(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অস্ট্রেলিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের ভিতরে এদিক–ওদিক ঘুরছিলাম। চিত্রকলা, শিল্পকলার কিছু না বুঝলেও রঙের খেলা দেখতে খারাপ লাগছিল না। কী সুন্দর করেই না অতীত এবং বর্তমানকে ধরে রাখা হয়েছে। মেলবোর্নের এই আর্ট মিউজিয়ামের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে গুণী শিল্পীদের নানা কাজ, রকমারি শিল্পকর্ম। কত ধরণের শিল্পকর্ম যে দেখলাম!
মিউজিয়ামের ভেতরে একটি লাইব্রেরিও পাওয়া গেলো। সেখানে অনেকেই বসে বসে বই পড়ছেন। পড়ার অভ্যাস আমাদের দেশ থেকে প্রায় উবে যেতে বসলেও পৃথিবীর বহুদেশেই এখনো মানুষ ব্যাগ গোছানোর সময় কয়েকটি বইও সাথে নেয়। বাসে ট্রেনে প্রচুর লোককে মাথাগুঁজে বই পড়তে দেখা যায়, ভালো লাগে।
লাইব্রেরির কাছেই পাওয়া গেলো একটি ক্যাফে। ক্যাফে দেখে টের পেলাম যে আমার গলা শুকিয়ে গেছে, ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। এতোক্ষন ধরে হাঁটছি, গলা শুকানো স্বাভাবিক। এক বোতল পানির সাথে এক মগ কফিও নেবো কিনা চিন্তা করলাম। আমি পানি এবং কফি নিলাম। এই ধরনের স্থানগুলোতে পানি এবং কফির দাম বাড়তি নেয়া হয়, কিন্তু এখানে মনে হলো ঠিকঠাকভাবেই নিয়েছে। ক্যাফের সামনে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ওখানে বসে অনেকেই কাগজে কি কি সব লিখছিলেন, কেউ কেউ ছবি আঁকছিলেন। ছবি আঁকার চেষ্টা করবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে একথা ঠিক যে, জীবনে কোনদিন আমার দ্বারা ছবি আঁকা হয়নি। স্কুল কলেজের বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকেল খাতার ছবিগুলোও বন্ধুদের দিয়ে আঁকিয়ে নিতাম। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি মানুষ দেখছিলাম। কত যে মানুষ, কতকিছু যে তারা করছে! কোথাও কোথাও জটলা। গ্রুপ ট্যুরে আসা নারী পুরুষদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন গাইড। তিনি এমনভাবে হাত নেড়ে নেড়ে বুঝাচ্ছিলেন এবং পর্যটকেরা যেভাবে উনার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রয়েছেন তাতে আমার মনে হলো যে একজন গাইডের সহায়তা পেলে পুরো বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারতাম! এখন নিজে নিজে কিছু না বুঝে দেয়াল সিনেমা দেখার মতো মিউজিয়াম ঘুরে আফসোস হচ্ছিলো। একজন গাইড নিলে আরো ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে এবং আমার প্রিয় পাঠকদের বুঝাতে পারতাম। তবে মিউজিয়ামে এসেছি অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। এখন আবার গাইড নিয়ে নতুন করে শুরু থেকে শুরু করতে ইচ্ছে করলো না।
অস্ট্রেলিয়ান আর্ট মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ট্রাম স্টেশনের দিকে হাঁটছিলাম। ফিরে যাওয়ার জন্য কত নম্বর ট্রামে চড়তে হবে তা গুগল থেকে জেনে নিলাম। বিজ্ঞান যে পথ চলা কত সহজ করে দিয়েছে তা চিন্তা করতে করতে হাঁটছিলাম। একসময় বিদেশে গেলে কতজনকে জিজ্ঞেস করে পথ চলতে হতো, এখন হাতের মোবাইলেই সব বলে দিচ্ছে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অচিন এবং গোপন বলে আর কিছুই থাকলো না।
অনেক লোক দলবেঁধে হাঁটছে। থেমে থেমে ছবি তুলছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো তারা পর্যটক। এই শহরে নতুন এসেছে। কোথায় যাচ্ছে এতো লোক! তাদের পিছু নিলাম। অল্প পথেই ফুরিয়ে গেলো পথ। এসে দাঁড়ালাম নদীর পাড়ে। ইয়ারা নদী! নামটির সাথে আমার বিশেষ মমত্ব আছে। দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক ভাইয়ের মেয়ের নাম ইয়ারা। মায়াবী মেয়েটি কেন জানি আমাকে ‘আংকেল’ না ডেকে ‘মামা’ ডাকে, আর দেখলেই দৌঁড়ে কাছে চলে আসে।
ইয়ারা নদীর পাড়ে সাজানো হাঁটার পথ, সাইকেল ট্র্যাক, বাগান, নদীকে সামনে নিয়ে বসার জন্য বেঞ্চসহ নানা আয়োজন। ওয়াকওয়েটা এতো সুন্দর এবং পরিস্কার যে চরম আলসে লোকও এখানে এসে হাঁটতে চাইবে। শুধু পরিবেশই নয়, আবহাওয়াটাও চমৎকার। শীত শীত আবহের মাঝে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে হাঁটতে অনেকেরই হয়তো সমস্যা হয়, কিন্তু শীতে যেহেতু আমি কাবু হই না তাই আমার কোন সমস্যা হচ্ছিলো না। আমি হেলেদুলে হাঁটতে লাগলাম। গন্তব্যহীন হাঁটা। নদীটি খুব বড় বলে মনে হলো না, আমাদের ছোট নদীর মতো। তবে বেশ প্রাণবন্ত। নদীর বুকে শত শত ইয়ট, নৌযান। হাজার বছর ধরে বয়ে চলা ছোট্ট নদীটা মেলবোর্ন শহরটিকে যেনো মালার মতো জড়িয়ে রয়েছে। ইয়টগুলোকে মনে হচ্ছিলো সেই মালার মুক্তো। নদীতে অনেকেই নৌকা ভ্রমণ করছেন, ইয়ট নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকেই। ইয়টের রঙিন পালগুলো বিকেলের কনেদেখা আলোয় নদীর বুকে অন্যরকমের আভা ছড়াচ্ছিলো। কেউ কেউ কি মাছ শিকার করছেন? দূর থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।
নদীর উপর খুবই অল্প ব্যবধানে চারটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছিলো। নিশ্চয় আরো ব্রিজ থাকতে পারে। আমার একদম কাছের ব্রিজটির নাম প্রিন্সেস ব্রিজ। শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ব্রিজ দিয়ে প্রচুর গাড়ি ও ট্রাম চলাচল করছে। করছে পথচারী পারাপার। শত শত পর্যটক ব্রিজের উপর থেকে ছবি তুলছে। রাজকন্যা না থাকলেও প্রিন্সেস ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্রিজ থেকে মেলবোর্ন শহরের সুউচ্চ সব ভবন দেখা যাচ্ছিলো। বিকেলের আলোতে ভবনগুলো যেনো হাতছানী দিচ্ছিলো। ব্রিজ থেকে বিপরীত পাশে তাকালে চোখে পড়ে বিস্তৃত সবুজ, পার্ক।
এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখলে মন আরো ভালো হয়ে যাবে বলে মনে হলো। যেহেতু ডিনারে যাবো না, আমার যেহেতু অন্য কোন কাজও নেই তাই এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকলে কিংবা রাত কাটিয়ে ফেললেও কোন সমস্যা হবে না। ফেরার ট্রাম আছে, কোন কারণে ট্রাম মিস করলে উবার কিংবা ট্যাক্সি রয়েছে। সুতরাং হুড়োহুড়ি না করে আমি একটি বেঞ্চে বসে পড়লাম। ধারে কাছে অনেকগুলো দোকান, ক্যাফে। নানা ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছিলো। কোন ধরণের খাবারের প্রতি আগ্রহ না থাকলেও আমি এক মগ ‘কোল্ড কফি’ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন ঠান্ডার মধ্যে কোল্ড কফি? জ্বী, ঠান্ডায় আমার কোন সমস্যা নেই।
