দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অনেক রাত অব্দি মেলবোর্ন শহরের হেথায় হোথায় ঘুরলাম। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরটি রাতের বেলায় যে কী পরিমাণ বর্ণিল হয়ে উঠে তা দেখে বিমোহিত হলাম। এতো রঙ যে শহরে সেই শহরতো বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহর হবেই! ফিরতি পথেও ট্রামে সওয়ার হয়েছিলাম। মাগনায় ফিরে এসেছিলাম হোটেলে। গাড়ি ভাড়া খাতে কোন টাকা পয়সা খরচ না হওয়ায় নিজেদের বেশ লাভবান মনে হচ্ছিলো। শহরের এখানেওখানে মাগনায় যাতায়াতের এই অনন্য আয়োজন সত্যিই পর্যটনবান্ধব। বিশ্বমানের একটি বাসযোগ্য শহর যে কিভাবে নাগরিকবান্ধব হয়ে উঠে তা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেকেই মেলবোর্ন সফর করেছেন, দফায় দফায় গেছেন। তারা নাগরিক বান্ধব কিংবা পর্যটন বান্ধব কি করে হতে হয় তার সবই জানেন, কিন্তু কখনো কার্যকর করেন না। আমি চুনোপুটি মানুষ, এসব নিয়ে মাথা ঘামানো সাজে না। মাগনায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছি, ঘুরছি। যে ক’দিন মেলবোর্ন থাকবো এভাবেই ঘোরাঘুরি করবো। এতে অচিন শহরে উবার কিংবা গাড়ি ভাড়া করে নানা স্থানে যাতায়াতে যে খরচটি হয়, সেটি সাশ্রয় হচ্ছে দেখে মনটি ফুরফুরে হয়ে উঠলো।

হোটেলের লবিতে পৌঁছে সোফায় হেলান দেয়ার পর প্রচুর হাঁটাহাঁটি এবং ঘোরাঘুরির ধকল টের পাচ্ছিলাম। তাছাড়া ডিনার না করায় পেটেও বিদ্রোহ করছিল। লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং বিজয় দা বেশ কিছু ফল কিনে নিয়ে আসলেন। ফলের দোকান যে কোথায় পেলেন কে জানে! ফলগুলোর চেহারা দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা ফলের মতো লাগছিল। দোকান থেকে কিনে আনা ফল যে কেমন টাটকা হয় তা চোখে না দেখলে লেখা পড়ে অনুধাবন করা কঠিন। আপেলে কামড় দেয়ার পর পুরো মুখ রসে যেনো ডুবে গেলো, টসটস করে গড়িয়ে পড়ছিল। কিউই ফ্রুট খেতে কী পরিমান মজা যে লাগছিল! পিয়ারও খেলাম মন ভরে। সব অস্ট্রেলিয়ান ফল, এখানের কোন বাগান থেকে তুলে দোকানে বিক্রি করা হয়েছে। আপেল, কিউইফ্রুট কিংবা পিয়ারের এমন টাটকা সংস্করণ আমাদের দেশে একেবারে দুষ্প্রাপ্য। আরো কি কি সব ফল কিনে আনা হয়েছিল। অনেকটা ফলোৎসবের মেজাজে আমরা রকমারি ফল খেয়ে নিলাম।

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন শরীরটি বেশ হালকা লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, মাঝরাতে থালাভর্তি ভাত খেয়ে ঘুমুতে যাওয়া আর ফল খেয়ে ঘুমানোর মাঝে ব্যবধান বিস্তর। আমার সাথে একমত হলেন রুমমেট বিজয় দা। তিনি বললেন, দেশে ফিরে তিনি ফল খেয়েই ঘুমাবেন। ভাত বাদ দেবেন।

