(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অনেক রাত অব্দি আমরা হেথায় হোথায় ঘুরলাম। দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার সানশাইন কোস্টের নানা কিছু। ভাগিনী তাবাসসুম এবং তার বর সাজ্জাদ একদিনেই আমাকে সব দেখিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। তাদের বছর দুয়েক বয়সী সন্তান ইভান যেনো তার আসল নানাকে পেয়েছে। ইতোমধ্যে ইভানের সাথে আমার যথেষ্ট ভাব হয়ে গেছে। ছোট্ট মানুষটিও চোখ পিটপিট করে চারদিক দেখে, দেখে আমাকেও।
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলাম। দুজন মানুষের জন্য বেশি বড়সড় একটি বাড়ি। আমার জন্য বেশ সুন্দর একটি রুম আগে থেকে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বিশাল খাটটিতে শুয়ে মনে হলো, হোটেলে ঘুমানোর চেয়ে এমন মায়াভরা বিছানা মানুষের জীবনে অনেক বেশি জরুরি। দিনভর প্রচুর জার্নি এবং রাতেও ঘোরাঘুরির ফলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে কে জানে! বিছানায় গা এলানোর পরই মনে হয় চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বেশ সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। তখনো ঘরের কেউ জাগে নি। আমিও কাউকে না ডেকে দরোজা খুলে নদীর পাড়ে চলে গেলাম। ঘরের সামনেই ছোট্ট একটি পার্কের মতো, তাপ পাশেই নদী।
সানশাইন কোস্টের নামের জৌলুশ যেনো চোখে পড়লো। শহরটিকে মনে হচ্ছিলো সূর্যের শহর। সামনের নদীর পানি চিক চিক করছিল, ভাসছিল বিভিন্ন ধরনের নৌযান, ইয়ট। নদীর পাড়ে জগিং করছে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ। সবুজ ঘাসের উপর আকাশছোঁয়া বেশ কয়েকটি গাছ। গাছের নিচে বেঞ্চ পাতা, স্টিল এবং কাঠের। আমি একটি বেঞ্চে বসে মানুষের আসা যাওয়া দেখতে লাগলাম।
একটু পরই তাবাসসুম এসে সামনে দাঁড়ালো। রাতে ঘুম হয়েছে কিনা জানতে চাইলো। বললো, আংকেল চলেন, নাস্তা দেয়া হয়েছে। নদীর পাড় থেকে ঘরে ফিরলাম। ড্রয়িং রুমের পাশেই ডাইনিং টেবিল। টেবিলে গরম গরম পরোটা, ডিম পোচ, মাংস এবং সবজিসহ নানা খাবার সাজিয়ে রেখেছে মেয়েটি।
নাস্তার টেবিলে সাজ্জাদ এবং তাবাসসুম দুজনই আমাকে তাদের সাথে আরো কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু পুরোদলকে গোল্ডকোস্ট রেখে এখানে আমার একা থাকাটা সুন্দর হচ্ছে না, অন্যান্য প্রোগ্রামগুলোও মাঠে মারা যাবে। আরো বেশ কিছু বিষয় বুঝিয়ে বলার পর তারা রাজি হলো। আজ আমাকে গোল্ড কোস্ট দিয়ে আসা হবে বলে আশ্বস্ত করলো। কথা ছিল সকালেই নাস্তার পর আমরা গোল্ড কোস্টের পথ ধরবো। কিন্তু তাবাসসুম আর সাজ্জাদ বললো, আমরা সকাল থেকে এখানের দর্শনীয় সবকিছু ঘুরে দেখবো। বিকেলে ব্রিজবেন ঘুরবো। রাতে আপনাকে গোল্ড কোস্ট পৌঁছে দিয়ে আসবো।
তারা তিনশ’ কিলোমিটার জার্ণি করে যাবে, আমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসবে। বিষয়টি ভীষণ কষ্টকর হলেও তাবাসসুম এবং সাজ্জাদ অনায়াসে নিজেদের মতো করে প্রোগ্রাম সেট করে ফেললো। বললো, দুপুরে আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেবো।
নাস্তা পর্ব সেরে আমরা কফি খেলাম। তাবাসসুম ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে, ইভানের খাবার এবং গরম পানি নেয়ার সময় আমাদের জন্যও হালকা খাবার, পানি এবং ফ্রাষ্ক ভর্তি কফি গাড়িতে তুলে নিল।