ব্রিজ থেকে নেমে সামনে এগুতেই একটি ক্যাফে পেয়ে গেলাম। কোল্ড কফির অর্ডার করলাম। কফির মগটি হাতে নিয়ে হেঁটে গিয়ে বসলাম অপর একটি বেঞ্চে, গাছের ছায়ায়। আলতো চুমুক দিলাম ঠান্ডা কফিতে। দুর্দান্ত স্বাদ। শুধু পেটে নয়, এই স্বাদ আমার মগজেও দোলা দিল। চোখের সামনে ইয়ারা নদী, ভিতরে আনন্দের বন্যা।
সূর্য ডুবতে আর বেশিক্ষণ নেই। লালসে আভায় চারপাশ রঙিন হয়ে গেছে। ইয়ারা নদীর স্বচ্ছ পানি চকচক করছিল। সোনালী আবরণে যেনো চারদিক মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রঙিন সূর্য ডুবে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে একটি দিন। জীবনও বুঝি এভাবেই একটির পর একটি দিন ফুরিয়ে একদিন পুরোটাই ফুরিয়ে যাবে, মিশে যাবে অন্ধকারে!
সূর্য ডুবে গেলো, সন্ধ্যার মিষ্টি একটি আভা চারদিকে। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আমার পরান নেচে উঠলো। সুউচ্চ ভবনগুলো থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো। বিভিন্ন কোম্পানির নিয়ন সাইনেও চলছিল আলোর মাতম। হঠাৎ করে পুরো মেলবোর্ন যেনো আলোর খেলায় মেতে উঠলো। শত শত নারী পুরুষ হাঁটছে, আনন্দ করছে। কেউ কেউ বেঞ্চে উদাস বসে মিলাচ্ছে জীবনের হালখাতা। আমার বেঞ্চটিতে আর কেউ বসেনি। অবশ্য, ধারে কাছে আরো অনেকগুলো বেঞ্চ রয়েছে। সূর্য ডুবে গেলেও কারো উঠার নাম নেই। হাঁটার লোকের যেমন অভাব নেই, অভাব নেই বসে থাকা লোকেরও। নদীর পাড়কে উপভোগ্য করতে সিটি কাউন্সিল আয়োজনের কমতি রাখেনি। নদীর পাড়ের এতো এত্তো মানুষের হরদম আনাগোনা এবং নানা ধরনের খাবার দাবারের উৎসব চললেও কোথাও এক রত্তি ময়লা আবর্জনা নেই। নদীতে কোন ভাসমান পলিথিন নেই, নেই কোন ময়লার কাফেলাও।
আমার কোল্ড কফি শেষ হয়েছে, কাছের বিনে মগটি ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। রাত হয়ে গেছে। ফিরতে হবে। কতদূর এসেছি কে জানে! গুগল করে দেখে নেয়া যায়, তবে ইচ্ছে করলো না। যতদূর যেতে পারি ততই যেনো ভালো বলে মনে হচ্ছিলো। আমি ফিরতি পথ ধরলাম। ফেডারেশন স্কোয়ারে আলোর বন্যা। রাত নাকি দিন তা ঠাহর করতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমাকে ট্রামে চড়তে হবে। কত নম্বর ট্রামে চড়বো তা দেখে নিলাম। কোন স্টপেজে নামতে হবে তাও। ট্রাম স্টপেজে দাঁড়ানোর অল্পক্ষণের মধ্যে নির্দিষ্ট ট্রামটি পেয়ে গেলাম। বেজায় ভিড়। আসার সময় ট্রাম ফাঁকা ছিল, এখন এতো লোক কোত্থেকে আসলো কে জানে! বসার জায়গা নেই। আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। আমিও দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে নিজের গন্তব্যের খোঁজ করছিলাম। ট্রাম ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।