দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২০ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:১০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ভরপেট লাঞ্চ করা হলো। খাবারগুলো আসলেই দারুণ ছিল। বিদেশে এসে দেশীয় টাইপের খাবার না খেয়ে লোকাল কোন খাবারের স্বাদ নিতে পারলে ভালো লাগে। খাবারে বৈচিত্র্য থাকে। কিন্তু আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রুপের সাথে ঘুরতে গিয়ে একটি জিনিস বুঝে গেছি যে, বিদেশে বেড়াতে গিয়ে দু’চারদিন পরই বাঙালি ডালআলুভর্তা খোঁজে। চাইনিজ খাবারের জন্য দেশে মুখিয়ে থাকা মানুষটিও চীনে গিয়ে সাদা ভাতের সাথে মাছের ঝোল তালাশ করে। অবশ্য, অথেনটিক চাইনিজ ফুড খাওয়া এতো সহজ কথা নয়। আমাদের দেশে চাইনিজ ফুডের নামে যা বিক্রি হয় তা চীনা হোটেল রেস্তোরাঁয় খুঁজে পাওয়া যায় না।

ট্যুর অপারেটর বললেন, চাইলে আমরা ধারে কাছে একটু ঘোরাঘুরি করতে পারি। আধাঘন্টার মধ্যেই আমাদেরকে নেয়ার জন্য বাস আসবে। আমি বুঝতে পারলাম যে, আধা ঘন্টা মানেই ত্রিশ মিনিট। এক মিনিটও এদিকওদিক হবে না। উন্নত দেশগুলোতে সময়ের এক দুর্দান্ত ব্যবহার দেখেছি। ট্রেন স্টেশনে যান, এক মিনিট এদিক ওদিক হওয়ার জোঁ নেই। বাস কাউন্টার এমনকি রাস্তার পাশে যেই বাস্টস্টপেজ সেখানেও ডিসপ্লেতে লেখা সময়েই বাস হাজির হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, এক মিনিটও এদিকওদিক হতে আমি ইউরোপআমেরিকাচীনজাপানহংকং কিংবা তাইওয়ানে দেখিনি। দেখিনি অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও। ওইসব দেশে ঘড়ির কাঁটা ধরে বাস ট্রেন চলে, নাকি বাস ট্রেনের চাকায় ভর করে ঘড়ির কাটা ঘোরে তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে একটি জিনিস খুবই ভালো করে বুঝেছি যে, সময়কে ঠিকঠাকভাবে মূল্যায়ন কিংবা কাজে লাগাতে পেরেছে বলেই দেশগুলো এমন উন্নতি করেছে। কোন দেশ আমাদের থেকে একশ’ বছর, কোন দেশ দুইশ’ বছর আবার কোনটিবা পাঁচশ’ বছর এগিয়ে রয়েছে। এগিয়ে থাকার এই যে ‘সময়’ সেটা তারা সময়কে মূল্য দিয়েই করতে পেরেছে।

পিএইচডি স্টুডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। বেশ ঠান্ডা বাইরে। আমাদের পাতাঝরা শীতকালের মতো। তবে পরিবেশ এবং প্রকৃতি দুটোই আমার ভালো লাগছিল। শীতে আমি কখনো কাবু হই না, তাই শীত নিয়ে আমার কোন টেনশন নেই। আমার রক্তে এমন কিছু উপাদান হয়তো আছে যা আমাকে তীব্র শীতেও ঠিকঠাক থাকতে সহায়তা করে। এতে করে বরফের রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতেই আমি হ্যাগেন দাজের আইসক্রিম সাবাড় করতে পারি।

