দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দিনভর লায়ন্স কনফারেন্সে কাটিয়ে বিকেলে ফিরে এলাম হোটেলে। কনফারেন্স তখনো চলছিল, চলছিল নানা আয়োজন। তবে বিশেষ বেকায়দায় পড়ে যাওয়ায় আমরা শেষতক অবস্থান না করে কনফারেন্স থেকে কেটে পড়ি। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর পুত্র থাকে মেলবোর্নে, ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। বাপের কাছ থেকে তাগাদা পেয়ে সে আমাকে অস্থির করে তুলছিল ফোনে। ‘আংকেল’কে ঘুরিয়ে মেলবোর্ন দেখাবে। সে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। সে আজই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়। আমি বাধ্য হয়ে তার সাথে প্রোগ্রাম করে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বিকেলের দিকে কোন বিচে গিয়ে সময় কাটাবো। সে যেনো সেভাবে ব্যবস্থা করে। তার গাড়ি আছে, নিজেই ড্রাইভ করবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, উন্নত দেশগুলোর জীবনযাত্রা বহু উন্নত, কিন্তু সেখানে ড্রাইভার পোষা কেবল কঠিনই নয়, অনেকটা অসম্ভব। ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওই ধরনের উন্নত জীবনযাত্রার দেশগুলোতে নিজের গাড়ি নিজেকেই চালাতে হয়, নিজের সব কাজও করতে হয় নিজেকে। এক একটি পরিবারে ৫/৭টি গাড়িও আছে, দামি দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি। কিন্ত্র নিজস্ব ড্রাইভার আছে এমন ভাগ্যবানের দর্শন কালেভদ্রে জোটে!

আমার বন্ধুর ছেলে নিজে যদি ড্রাইভ করে তাহলে অনায়াসে আমরা চারজন চড়তে পারি। মানুষও আমরা চারজন, ব্যাটে বলে মিলে যাওয়া মনে হয় একেই বলে। পেছনে তিনজন এবং ফ্রন্ট সিটে একজন বসলে পৃথিবীর কোন দেশেই আইন লংঘিত হবে না। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ফাইভ সিটার গাড়িতে পৃথিবীর এসব দেশে কোন অবস্থাতেই ছয় জন বসবে না।

লায়ন ফজলে করিম, ডালিয়া ভাবী এবং বিজয় দা’সহ হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হলাম। বন্ধুর ছেলে গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। তাকে রুমে ডাকলাম, কফি অফার করলাম। কিন্তু সে তাড়া দিয়ে বললো, আংকেল, দেরি হয়ে যাবে। আপনাদের অনেককিছুই দেখানোর আছে। বাইরে তো খাবোই, এখানে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

মেলবোর্ন শহরের রূপ বর্ণনা করা আমার মতো দুর্বল লেখকের পক্ষে কঠিন। কী অপরূপ এক শহর! অনেকেই এই শহরকে শিল্প, সংস্কৃতি আর আধুনিক জীবনের নগরী হিসেবে জানে। সেই নগরী চষে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে হোটেল ছাড়লাম আমরা। যথারীতি গ্রুপে টেক্সট করে দিলাম যে, আমরা ডিনার করবো না।

আমরা মেলবোর্ন শহরে ঘুরছি। গাড়ি চড়ে স্বপ্নের মতো সুন্দর শহরটি দেখছি। আমার বন্ধুর ছেলে বেশ ভালোই গাড়ি চালায়। অবশ্য, এসব দেশে গাড়ি ভালো চালাতে হয়না, নিজে নিজেই ভালো চলে। শুধু সিগন্যাল মানলে হয়। রিক্সা বা ব্যাটারি রিক্সা এসে ঠোক্কর মারার শংকা নেই। সিএনজি টেক্সির গুতো খাওয়ার আশংকা নেই। ঠেলাগাড়ির পেছনে পড়ে জটলায় পড়ে যাওয়ার উপদ্রপ নেই। নিজের লেইন ধরে এগিয়ে চলা এবং সিগন্যালে ব্রেক বা স্টিয়ারিং ঘোরালেই ভালো ড্রাইভিং হয়ে যায়। করিমভাই স্যান্ডউইচ হয়ে যাচ্ছে কিনা জানি না, তবে আমি বেশ বেশ আয়েশ করে ফ্রন্ট সিটে বসেছি। গাড়ি ছুটছে, আমার বন্ধুপুত্রের সস্তায় কেনা দামি ব্রান্ডের গাড়ি।