তাবাসসুমের গাড়িটি তুলনামুলক ছোট, তাই সেটি না নিয়ে সাজ্জাদের সেভেন সিটারের বড়সড় গাড়িটি নেয়া হলো। ইভানের বসার একটি ‘চাইল্ড কার সিট’ সেট করে নিতে হলো। সিটের উপর আলাদা সিট। সেটাতেই বাচ্চাকে বসাতে হবে। বাচ্চা কোলে নিয়ে ট্রাভেল করা নিষিদ্ধ, পুলিশ ধরলে বেশ মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হয়, কাটা যায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্টও। ইভানকে ‘চাইল্ড কার সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দেয়া হলো। বেশ অভিজ্ঞ সওয়ারির মতো সে চুপচাপ সবকিছু মেনে নিচ্ছিলো।
আমাকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে সাজ্জাদ গাড়ি স্টার্ট করলো।
বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর আমরা সানসাইন কোস্টের কোলাম বিচে পৌঁছালাম। অস্ট্রেলিয়ায় বিচের অভাব নেই, নেই সাগরের অভাব। কত শত বিচ যে দেশটির রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা কিভাবে যে এতোগুলো বিচকে এমন নান্দনিকভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে তা আমার কাছে বড় এক বিস্ময়।
সূর্যের শহরটিতে সূর্য আজ বেশ চটকদার। পূর্ব দিগন্তের সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছে কোলাম বিচের ঢেউয়ের ওপর। ঢেউগুলো একে একে তীরে আছড়ে পড়ছে। যেনো তীরের জন্য এক বুক হাহাকার নিয়ে এক একটি ঢেউ ছুটে ছুটে আসছে।
আমি জুতা খুলে হাঁটছি সমুদ্রতট ধরে। একদম খালি পায়ে। পায়ের নিচে নরম সাদা বালু, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে শরীর মিলিয়ে পথ চলছি। তাবাসসুম এবং সাজ্জাদ বিচে নামেনি, বাচ্চাকে একা রেখে আসতে পারছিল না। তারাা সেখানে একটি বেঞ্চে বসে আছে।
বহু লোক সার্ফিং করছিল। কোলাম বিচ সার্ফিংয়ের জন্য বেশ বিখ্যাত। সাগরের দিক থেকে যখন হালকা বাতাস আসে, তখন দূর থেকে ভেসে আসে সার্ফারদের চিৎকার। ঢেউয়ের ওপর তাদের উড়ন্ত ভঙ্গি যেন কোন নৃত্যের মুদ্রা। কোলাম বিচে ঢেউগুলো খুবই পরিপূর্ণ। বেশি উঁচু নয়, আবার খুব একটা ছোটও নয়। নবীন সার্ফাররা এখানে সার্ফিং শিখতে আসে, বড়রা আসেন অভিজ্ঞতা ঝালাই করতে। এতে করে নবীন এবং প্রবীন সার্ফারদের তীর্থক্ষেত্রের আদল পেয়েছে এই বিচ।
সৈকতের পাশে রয়েছে কোলাম সার্ফ ক্লাব। ওখানে বেশ লোকজন দেখা গেলো। কেউ ওয়েটসুট পরে ঢেউ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ বা প্রশিক্ষককে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আমার চোখ আটকে গেলো এক কোণে। যেখানে একটি ছোট ছেলে সার্ফিং বোর্ডে উঠার চেষ্টা করছে। প্রথম ঢেউয়ে পড়ে গেলেও তার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সে বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সফল হলো। কাছে দাঁড়িয়ে তার বাবা হাততালী এবং ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে তাকে উৎসাহিত করলো।
তীরে বসে থাকা এক বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখলাম, দু’জনের হাতে কফির কাপ, চোখে সানগ্লাস, সামনে শুধু নীল জলরাশি। তারা চুকচুক করে কফি খাচ্ছিলেন, আর নিজেদের মতো করে গল্প করছিলেন। হয়তো যৌবনে তারাও সার্ফিং বোর্ডে সাগর দাবড়াতেন!
