বিশাল চওড়া সড়কের একপাশ ধরে ছুটছি আমরা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এখনি ঘুমিয়ে যাবো। কিন্তু ঘুমাতে মন সায় দিচ্ছিল না। চারদিকে প্রকৃতি এবং মানুষের এত আয়োজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে, এগুলো একবার হারিয়ে গেলে জীবনে আর দ্বিতীয়দফা দেখার সুযোগ পাবো না। কী অসাধারণ এক প্রকৃতি, কী অসাধারণ কৃত্রিম সব আয়োজন। রাস্তার পাশে চমৎকার সব ক্ষেতখামার, বাড়ি ঘর। সুউচ্চ নানা ভবনও দেখা মিলছে হঠাৎ হঠাৎ। আমাদের দেশের মতো বাজার এবং জনপদও রয়েছে রাস্তার পাশে। তবে কোথাও গ্যাঞ্জাম চোখে পড়লো না, কোথাও কোন ঝামেলাও দেখলাম না। বাসগুলো রাস্তাতেই যাত্রী উঠানামা করাচ্ছে, তবে তা রাস্তার পাশের বাস বে তে দাঁড়িয়ে। যেখানে সেখানে পার্কিং করা গাড়ি নেই, নেই স্লো মোভিং কোন গাড়িও। রিঙা ভ্যান কিংবা ঠেলা গাড়ির মতো গাড়ি না থাকাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা ছাড়া আমাদের তরুণী ড্রাইভারের আর বুঝি কোন কাজই ছিল না। গাড়ি চলছিল গাড়ির মতো, তরুণী শুধু শক্ত করে স্টিয়ারিং টা ধরে রেখেছেন, হালকা চাপ এক্সেলেটরে!
আমার হাত নিশপিশ করছিল। এমন মোলায়েম জার্নিতে স্টিয়ারিং-এ বসতে আমার হাত সবসময়ই কেমন কেমন যেন করে! তরুণীকে সরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসবো কিনা ভাবছিলাম। এমন রাস্তায় গাড়ি চালানোর মজাটা অন্যরকম। অনায়াসে দেড়শ’ কিলোমিটার স্পিড তোলা যায়! সাইড গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চটা অন্যরকম। আহা, কতদিন ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাই না! চালাবো নাকি? বুঝতে পারছিলাম না। বিদেশে কোন ঝামেলা জড়াতে ভয় লাগে। এতে শুধু নিজে নয়, দেশের ইমেজকেও নিলামে তুলে দেয়ার আশংকা থাকে। তাই বিদেশ গেলে সবসময়ই সর্বোচ্চ সতকাবস্থায় থাকি আমি। প্রতিটি পা ফেলি অতিমাত্রায় হিসেব কষে। যেন আমার কারনে কোনভাবেই কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয়, কোন কারনেই যাতে আমার প্রিয় স্বদেশ নিয়ে কথা না উঠে। তাই প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও স্টিয়ারিং ধরার লোভ সামলে নিলাম।
ঝিমুনির মতো এসেছিল। ফ্রন্ট সিটে বসেছি, পাশের ড্রাইভিং সিটে চীনা তরুণী। তার গাড়ি চালানোর শৃংখলা দেখে মোটামুটি নির্ভার ছিলাম। তাই কখন যে ঝিমুনির কবলে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। হঠাৎ হো হো করে হাসির শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। পেছনে ফিরে হাসির কারন বের করার চেষ্টা করলাম। আমাদের সাথে থাকা ঢাকার ব্যবসায়ী (ইতোমধ্যে আমাদের বন্ধু হয়ে গেছেন) হেলাল ইউ আহমেদ কী একটা চুটকি বলে সবার পেটের ভাত বের করে ফেলছিলেন। লায়ন ফজলে করিম ভাইও সাথে কী যেন যোগ করেছেন। আমি কিছু না বুঝেও তাদের হাসিতে যোগ দিলাম।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাতে ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার আছে। সেলাই মেশিনসহ নানা গার্মেন্টস মেশিনারিজ প্রস্ততকারী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি জ্যাক আমাদের সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেছে। চীনে সাতটার আগে ডিনার শুরু হয়। অধিকাংশ ডিনারই সম্পন্ন হয় আটটার আগে। এতে করে আমাদের ডিনারে সামিল হওয়ার একটু তাড়া রয়েছে। এই অবস্থায় আমরা সরাসরি হোটেলে যাবো নাকি ডিনারে যাবো তা বুঝতে পারছিলাম না। লায়ন ফজলে করিম সরাসরি ডিনারে যাওয়ার পক্ষে থাকলেও আমাদের কারো কারো মতে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর ডিনারে যাওয়া। আমাদের মতেরই জয় হলো। অবশ্য ডিনারে যাওয়ার জন্য আমাদের কারোর ভিতরেই তেমন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছিল না। শুধু নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য এই ভর সন্ধ্যায় ডিনারে যাওয়ার তোড়জোড় করতে হচ্ছে!
আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে। রুমে গিয়ে আমরা ফ্রেশ হলাম। ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আমি কফি মেকার চালু করে দিলাম। গরম পানিতে দুধ চিনিসহ কফি মিশিয়ে সোফায় হেলান দিলাম। আহ শান্তি!
ইন্টারকমের শব্দে নড়েচড়ে উঠলাম। ‘হ্যালো’ বলতেই করিম ভাই তাড়া দিলেন। বললেন, ওনারাতো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলেন, দ্রুত নিচে নামেন। কী আর করা, ক্ষুধা না থাকলেও ডিনারে সামিল হতে তৈরি হলাম।
ফাইভ স্টার হোটেলের লবিতে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটা পার হয়ে গেছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জ্যাক কোম্পানির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা। আমাদের অতি প্রিয় জেসি উনাদের সাথে রয়েছেন। আমরা লবিতে পৌঁছার সাথে সাথে উনারা উচ্ছ্বসিত হয়ে হাত বাড়ালেন। মনে হলো, তারা ক্ষুধায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন। আমাদের পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
ইতোমধ্যে চীনা রেস্টুরেন্টের ধরন সম্পর্কে আমার ধারণা হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্ট হবে বিশাল, ফুটবল খেলার মাঠ না হলেও একাধিক ব্যাডমিন্টন কোর্ট করা যাবে অনায়াসে। খোলা চত্বরের দুইদিকে রুম। যেখানে ১০ থেকে ২০ জনের বসে মিটিং এবং খাওয়ার দাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি রুমেই গোলাকার টেবিল, চারপাশে চেয়ার। টেবিলের দুই পার্টের উপরের পার্টটি ঘুরে। যেটিকে ঘুরালে খাবারের ডিসগুলো ঘুরে ঘুরে প্রতিজনের কাছে যায়। নিজের নেয়া হয়ে গেলে ঠেলে দিলে অপরজনের কাছে ডিস চলে যায়। দারুণ একটি সিস্টেম, চীনা বুদ্ধি ছাড়া এমন বুদ্ধি আর কারো মাথা থেকে বের হওয়ার কথা নয়।
আমাদেরকে একটি হলে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানে ঢুকে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। ২০/৩০জন মানুষ, নারী পুরুষ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। যতটুকু জানা গেল, এরা প্রত্যেকেই তাইজুর ব্যবসা বাণিজ্যের মাথা। তাইজু চেম্বারের শীর্ষ নেতাদেরও জ্যাক কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের সাথে ডিনারের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে। জ্যাক কোম্পানি যে এত আয়োজন করে রেখেছে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অবশ্য করিম ভাই ভেবেছিলেন বা উনাকে আগে জানানো হয়েছিল কিনা তা আমি জানি। তবে রুমের ভিতরের যেই আয়োজন এবং তাইজু চেম্বারের নেতাসহ যত বিখ্যাত সব ব্যবসায়ী আমাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে কার্ড বিনিময় করলেন তাতে অনেক বেশি সম্মানিত বোধ করছিলাম।
পরিচয়পর্ব শেষে জমজমাট খাওয়া দাওয়ার আঞ্জাম করা হচ্ছিল। একাধিক গোলাকার টেবিলে বসেছি আমরা। সবগুলো টেবিলই গোলাকার। অর্ডার কে দিয়েছে কে জানে! তবে অল্পক্ষণের মধ্যে ড্রিংকস সার্ভ শুরু হলো। আমাদের টেবিলে একাধিক ব্র্যান্ডের বোতল এবং বিয়ার বিয়ার সার্ভ করা হলো। আমরা কয়েকজন ড্রিংকস নেবো, বিয়ারও খাবো না বলায় তারা যেন কিছুটা হতাশ হলেন। বললেন, একটু করে নিলে কিছু হবে না। আমরা যখন একটু আধটু ব্যাপার নয়, নেয়া সম্ভব নয় বলার পর তারা আর জোর করলেন না। তবে আমাদের জন্য রকমারি জুসের ব্যবস্থা করা হলো। দুই তরুণী কত ধরনের জুসের ক্যান এবং বোতল যে টেবিলে এনে জড়ো করলেন তা হিসেব করা কঠিন। ড্রিংসসের সাথে রকমারি ঝাল টাইপের খাবার দেয়া হয়েছিল। আমরা মদ বিয়ার না খেয়েও একের পর এক ঝাল নাস্তা সাবাড় করছিলাম। পাপড়, ছোলা, বাদামসহ অপরিচিত নানা ধরনের খাবারের সাথে জুস না জমলেও খুব একটি খারাপ লাগছিল না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।