সে আমাদেরকে হেথায় হোথায় ঘুরিয়ে মেলবোর্নের বিখ্যাত ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নিয়ে গেল। মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম! রোমাঞ্চিত হলাম। আমাদের সোনার ছেলেরা এই মাঠে ক্রিকেট খেলে। এই মাঠের কত শত বলে আমরা উচ্ছ্বাস করেছি, আবেগে কেঁদেছি। দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে গলা শুকিয়ে ফেলেছি। সেই ক্রিকেট গ্রাউন্ড আমার চোখের সামনে। স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথে একজন খেলোয়াড়ের স্টাচু, ব্যাট করছেন। কী যে নান্দনিক! আমাদের স্টেডিয়ামের ভিতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হলো। সে মনে হয় আগেই কিছু কাজ অনলাইনে ঘুচিয়ে রেখেছিল। আমাদেরকে একজন গাইড দেয়া হলো। সাদা চামড়ার গাইডসাহেব ইংরেজীতে অনেককিছুই বললেন। একটি জাদুঘরও রয়েছে স্টেডিয়ামে, সেটিও দেখালেন। প্লেয়ারদের চেঞ্চরুম থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামের নানাকিছু দেখে আমরা গ্যালরিতে পৌঁছালাম। আমরা চারজন ছাড়াও আরো পর্যটক রয়েছেন। কোন খেলা চলছিল না, আমরা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে গ্যালরি নিয়ে ছবি তুললাম। যে গ্যালরিতে এক একটি বল কী ঝড়ই না তোলে!

আরো কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘোরাঘুরির পর বন্ধুপুত্র বললো, চলেন, বিচে যাই। সন্ধ্যার আগ দিয়ে পৌঁছালে ভালো লাগবে। চারদিকে সাগর মহাসাগর বেষ্টিত পৃথিবীর অনন্য সুন্দর দেশ অস্ট্রেলিয়া। দেশটির হেথায় হোথায় অসংখ্য বিচ। বিচগুলোও বেশ সুন্দর। সাগর মহাসাগর ছুঁয়ে আসা নোনতা বাতাস পর্যটকদের গায়ে আদুরে পরশ বুলায়।

অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা শহরের তালিকায় রয়েছে মেলবোর্ন। শহরটি বেশ পুরানো, তবে গুছানো এবং নান্দনিক। সাগরপাড়ের শহরটিতে ঘুরতে বের হয়ে সাগরে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ গাড়িতে চড়তে হলো না।

শহরের একেবারে কাছেই সাগর। সাগরের পাড়ে যেনো পাহাড়। আমার বন্ধুর ছেলে আমাদেরকে দারুণ একটি ট্যুরিস্ট স্পটে নিয়ে আসলো। সাগরের পাড়ে যেনো ছোট পাহাড়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ওয়াকওয়ে, কোথাও পায়ে হাঁটার মেটো পথ। আমরা সাগরপাড়ের পাহাড় ধরে ধরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বিচে নেমে পড়লাম। পাহাড় থেকে বিচে নামার ব্যবস্থাও সুন্দর।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিলো, সূর্য বিদায় নেয়ার প্রতীক্ষায়। কনে দেখা আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীল সাগর দেখছিলাম। সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল বিস্তৃত সাগরের যে রূপ তার বর্ণনা করা কঠিন। এই সৌন্দর্য যে কতখানি মোহনীয়, তা কেবল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষই উপলব্ধি করতে পারে।