রেস্টুরেন্টের সামনেই চমৎকার আবহ। ফুটপাত, সাইকেলের রাস্তা, তারপরে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। ডিভাইডার দেয়া ওয়ানওয়ে সড়ক। চার লেনের। মেডিয়ানে গাছ, ফুটপাতে গাছ। গাছ যেনো চারদিকে। ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা রাস্তা। আহা, এমন একটি ফুটপাতের জন্য আমাদের আরো কত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে! বুক ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে দেখলাম, এক অপূর্ব পরিবেশ, এক মায়াবী আবহ। কী যে সুন্দর চারপাশ, কী যে গোছানো। ফুটপাতে বেঞ্চ পাতা, হাঁটতে হাঁটতে কোন পথচারীর যদি একটু জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে তাহলে গাছের ছায়ায় স্থাপিত বেঞ্চটি বসা যাবে। সাইকেলের রাস্তা আলাদা। ওই রাস্তা ধরে সাইকেল নিয়ে ছুটছেন ছেলে বুড়ো। নারী পুরুষ সমানতালে সাইকেল চালাচ্ছেন। কারো দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, ইভ টিজিং নেই। হাত ধরে টানাটানি নেই। তবে হাতে হাত রেখে পথচলা আছে।

লায়ন ফজলে করিম লিটন, ডালিয়া ভাবী এবং লায়ন বিজয় শেখর দাশসহ আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। টাইলস করা ওয়াকওয়ে, পাশে অসংখ্য ফুলের গাছ, মাঝে মাঝে বড় বড় অচিন গাছ। সবকিছু মিলে একটি রোমান্টিক আবহ চারদিকে। যেনো কোন পার্কের ভিতরে হাঁটছি। আগেই বলেছি যে, যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, পুরো মেলবোর্ন শহরটিই যেনো একটি পার্ক।

রাস্তার অদূরে বড় বড় ভবন, আধুনিক ডিজাইনের সাথে ব্রিটিশ স্থাপত্য মিলিয়ে অন্যরকমের এক নান্দনিকতা ভবনে ভবনে। এসব ভবনের কোনটিতে অফিস, কোনটিতে মল। কোনটিতে ফ্ল্যাট। চশমার দোকান, ঘড়ির দোকান, কাপড়ের শপসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড দেখা যাচ্ছিলো। কেনাকাটার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই, ওসব নিয়ে নেই মাথাব্যথাও। তাই আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছি, আমাদের ভাবখানা এই যে, যতটুকু সম্ভব দেখে ফেলি।

মেলবোর্ন আসছি শুনে চট্টগ্রামেই আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, মেলবোর্ন এক ‘মারাত্মক’ শহর। আমি তো ভড়কে গিয়েছিলাম। বন্ধু এমনভাবে ‘মারাত্মক’ বলেছিলেন যে, আমার মনে হলো বুঝি মেক্সিকো যাচ্ছি। আমার চেহারার পরিবর্তন দেখে বন্ধু তৎক্ষণাৎ শুধরে নিয়ে বলেছিলেন, আসলে মেলবোর্ন দারুণ একটি শহর। এই শহরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ওখানকার মানুষের উষ্ণতা আর সহনশীলতা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসী আর পর্যটকেরা এখানে শান্তিতে সহাবস্থান করছে। শহরটিতে আপনি এক কোণে পাবেন ইতালিয়ান ক্যাফে, আরেক কোণে চাইনিজ টেকওয়ে, পাশেই ভারতীয় বা বাংলাদেশি দোকান। সবকিছু মিশে গেছে একসাথে। মানুষগুলো খুবই হেল্পফুল, সাহায্য করার জন্য যেনো এক পা বাড়িয়ে থাকেন।

রেস্টুরেন্টের কথা মনে পড়ল। ওখানে খদ্দেরদের মধ্যে কেউ উর্দু কেউ ইংরেজি, কেউ আবার হিন্দিতে কথা বলছিল। আবার আমরা বাংলায় কথা বলে গল্প করতে করতে খাবার খেয়েছি। সত্যিই তো, বৈচিত্র্য আছে।

