দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ আগস্ট, ২০২৫ at ৪:৫৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বাস থেকে নেমে হোটেলের সামনে দাঁড়ালাম। দুর্দান্ত জায়গা। বিশাল চওড়া রাস্তার পাশে সুউচ্চ সব ভবন। রাস্তার পাশে চমৎকার ফুটপাত, সাইকেল ট্র্যাগ, প্রচুর গাছ। গাছের ছায়ায় ঢেকে আছে রাস্তাসহ আশপাশ। আমাদের কেউ কেউ সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে শহরটির অপরূপ রূপ দেখছিলেন, মন্তব্য করছিলেন। রাস্তা দিয়ে চলছিল বাস, হরেক রকমের গাড়ি। সড়কের মাঝ দিয়ে চলছিল ট্রাম। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ভবন, রাস্তাজুড়ে গাড়ির কাফেলা, ট্রামের সংখ্যাও কম নয়। কিছুক্ষণ পরপরই আসছিল, যাচ্ছিলো। কিন্তু রাস্তায় তেমন কোন পথচারী নেই। মানুষ গিজগিজ করা কিংবা হকারের হাঁকডাক কিছুই নেই। একটি গাড়ির হর্ণ নেই। শোরচিৎকার, চেঁচামেচি নেই। সুনশান নিরবতার মাঝে চলমান এক শহর। আহা, এজন্যই বুঝি এটি বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক এবং বাসযোগ্য শহর!

লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী রুমে চলে গেছেন আগে, বিজয় দাকে নিয়ে আমিও রুমের পথ ধরলাম। রুমে ঢুকে কফি বানিয়ে চুমুক দিতে দিতে টের পেলাম যে, বিজয় দা’ আর জেগে নেই, ঘুমিয়ে গেছেন। একা একা মোবাইল টিপতে টিপতে আমি কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। কিন্তু আচমকা কেমন যেনো অস্বস্তি শুরু হলো। ভাবলাম যে, এতো সাগরমহাসাগর পাড়ি দিয়ে এতোদূর কী ঘুমাতে এসেছি! চার দেয়ালের মধ্যে বসে বসে কফি খেয়েওবা লাভ কি! বিজয় দা’কে আলতো ধাক্কা দিয়ে বললাম, বাইরে যাবো, আপনি যাবেন? বেচারা চোখ খুলতে পারছিলেন না। ঘুমের মধ্যেই হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দিলেন। রুমের চাবির কার্ড নিয়ে আমি বেরিয়ে আসলাম। অবশ্য. রিসিপশন থেকে আমাদের দুইটি ‘কার্ড কী’ দিয়েছে।

রিসিপশনে বেশ সুন্দরী একটি মেয়ে একা বসে আছে। এতো বড় হোটেল, রিসিপশনে কত কাজ। মেয়েটি কী করে যে একা এত্তোসব সামলাবে কে জানে! আমি তার কাছ থেকে একটি হোটেলের বিজনেস কার্ড চেয়ে নিলাম। ধারে কাছে দেখার মতো কি আছে জানতে চাইলাম। তরুণী আমাকে অনেকগুলো নাম বললো। আমি কোনটিই চিনলাম না। হাসিমুখে তরুণী বললো, তুমি এখান থেকে খুবই সহজে ফেডারেশন স্কোয়ারে যেতে পারো। ওখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে ইয়ারা নদীর পাড়েও ঘুরতে পারো। মিউজিয়াম কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে চক্কর মারতে পারো। তোমার মন খারাপ হলে বহু প্রাচীন চার্চে গিয়ে প্রার্থনাও করতে পারো। পরে হাসতে হাসতে বললো, মেলবোর্নে কি দেখার মতো জিনিসের অভাব আছে? তুমি যেদিকে যাবে সেদিকেই কিছু না কিছু পেয়ে যাবে।

মেয়েটি আগ বাড়িয়ে বললো. আমি কি তোমার জন্য উবার কল করে দেবো, নাকি ট্যাক্সি নিয়ে যাবে? অবশ্য, তুমি ফ্রি ট্রামেও যেতে পারো। ওই যে ট্রাম স্টপেজ।

তরুণীর চোখে চোখ রেখে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাম ধরতে এগিয়ে গেলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই মেলবোর্নের বিখ্যাত সিটি ট্রাম পেয়ে গেলাম। শহরের ভিতরে চলাচলকারী এই ট্রাম ফ্রি। কোন ভাড়া নেই। চড়ে বসলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম যে, যেখানে যাবে যাক, শহরতো ঘুরে দেখা যাবে। কোথাও হারিয়ে গেলে উবার নিয়ে হোটেলে চলে আসলে হবে। গুগল মামা যেহেতু সাথে আছে, রোমিং সুবিধার মোবাইল ফোন আছে, সুতরাং ভয় বা চিন্তা করার কি আছে!

ট্রাম চলছে। যাত্রীর ভিড় তেমন একটা নেই। বিকেল এখনো জমে বসেনি। তাই হয়তো রাস্তায় মানুষজন কম। ট্রামে চড়েই এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে নিলাম। ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে স্টপেজের নাম লেখা রুটম্যাপ দেখে স্বস্তি পেলাম। অর্থাৎ আমি ইচ্ছে করলেও আর হারাবো না। স্টপেজে থামার আগ দিয়ে নেক্সট স্টপেজ বলে জায়গাটির নাম বলা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। ট্রাম এগিয়ে চলছিল, আমার গন্তব্য ফেডারেশন স্কোয়ার। বেশ কয়েক স্টপেজ পরে আমাকে নামতে হবে।

একটি জানালার ধারে বেশ আয়েশ করে বসলাম। পাশের সিট খালি। অর্থাৎ দুইসিট নিয়ে ট্রামে চলছি। ছবির মতো সাজানো গোছানো শহরটি দেখতে দেখতে চলছিলাম। রাস্তায় কোন জ্যাম নেই, ট্রামের পাশ দিয়েই বাস যাচ্ছে, যাচ্ছে অন্যান্য গাড়িও। দামি দামি ব্র্যান্ডের সব গাড়ি, চকচকে। কোন পুরাতন গাড়ি চোখে পড়লো না। ধাক্কাধুক্কা খেয়ে এবড়ো থেবড়ো হওয়া কোন গাড়িও নেই। সবকিছু কেমনে যে এমন সুন্দর রাখা যায় কে জানে! মেজাজ পুরোপুরি ফুরফুরে, আনন্দের বন্যা যেনো চারদিকে। নিজেকে কী যে সুখী সুখী লাগছিল! যাত্রীদের দেখছিলাম, সুখী সুখী সব মানুষ। নারী পুরুষ।

আমার স্টপেজ চলে এসেছে। ট্রাম থামার সাথে সাথেই নেমে পড়লামফেডারেশন স্কোয়ার। এটি নাকি শহরের প্রাণকেন্দ্র। প্রচুর মানুষজন, অধিকাংশই পর্যটক। ছবি তোলার ধরণ দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, মানুষগুলোও আমার মতো ঘুরতে বেরিয়েছে। স্কোয়ারের খোলা চত্বরের চারপাশে দারুণ সব ভবন। কফির গন্ধ চারদিক ভরে আছে। উজ্জ্বল সব সাইনবোর্ড, ধারে কাছে অনেক ক্যাফে। পরিচিত কয়েকটি ক্যাফের নামও চোখে পড়লো। শহরের এই অংশে জীবন বেশ গতিময়, নানা ধরনের বাস ও গাড়ির পাশাপাশি রঙিন ট্রামগুলো নজর কাড়ছিল।

ফেডারেশন স্কোয়ারের ঠিক পাশেই বেশ বড়সড় একটি হলুদ রঙের ভবন। এটিই নাকি মেলবোর্নের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনের বড় ঘড়িটা যেনো ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে সময়কে এগিয়ে নিচ্ছিলো। এখানে পেশাদার অনেক ফটোগ্রাফারকে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখলাম। তারা পর্যটকদেরও ছবি তুলে দিচ্ছিলো। অবশ্যই দর্শনীর বিনিময়ে। অনেকেই কফি খাচ্ছেন, কফির মগ হাতে নিয়ে স্কোয়ারে ঘুরতে ভালো লাগবে বলে মনে হলো। আমি একটি ক্যাফেতে ঢুঁ মারলাম। স্টারবাকস আমার প্রিয় ব্র্যান্ড। সুতরাং না নেয়ার কোন মানেই হয় না। অবশ্যই প্যট্রিশিয়া কফির নামও বেশ শুনেছিলাম। তবে আমি স্টারবাকসেই ঢুকলাম। একটি ল্যাটে কফি নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ফ্লিনডার্স স্ট্রিট রেলস্টেশনে ঢুকে আমার চোখ কপালে উঠলো। কী দুর্দান্ত এক অবকাঠামো! ভিক্টোরিয়ান রেনেসাঁ স্টাইলের অসাধারণ সুন্দর একটি ভবন। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম মন ভরিয়ে দিচ্ছিলো। এটিই মেলবোর্নের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। বিশাল এবং ব্যস্ত। এই স্টেশন থেকে মেট্রো এবং নানা গন্তব্যে প্রতিদিন নাকি এক হাজারের বেশি ট্রেন চলাচল করে। এক হাজার ট্রেন!! প্রতি এক দুই মিনিট পর পর ট্রেন ছাড়লে তো এক হাজার ট্রেন হবেই। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এসব ট্রেনে যাতায়ত করে। আমি কফির মগে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করলাম যে, শত শত নারী পুরুষ ছুটছে। এতো বিপুল জনগোষ্ঠী স্টেশনটি ব্যবহার করলেও কোথাও একটু ময়লা পড়ে থাকতে দেখলাম না। পুরো স্টেশনটি ঝকঝক করছে।

ফেডারেশন স্কোয়ারের অপর পাশে চোখে পড়লো বহু বছর আগেকার একটি চার্চে। সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রল। দারুণ স্থাপত্যের চার্চটি যেন বহু বহু বছরের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঙিন কাচের জানালা এবং চার্চের নিস্তব্ধ পরিবেশ মুগ্ধ হওয়ার মতো। মাত্র কয়েক গজ দূরের যে ব্যস্ততা তার ছিঁটেফোঁটাও নেই চার্চে। আমি ভবনের স্থাপত্য এবং কারুকাজ দেখে কিছুক্ষণ সময় পার করলাম।

চার্চ থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগুতেই চোখে পড়লো অস্ট্রেলিয়ান আর্ট মিউজিয়াম। ঢুকে পড়বো নাকি? যাদুঘর দেখার প্রতি আমার লোভ সবসময়ের। তাই হাতের কাছের মিউজিয়ামটি না দেখে চলে যাওয়ার কোন মানে হয়না। ভিতরে ঢুকতে গিয়ে টের পেলাম যে, কোন টিকেট লাগে না। যার ইচ্ছে এখানে ঢুকতে পারে, ঘুরতে পারে। মিউজিয়ামের নানা জিনিস দেখতে পারে। ভিতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত চিত্রকর্ম আর ভাস্কর্য। আমি একটির পর একটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে নানা কিছু দেখতে লাগলাম। শিল্প সংস্কৃতির তেমন কিছু না বুঝলেও অতীত হাতড়ে দেখতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। তাই এখানেও প্রতিটি কক্ষে থরে থরে সাজানো ছিল আমার মুগ্ধতা।

ঐতিহাসিক শিল্পকর্মগুলোতে চোখ আটকে যাচ্ছিলো। ঔপনিবেশিক যুগের চিত্রকর্মগুলো যেন অস্ট্রেলিয়ার অতীত জীবনের গল্প বলছিল। প্রতিটি ক্যানভাসে প্রকৃতি, মানুষ আর শহরের মিশ্রণ ফুটিয়ে তোলার দারুণ এক চেষ্টা করেছেন শিল্পী। কিছু চিত্রকর্মে পাহাড়, নদী, বন আর গ্রামের জীবন চিত্রিত। আজকের বর্ণিল অস্ট্রেলিয়া যে বহু বহুবছর আগেও বেশ রঙিন ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমের সরোবরে নীলকণ্ঠ এক কবি
পরবর্তী নিবন্ধঅনূর্ধ্ব-১৪, ১৬ ও ১৮ ক্রিকেটারদের জ্ঞাতার্থে