আমাদের ব্যুফে নাস্তা। তারকাখচিত হোটেলগুলোতে সকালের নাস্তা মানে এক আলীশান কারবার। কত ধরনের খাবার যে সাজিয়ে দেয়া হয়! বিদেশে গেলে সকালের নাস্তাটা বেশ আয়েশ করে করি, খুঁজে খুঁজে নিই, মন ভরে খাই। দুকাপ কফির মাধ্যমে নাস্তাপর্ব সম্পন্ন করি। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না, প্রচুর নাস্তা খেলাম। রাতের হালকা শরীর সকালের ভরপেট নাস্তায় ভারি হয়ে উঠলো।

আজ আমাদের অনেক কাজ। বিশেষ করে যে উদ্দেশ্যে আমাদের মেলবোর্ন আসা সেই লায়ন কনভেনশনের জমকালো আসর শুরু হবে সকালে। বর্ণাঢ্য র‌্যালি কনভেনশনের অন্যতম আকর্ষণ। এর আগেও বহু কনভেনশনে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছে। সবসময়ই এই র‌্যালি আমাকে অন্যরকমভাবে টানে। নিজের দেশের পতাকা নিয়ে র‌্যালিতে সামিল হওয়া এবং বহু বহু দেশের লায়ন সদস্যদের সাথে আনন্দের সাথে এগিয়ে যাওয়ার তৃপ্তি আসলেই অন্যরকম। বিশ্বের অনেকগুলো দেশে এভাবে নিজের দেশের পতাকা উড়িয়ে পথ চলেছি, আজও আমরা পতাকা নিয়ে এসেছি।

লায়নিজমকে আমি অন্তর দিয়ে ধারণ করার চেষ্টা করি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই সেবা সংগঠনের একজন নগণ্য সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এই সংগঠনের সদস্যরা নীরবেনিভৃতে মানবতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এমনও বলা হয় যে, লায়নিজমের বিশ্বে সূর্য অস্ত যায় না। রাতে দিনে চব্বিশ ঘন্টাই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কোন না কোন লায়ন সদস্য নানা ধরণের সেবামূলক কাজ করেন। লায়নিজমে কখনো ‘আমি’ বলা হয়না, বলা হয় ‘আমরা’। উই সার্ভআমরা সেবা করি। আমরা বিশ্বাস করি যে, যেখানেই সেবার প্রয়োজন, সেখানেই কোন না কোন লায়ন সদস্য হাত লাগান। একজন লায়ন সদস্যের কাছে জাতি ধর্ম বর্ণ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় কখনো মুখ্য হয়না, মুখ্য হয় মানুষমানবতা।

প্রতিবছরের মতো এবারও লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সামিল হয়েছি আমরা বাংলাদেশের লায়ন সদস্যরা। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা হাজারো লায়ননেতা, ডেলিগেট, সেবাপ্রেমী মানুষ জড়ো হয়েছিলেন মেলবোর্ন শহরে। বিশাল এক মহাসমাবেশ, বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, উৎসব। সৌভাগ্যক্রমে সেই মহাসমাবেশের অতি নগণ্য এক অংশ আমি, আমরা।

মেলবোর্ন শহরের বিশাল এক পার্কের সামনে থেকে আমাদের শোভাযাত্রা শুরু হয়। হাজার হাজার লায়ন সদস্য। প্রতিটি দেশ থেকে আসা লায়ন সদস্যরা আলাদা আলাদা গ্রুপে নিজ নিজ দেশের পতাকা নিয়ে হাঁটছেন, ঢাকঢোল বাজাচ্ছেন, নানা ধরনের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করছেন। বিশাল সড়ক ধরে এগিয়ে চলছি আমরা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কয়েকশ’ লায়ন সদস্য। দেশের পাঁচটি ডিস্ট্রিক্টের আওতাধীন কয়েকশ’ ক্লাবের সদস্য সদস্যারা যোগ দিয়েছি একই কাফেলায়। আমাদের মধ্যে কোন বিভাজন নেই, কোন জাত পাত নেই। আমরা সবাই লায়ন সদস্য।