দূর আকাশে শুরু হয়েছে রঙের খেলা। কখনো কমলা, কখনো গোলাপি আর কখনো মনে হচ্ছে বেগুনি রঙ ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। সমুদ্রের ঢেউগুলো একে অপরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে আসছে তটে, যেনো প্রতিটি ঢেউ সন্ধ্যার গান গাইছে। বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ, কিন্তু তাতে এক ধরনের সতেজতা মিশে আছে। কোন কোলাহল নেই, ভিড়বাট্টা নেই। নেই শোর চিৎকার। নিরিবিলি এক বিচে যেনো আমরা সূর্যের বিদায় উৎসব উদযাপন করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমরা বিচে বসে পড়লাম। উপরে পাহাড়ে বসার বেঞ্চ রয়েছে, বিচজুড়ে কেবলই বালি। বালির উপর পা মুড়িয়ে বসে আমরা সাগরের ঢেউ উপভোগ করতে লাগলাম।

আরো কিছু লোকজন রয়েছে। রয়েছে নারী পুরুষ। সাদা চামড়ার মানুষের আধিক্যের মাঝে আমরাই কেবল বাদামী। নিজেদেরকে বেখাপ্পা লাগলেও কোন ডর ভয় ছিল না। এখানে কাউকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই নিজেদের মতো থাকে।

আমাদের অদূরে ওয়াইন এবং বিয়ার খাচ্ছিলো কয়েকজন মানুষ। তাদের মধ্যে যুবতী নারী রয়েছে, রয়েছে যুবক। আবার বয়স্ক লোকজনও। মনে হচ্ছিলো পারিবারিক সম্মিলন। তারা উৎসবের আমেজে সময় কাটাচ্ছিলো। আরো কিছু লোকজন আছে, যারা সাগর এবং সূর্য নিয়ে ছবি তুলছিলো। সাগরে ইয়ট ভাসছে, ভাসছে নানা নৌযান। কেউ কেউ উদাস হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে ওসব দেখছিল। ছোট ছোট শিশু কিশোরেরা বালি নিয়ে নিজেদের মনের মতো খেলায় মেতে উঠেছিল, কেউ কেউ করছিল ছোঁটাছুটি।

কোন হকার নেই, ভিক্ষুকের তো প্রশ্নই উঠেনা। দোকানপাটও দূরে। আমার বন্ধুর পুত্র বললো, দোকান থেকে সে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসতে পারে। খাবারের ব্যাপারে আমাদের কোন আগ্রহ নেই, তবে কফি হলে সময়টা দারুণ জমতো বলে মনে হচ্ছিলো। কথাটি বলতেই আমার বন্ধুর ছেলে হাঁটতে শুরু করলো। অনেক পিছু ডেকেও তাকে টাকা গছানো সম্ভব হলো না।

অল্পক্ষণের মধ্যে বিশেষ কায়দায় পাঁচ মগ কফি নিয়ে ফিরে এলো আমাদের লোকাল গার্ডিয়ান। সে আমাদের প্রত্যেকের হাতেই কফির মগ ধরিয়ে দিল। উন্মুক্ত সাগরপাড়ে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মনে হচ্ছিলো, জীবনটি এতো ছোট কেন?

সূর্য ধীরে ধীরে দিগন্তের নিচে হারিয়ে গেল। চারপাশের আলো কমে গিয়ে নেমে এলো নরম অন্ধকার। সাগরের ইয়র্ট ও নৌযানগুলোতে বাতি জ্বলে উঠলো, দূরের নীল আকাশে দেখা দিল তারা। এই সমুদ্রসন্ধ্যা কেবল আমার চোখই জুড়িয়ে দিল না, মনও ভরিয়ে দিলো।

নিজেদের মতো করে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম আমরা। অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাত্রা, চাকরি বাকরি, নাগরিকত্ব এবং শিক্ষার্থীদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নিলাম। অনেকগুলো ভালো খবর শুনালো আমার বন্ধুর ছেলে। লেখাপড়ার খরচটা বেশি হলেও বৃত্তি পাওয়া যায়, চাকরির বাজার খুবই ভালো। নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র শংকিত থাকতে হয় না। পিআর ও নাগরিকত্বও সময়মতো জুটে যায়। ঘুষ দুর্নীতি নেই, হানাহানি নেই। সাদাকালোর ভেদাভেদ নেই, ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ নেই। মানুষ শান্তিপ্রিয়, শান্তিতে থাকতে এবং অপরকে শান্তিতে রাখতে ভালোবাসে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিছুটান
পরবর্তী নিবন্ধসদরুল পাশা : মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি