(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রাত ক্রমেই গভীর হচ্ছিলো, বাড়ছিলো সাগরের ঢেউয়ের গুঞ্জন,গর্জন। মনে হলো, ঢেউয়ের আওয়াজ আগের চেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, সাথে হাওয়ার তোড়জোড়ও। জ্যোৎন্সায় সবকিছু মাখামাখি হয়ে আছে। মোলায়েম এক আবহ চারদিকে। দারুণ একটি সময় যেনো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এমন সুন্দর সময়গুলোকে যদি টাইমমেশিনে ফেলে থামিয়ে দেয়া যেতো!
অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্টের সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। লায়ন ফজলে করিম চৌধুরী, লায়ন বিজয় শেখর দাশ এবং আমি–তিন বাংলাদেশি পর্যটক সাগরপাড় উপভোগ করছিলাম। আদতে আমরা সময়কেই উপভোগ করছি বলে মনে হচ্ছিলো। আমাদের ভালো লাগছিলো রাত, আমাদের ভালো লাগছিলো বিচ, আমাদের আনন্দ দিচ্ছিলো সাগরের ঢেউ। আমাদের মুগ্ধ করছিলো হাওয়া। জ্যোৎন্সা শুধু বাইরে নয়, আমাদের ভিতরটায়ও উদোম নৃত্য করছিলো। কী যে ভালো লাগছিলো সবকিছু!
বিচে আমাদের আশেপাশে আরো কিছু মানুষ আছেন, চাঁদের আলোতে মানুষের অবয়ব বুঝা গেলেও চেনা যাচ্ছিলো না। আমাদের দলের কেউ আছেন কিনা কে জানে! আমরা তিনজন একইসাথে আছি, একই বৃত্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখছি। আমরা কিছুক্ষণ হাঁটি, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। কিছুক্ষণ চাঁদ দেখি, কিছুক্ষণ সাগরের ঢেউ গুনি। আমরা কথা বলি, গল্প করি, হাসি। সবকিছু মিলে আমাদের সময়টা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিলো, যে সময়টাকে আমি ধরে রাখতে চাচ্ছি।
গল্পে গল্পে অনেক সময় পার করে দিয়েছি আমরা, দেখেছি পৃথিবীর রূপ, সাগরের অপরূপ মুগ্ধতা। বিজয় দা বললেন, চলেন, শুধু বিচ দেখে সময় ফুরিয়ে ফেলছি। চলেন, রাতের শহরটা ঘুরে দেখে আসি। আমি কিছুটা চমকে উঠে বললাম, এতো রাতে! বিজয় দা বললেন, ‘সমস্যা কি? এখানে তো পেটে চাকু ঢোকানোর লোকজন নেই। চলেন যাই।’ লায়ন ফজলে করিম ভাই নিরীহ ভদ্রলোক। কোনকিছুতেই আপত্তি করেন না। তিনি আমাদের আগে আগে হাঁটতে শুরু করলেন।
বিচের বালুচর ধরে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তায় উঠে এলাম। রাস্তার দোকানগুলো এখনো খোলা, লোকজনও আছে। কেনাকাটা খাওয়া দাওয়া সবই চলছে। শিল্পীরাও গান করছেন, গিটারে ঝড়ের বেগে আঙ্গুল চালাচ্ছেন। আমরা এদিক–ওদিক তাকালাম। রাস্তা ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
অপরিচিত শহর, এখন আরো অপরিচিত লাগছে। সন্ধ্যারাতে যখন এই শহরে এসেছিলাম তখন যে ব্যস্ততা চোখে পড়ছিলো তার ছিটেফোঁটাও এখন নেই। একেবার শান্ত সিগ্ধ রাস্তাঘাট, আস্ত শহর। রাত নামলে বুঝি দুনিয়ার বহু শহরের মতো গোল্ডকোস্টও ধীরে ধীরে পাল্টে যায়! দিনে গিজগিজ করা পর্যটক, সৈকতমুখী রাস্তাজুড়ে হরেক ব্যস্ততা–সবকিছু যেনো থেমে যায়। রাতে শহর কী ঘুমায়? রাস্তাগুলো কী যে শান্ত লাগছে! উঁচু উঁচু ভবনের গায়ে জ্বলে থাকা আলোগুলো চারপাশের পরিবেশকে মোহনীয় করে তুলছে।