কনভেনশনের হোম কান্ট্রি অস্ট্রেলিয়া। তারা নিশ্চয় একটি রুট নির্ধারণ করে প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে রেখেছেন। ওই রুট ধরেই এগিয়ে চলছে হাজার কয়েক লায়ন সদস্য, লায়নিজমের পতাকা। নানা রঙের নানা ঢঙ্গের পোশাকে লায়ন সদস্যরা রাজপথ বর্ণিল করে তোলেছেন। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরেও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চলছিল। কেউ নাচছিল, কেউবা গান গাচ্ছিলেন। আফ্রিকা অঞ্চলের লায়ন সদস্য সদস্যারা নানা রঙের পোশাক পরে কত আনন্দের ফেরি যে করছিলেন!

আমাদের গ্রুপের সদস্য সদস্যারাও বাংলা গান গেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। অবশ্যই দেশের গান। দুর্দান্ত সব আয়োজন চলছিল রাজপথ জুড়ে। মেলবোর্ন পুলিশ আমাদের পথ চলায় যাতে কোন সমস্যা না হয় সেজন্য যানবাহন নিয়ন্ত্রন থেকে শুরু করে সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন। পুলিশেরাও আমাদের পথ চলায় যেনো আনন্দ উপভোগ করছেন। তাদের আন্তরিকতা এবং চেষ্টা বরাবরই আমাদের মুগ্ধ করছিলো।

শোভাযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে উঠা লায়ন সদস্যদের শুকনো খাবার এবং পানি দেয়া হচ্ছিলো। এগুলো উদ্যোক্তারাই আয়োজন করে রাখেন। কোথাও কোথাও লায়ন সদস্যরা উপহার সামগ্রিও বিতরণ করছিলেন। বিশেষ করে লায়নিজমের বিশ্বনেতৃত্বে যারা আসতে চান, তারা ডেলিগেটদের মন পাওয়ার জন্য লায়নিজমের লোগো লাগানো হালকা উপহার সামগ্রি প্রদান করেন। এখানেও নানা বুথ থেকে লায়ন সদস্যদের ডেকে ডেকে উপহার এবং খাবার দেয়া হচ্ছিলো।

বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শেষে আমরা গিয়ে সামিল হয়েছিলাম বিশাল এক কনভেনশন সেন্টারে। দুর্দান্ত একটি সেন্টার। কয়েক হাজার লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সেন্টারটিতে লায়ন সদস্যরা গিজগিজ করছিলেন। আমরা রেজিস্ট্রেশন আগেই করেছি। এখন পৃথক পৃথক বুথে গিয়ে আমাদের আইডি কার্ড, স্যুভেনির তুলে নিলাম। এতো গোছানো সব আয়োজন! সবকিছুই যেনো একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রচুর মানুষ, কিন্তু কোথাও কোন হাঙ্গামা নেই, ধাক্কাধাক্ষি বা ঠেলাঠেলি নেই। বুথের সামনে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরমটি দেয়ার সাথে সাথে আইডি কার্ড প্রিন্ট করে দেয়া হচ্ছে। ছবিযুক্ত নাম এবং পদবী লেখা সেই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঢুকে পড়ছেন হলরুমে। বিশাল হলরুম কানায় কানায় ভর্তি। ঢাউশ সাইজের স্টেজের পেছনে ডিজিটাল স্ক্রিন, হলের মাঝখানেও কয়েকটি স্ক্রিন স্থাপন করা হয়েছে। মঞ্চে যা করা হচ্ছে তা স্ক্রিনে অনেক বড় আকারে দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি দেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেক দেশের জাতীয় সংগীতকে সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। যখন যে দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছিলো, তখন সেই দেশের জাতীয় পতাকা উড়ছিল স্ক্রিনে। আমাদের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের সময়ও পুরো হল দাঁড়িয়েছিল। কী যে ভালো লাগছিল! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজন্মের দায় তো শিশুর নয়, আসুন তাকে সস্নেহে বরণ করি
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে মহান শিক্ষা দিবস