মানুষ হেল্পফুল কিনা তা পরখ করার জন্য ফুটপাত ধরে বেশ দ্রুত এগিয়ে আসা এক ভদ্রলোককে দাঁড় করালাম। আমার পকেটে থাকা হোটেলের বিজনেস কার্ডটি দেখিয়ে বললাম যে, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। কি করে যাবো? ভদ্রলোক স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন। তারপর আমার দেয়া কার্ডের ঠিকানা দেখে মোবাইলে নেভিগেশন চালু করলেন। আমাকে এই ফুটপাত কোনপথে কতটুকু গেলে কত নম্বর বাস ওটা থেকে কোথায় নেমে ট্রামে চড়লে কি করে হোটেলে পৌঁছাবো তার বিস্তারিত বলে দিলেন। শেষে বুঝেছি কিনা, যেতে পারবো কিনা নিশ্চিত হতে চাইলেন। আমি খুব মুগ্ধ হয়ে তার দিয়ে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি যেভাবে ফুটপাত ধরে ছুটে যাচ্ছিলেন তাতে আমার মনে হয়েছিল যে, ভদ্রলোকের কাজের তাড়া আছে। কিন্তু এমন তাড়ার মাঝেও তিনি এতোক্ষণ সময় নিয়ে আমাকে হোটেলে পৌঁছানোর যে কসরত করলেন, তা সত্যি অতুলনীয়।

আমরা হোটেলে ফিরতে পারবো এটা নিশ্চিত হয়ে ভদ্রলোক সামনে এগুলেন। এগুলেন না বলে, দৌঁড়ালেন বলাই ভালো। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, তিনি আগের চেয়ে বেশি বেগে হাঁটছেন। যেনো আমার জন্য দেয়া সময়টা পুষিয়ে নিতে পারেন।

আমরা ফিরতি পথ ধরে রেস্টুরেন্টের কাছাকাছিতে অবস্থান করতে লাগলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস হাজির হলো। আমরা বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের ট্যুর অপারেটর প্রত্যেকের মাথা গুনলেন। সবার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে তিনি বাস ছাড়তে বললেন। আমরা হোটেলের দিকে যাত্রা করলাম।

আমাদের পাশ দিয়ে একটি ট্রাম যাচ্ছিলো। একই রাস্তা ধরে ছুটছে ট্রাম এবং বাসসহ রকমারি গাড়ি। কিন্তু রাস্তায় কোন স্লো গাড়ি নেই, কোথাও যানজট নেই। মোড়ে মোড়ে জটলা নেই। ছায়া ঢাকা পাখী ডাকা ঝকঝকে রাস্তায় শতবর্ষী ট্রাম। অপূর্ব স্থাপত্যে মোড়ানো অসংখ্য ভবন, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতায় ভরা আধুনিক, পরিপাটি এক সমৃদ্ধ নগরী। শহরের নানা অংশ দেখতে দেখতে আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম।

বাস থেকে নামার সময় ট্যুর অপারেটর বললেন, বিকেলটা নিজেদের মতো করে কাটান। আমরা ঠিক ছয়টায় ডিনারে যাবো। এখানে বাস আসবে। আমরা লাঞ্চের মতো ডিনারেও একসাথে যাবো বলে বিদায় নিলেন ট্যুর অপারেটর।

ছয়টার সময় ডিনার!! পিলে চমকে উঠলো। এখন দুইটা বাজে, ছয়টায় কি আবার খাওয়া সম্ভব! আমি লায়ন করিম ভাইকে রাতে খাবো না বলে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। লায়ন বিজয় দা’ও আমার মতো রাতের জন্য না করে দিলেন। করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী বললেন, তাহলে আমরাও যাবো না। রাতে ফল টল কিছু একটা খেয়ে নেবো।

আমরা চট্টগ্রামের চারজন রাতে ডিনারে যাবো নালিখে গ্রুপে পোস্ট করে দিলাম। আমাদের সবাইকে নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করা হয়েছে। সেখানে আমরা অনেককিছু শেয়ার করি, সবাই সবার সাথে হাসি ঠাট্টা থেকে শুরু করে নানাভাবে যুক্ত থাকি। আমরা চারজন ডিনারে যাবো না লেখার পর আরো কয়েকজনকে দেখলাম একইভাবে ‘না’ করতে। আমার মনে হলো, সবাই যদি এভাবে না করে দেন, তাহলে ট্যুর অপারেটর বেজায় খুশী হবেন!! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর মানসিক বিকাশে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