হাঁটছিলাম আমরা। একেবারে সুনসান নীরবতা। মনে হচ্ছে কোথাও কেউ নেই, কেউ শব্দ করে এখানে কথাও বলে না। ফুটপাতে ছড়িয়ে থাকা আলো, ট্রামলাইনের পাশের সারি সারি ল্যাম্পপোস্ট, মাঝেমধ্যে ছুটে যাওয়া শেষ দিকের ট্রাম–সব মিলিয়ে ধীরস্থির এক আবহ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলেও জানালা দিয়ে আলো বের হচ্ছিলো। কয়েকটি ক্যাফে দেখা গেলো। লোকজন তেমন নেই, দুয়েকজন কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। বার এবং মদের দোকানগুলো খোলা। লোকজনও আছে। ডিসকোর আলোর ঝলকানি এবং সুরের ছন্দ রাস্তা পর্যন্ত ধেয়ে আসছিলো। বুঝলাম যে, এখানে শুধু দিনে নয়, রাতেও উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙ্গে।
আমরা হাঁটছিলাম আমাদের মতো করে, গল্প করতে করতে। এদিক–ওদিক নানা কিছু দেখতে দেখতে পথ চলছিলাম। কিন্তু খুবই আশ্চর্য লাগলো যে, একটি লোক কিংবা পুলিশের কোন গাড়ি আমাদেরকে দাঁড় করালো না। কোথায় যাচ্ছি, কোত্থেকে এসেছি কেউ এসে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। তেমন কারো সাথে আমাদের দেখাও হলো না। রাস্তা ধরে হঠাৎ হঠাৎ দু’চারটি গাড়ি ছুটে গেলেও আমাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় হয়তো তাদের ছিল না।
আমরা এরাস্তা–ওরাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমরা হারিয়ে যাবো, ঠিকঠাক হোটেলে ফিরতে পারবো না। কথাটি বলতেই বিজয় দা’র দম ফাটানো হাসিতে আশপাশ যেনো চমকে উঠলো। বললেন, কি যে বলেন দাদা! গুগল থাকতে এসব চিন্তা করার দরকার আছে? তিনি একটি গাড়ি নিয়ে পুরো শহর চক্কর দিয়ে আসার প্রস্তাব দিলেন।
প্রস্তাবটি আমার পছন্দ হলেও এতোরাতে গাড়ি পাওয়া কঠিন হবে। তাছাড়া এই শহরে যেহেতু আছি, এখানে ওখানে আসা–যাওয়ার সময় শহর দেখা হয়ে যাবে। শুধু শুধু এতোরাতে আর গাড়ি ভাড়া করার দরকার কি! করিম ভাই আমাকে সমর্থন দিলেন। সুতরাং গাড়ি ভাড়া করে শহর দেখার চেয়ে আমরা ঠিকঠাকভাবে হোটেলে ফেরানোর দায়িত্ব বিজয়দার উপর ছেড়ে দিলাম।
আমরা হাঁটছিলাম। রাস্তার পাশেই একটি পার্ক, মিষ্টি আলো জ্বলছে। তবে একেবারে শুনশান। কোন লোকজন নেই। রাস্তায়ও কোন লোকজন নেই। দুয়েকটি গাড়ির চলাচল না থাকলে মনে হতো আদিম কোন পৃথিবীতে এসে পড়েছি। পুলিশের একটি গাড়ি নীল–লাল আলো জ্বালিয়ে দ্রুত ছুটে গেলো। কোথাও কিছু হয়েছে কিনা কে জানে! গাড়িটি আমাদের পাশ দিয়ে গেলেও থামলো না, কিছু বললোও না।
অনেকগুলো বহুতল ভবন। যাওয়ার সময়ও দেখেছি। ঝুলবারান্দায় মিষ্টি আলো। ঝুলে আছে ফুলের টব। রাতের বেলায় ভবনের ঝুলবারান্দাগুলোকে দারুণ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো, ঘরভর্তি ভালোবাসা বারান্দা ধরে ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে!
বিজয় দা’ আমাদেরকে ঠিকঠাকভাবেই হোটেলে ফিরিয়ে আনলেন। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। আমি হোটেলের রিসিপশন লবিতে ঢুকেই সোফায় বসে পড়লাম। ডেস্কে মেয়েগুলো কাজ করছিলেন। আড়চোখে আমাদের দেখে নিজেদের কাজে মন দিলেন। লায়ন ফজলে করিম ভাই বললেন, চলেন, ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে উঠতে হবে। বিচে হাঁটবো। তিনি জানালেন যে, গোল্ডকোস্টের সার্ফার্স প্যারাডাইসে দারুণ সূর্যোদয় দেখা যায়। সারাজীবন সমুদ্রে সূর্যোস্ত দেখেছেন, এখানে সূর্যোদয় দেখবো। বাহ্, দারুণতো! ব্যাপারটিতো মাথায় ছিল না। সমুদ্রে সূর্যোদয় দারুণ হবে, আমি পুলকিত হয়ে সোফা ছাড়লাম।
রুমে ফিরে দারুণ করে এক মগ কফি বানালাম। বিজয় দা খাবেন না। কফি খেলে নাকি ওনার ঘুম হয়না, অথচ না খেলে আমার নিদকন্যা রাগ করে।
ইন্টারকমের বাজে শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। লায়ন ফজলে করিম ভাই তাড়া দিলেন। বললেন, সূর্য উঠে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করেন। ঘড়ি দেখলাম। সূর্যোদয় দেরি আছে। তবুও বিজয় দাকে ডেকে তুললাম। তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলাম। করিম ভাই এবং ভাবী লবিতেই ছিলেন। কিছুটা রাত থাকতেই আমরা সাগরপাড়ে এসে হাজির হলাম। সেই সার্ফার্স প্যারাডাইসে।
বহু লোক, নারী পুরুষ। সবাই যেনো হোটেল খালি করে সূর্যোদয় দেখতে সাগরের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। কেউ কেউ সার্ফিং বোর্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সাগরের দিকে। কেউবা জগিং করছেন বালুচরে, রাস্তায়।
আমরা হাঁটছি, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বালুচর ভেঙ্গে। সূর্যোদয়ের আগের লালসে আভায় ভরে আছে পুরো সাগর, যেনো বিশাল এক সোনালী থালা। ঢেউ আসছে, একটির পর একটি। একই সুরে, একই তালে চলছে সাগরের গুনগুন। মুগ্ধ হওয়ার মতো অনন্য এক আবহ। কী যে সুন্দর, কী যে সুন্দর! এমন অপরূপ প্রকৃতিতে দুর্বল কবিও সবল কবিতা লিখে ফেলতেন। আমি কবি নই, তবুও নিজেকে কবি কবি লাগছিলো। আমি গুনগুন করছিলাম সাগরের সাথে সাথে তাল–লয় মিলিয়ে।
সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে, একটি একটি ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেনো একটু একটু করে ওঠছে সূর্য। সূর্যাস্তের সময় সূর্য টুপ করে ডুবে যায়, কিন্তু এখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, পুরো দিনের জীবনী শক্তি বুকে নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। নিজেকে জ্বালিয়ে সূর্য আলো দেয় পৃথিবীকে। তার উদয়–অস্ত বলে কিছু নেই, সারাদিনমান সে জ্বলেই চলেছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই কোথাও সে থাকে, কোথায় থাকে না। সারাক্ষণই কোথাও না কোথাও তার উদয়–অস্ত চলছে। কিন্তু যেখানেই সে আসে, তার আসার প্রস্তুতি যে কী মনোরম! মনে হচ্ছিলো সাগরের বুক ছিঁড়ে আস্ত একটি চাঁদ বেড়াতে আসছে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।