কোলাম বিচের সবচেয়ে নান্দনিক দৃশ্য হলো মাউন্ট কোলাম, একটি সুউচ্চ পাহাড়। গাছ–গাছালীতে ঢাকা পাহাড় হলেও মুলতঃ এটি বিশাল গম্বুজাকৃতির একটি আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরীটি কোলাম বিচের এক পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি প্রায় ২৬ হাজার বছরের পুরনো আগ্নেয়গিরির অবশিষ্ট অংশ। বহু বছর ধরে এটি সানশাইন কোস্টের জনপ্রিয় এক হাইকিং ট্রেইল।
বিচ থেকে দেখা যাচ্ছিলো, অনেকে উঠছে পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো সানশাইন কোস্টকে দেখার তৃপ্তি অন্যরকম।
আমরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য পা চালালাম। কিছুপথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকিটা আমাদের হাঁটতে হবে। হাঁটর পথ হলেও সেটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে করে রাখা হয়েছে। বন–বনানীর ভিতর দিয়ে পথ চলা। গাছের ছায়ায় অগুনতি পাখীর কলকাকলী এবং নিচে সমুদ্রের অবিরাম গর্জন। অসাধারণ, আসলেই অসাধারণ।
পাহাড়ের গাছগাছালীর ভিতরে পাথুরে রাস্তা, কোথাও কোথাও কাঠ দিয়ে পাটাতনের মতো বানিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও সাঁকোর মতো। এই শীতের মাঝেও আমরা ঘামছিলাম। পাহাড়ে চড়ার যে কষ্ট চারপাশের আবহ তা নিমিষেই তাড়িয়ে দিচ্ছিলো। কী যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, একের পর এক। পাহাড়ে চড়ার কষ্ট লাঘব করতে এমনভাবে পথ তৈরি করা হয়েছে যে, এলোমেলো পথ চলে আমরা চূড়ায় উঠে গেলাম। একটি মরা আগ্নেয়গিরীর মাথায় বসে আছি ভাবতে কিছুটা ভয় লাগলেও চারদিকের অপরূপ সব রূপ আমার মৃত্যুভয়কে তাড়িয়ে দিল। একদিন তো মরবোই, মৃত্যুকে তো আর জয় করা সম্ভব নয়। তবে ভর চাঁদনী রাতে এমন সুন্দর একটি পরিবেশে পাখীর গান এবং সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে চোখ দুটো চিরতরে বন্ধ করতে পারলে মনে হয় মৃত্যুর কষ্ট উবে যেতো!
হাঁটছিলাম আমরা। আমাদের ধারে কাছে ঘুরছে নানা পাখী। বড় বড় হাঁসগুলোও ঘুরছিল। সাগরেও প্রচুর হাস ভাসছে, ওড়াউড়ি করছে। এগুলোকে আমরা শীতের পাখী হিসেবে চিনি। বনের ভিতরে দোকানও রয়েছে। রয়েছে নানা ধরণের খাবার–দাবার বিক্রি হচ্ছে। কী সুন্দর ওয়াশরুম, খাবারের পানির কল। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে কাহিল হয়ে ফ্রি পানি খাওয়ার ব্যবস্থা। পাহাড়ের এতো উপরে পাইপ লাইনে খাবার পানির সরবরাহ ঠিক কতটুকু মানবিক চিন্তা তা ভাবছিলাম।
মনে হচ্ছিলো, গতরাতে যদি আমি ফয়সালের সাথে গোল্ড কোস্ট চলে যেতাম, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার অনন্য সুন্দর একটি রূপ দেখতে পেতাম না। রাতটি সানশাইন কোস্টে কাটিয়ে সকালেই যে আনন্দের হরিলুটে যোগ দিলাম সেজন্য মনে মনে তাবাসসুম এবং সাজ্জাদকে ধন্যবাদ দিলাম।
অনেকক্ষণ ধরে পাহাড়ের উপর ঘুরলাম। বনবনানী মাড়ালাম। উপর থেকে পাখীর চোখে সানশাইন কোস্টের সবকিছু দেখা! আহা, কী যে সুন্দর, কী যে অপরূপ! আমার মন প্রাণ অন্যরকমের তৃপ্তিতে ভরে উঠছিলো। মনে হচ্ছিলো, পৃথিবীটা আসলেই সুন্দর, আসলেই অনন্য। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।











