(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওড়ছি আকাশে। ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে নয় নয়টি ঘন্টা। একটি একটি প্রহর হিসেব করে কী যে যন্ত্রনার এক জার্নি। এমনিতেই বিমান জার্নির মতো কষ্টকর জার্নি আর দ্বিতীয়টি আছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। বিশেষ করে ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের লং রুটের ফ্লাইটগুলোতে কষ্টের সীমা থাকে না। সময়কে জয় করার জন্য বিমানে চড়তে হয় ঠিকই, কিন্তু সময় সাশ্রয়ের এই বিষয়টি শরীরটাকে যে কী করে যায় তা বলে বুঝানো যাবে না। একেবারে কাবু করে দেয়। হংকং থেকে টানা নয় ঘন্টা আকাশে ওড়ে মেলবোর্ন পৌঁছার পর আমারও নিজেকে তেমন কাবু লাগছিলো। এতো বেশি কাহিল লাগছিল যে মনে হচ্ছিলো, পা দুটি সামনে চালাতে হিমশিম খাবো।
কিন্তু পাইলটের বহুল প্রত্যাশার ঘোষণায় আমি যেনো হুট করেই চাঙ্গা হয়ে গেলাম। ‘ ক্যাবিন ক্রু, প্রিপেয়ার ফর ল্যাণ্ডিং’। ক্রুদের অবতরণের প্রস্তুতি মানেই যাত্রীদেরও অবতরণ। অতএব বুঝতে পারলাম যে, অসাড় হয়ে উঠা পা দুটি বাড়ালেই স্বপ্নের অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মাটি!
বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দূরে মেলবোর্ন শহর তখন ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। ধোঁয়াটে আলোর রেখা যেন ছড়িয়ে পড়েছে বিশাল সবুজ প্রান্তরে। হংকংয়ের ঝলমলে ব্যস্ততার বিপরীতে মেলবোর্ন যেনো এক শান্ত, নরম পৃথিবী। শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মনের মধ্যে অদ্ভুত এক উত্তেজনার ঢেউ। নিচে মেলবোর্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টুলামারিনের রানওয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল।
একটা আলতো ধাক্কা, ছোট্ট একটু দুলুনি, তারপর আমাদের উড়োজাহাজ মাটি ছুঁয়ে ছুটতে লাগলো। অস্ট্রেলিয়ার মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথেই আমার ভিতরটা যেনো নেচে উঠলো। তবে এই আনন্দ কী নিরাপদে অবতরণের, নাকি নয়া মহাদেশে আসার তা বুঝতে পারছিলাম না।
বিমান থেকে বোর্ডিং ব্রিজ ধরে টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ করলাম। টার্মিনালে পা রাখতেই শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে গেল। এতো ঠান্ডা করে রেখেছে কেন? এসি কত ডিগ্রি টেম্পারেচারে চালাচ্ছে! কিন্তু হঠাৎই খেয়াল হলো যে, পাইলট বাইরের তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলেছেন। এমন ঠান্ডার মধ্যে এসি চালানোরই দরকার হয় না, হিটার দিয়ে হয়তো তাপমাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা নেমেছি দুই নম্বর টার্মিনালে। চওড়া করিডোর পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি ইমিগ্রেশনের দিকে। শত শত মানুষ, আরো কতটি ফ্লাইট নেমেছে কে জানে! সবাই ছুটছেন ইমিগ্রেশনের দিকে, কেউবা ট্রানজিটে। তবে কোথাও হুড়োহুড়ি নেই, নেই হৈ চৈ বা চিৎকার চেঁচামেছি। অসাধারণ এক শৃংখলার মধ্য দিয়ে বিমানযাত্রীরা ছুটছেন নিজেদের পথে। কেউ কেউ পাশ কাটিয়ে আগে চলে যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ‘সরি’ বলতে কিন্তু ভুলছিলেন না।
কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সূর্য ধীরে ধীরে মেলবোর্নের আকাশ ছুঁয়ে উঠছে। চারদিক ভরে গেছে দিনের আলোতে। কিন্তু টার্মিনালের ভিতরে আলো আর ছায়ার খেলা বেশ নজর কাড়ছে। পুরো টার্মিনাল যেনো এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। টারমাকে রাখা এয়ারক্রাফটগুলো সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। কত দেশে কত শত ফ্লাইট কত মানুষকে নিয়ে যে এই বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করবে কে জানে! কত মানুষই না যাবে স্বপ্নের কাছাকাছি।
মেলবোর্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। স্থানীয়ভাবে টুলামারিন বিমানবন্দর নামে পরিচিত। এটি অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নে অবস্থিত। এটিই এই শহরের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৭০ সালের ১ জুলাই মেলবোর্ন বিমানবন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। প্রথম বছরেই এই বিমানবন্দর ৬টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনের ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৭৫ আন্তর্জাতিক যাত্রী হ্যান্ডলিং করেছিল। আর গতবছর এই বিমানবন্দর দিয়ে বিশ্বের নানা গন্তব্যে যাতায়াত করেছেন ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৯৬৭ জন যাত্রী। গতবছর এই বিমানবন্দরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪১টি ফ্লাইট অপারেটর করা হয়েছে। ২ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমি জুড়ে গড়ে তোলা টুলামারিন অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলির একটি। এই বিমানবন্দরে ৩ নম্বর রাণওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। ২০৩৮ সালে নাকি এই বিমানবন্দর দিয়ে ৭ কোটি যাত্রী বিশ্বের নানা দেশে যাতায়াত করবেন। তখন এই বিমানবন্দরে অন্তত ৪ লাখ ফ্লাইট অপারেট করা হবে।
ইমিগ্রেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি। বুকের ভিতরে টিপটিপ করছিল। যদিও আমার পাসপোর্টে অস্ট্রেলিয়ার তিন বছরের মাল্টিপল ভিসা রয়েছে, তবুও বুক দুরুদুরু করছিল যে, ইমিগ্রেশন অফিসার মেলবোর্নে ঢুকতে দেবেন, নাকি ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন করে দেন!
ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। অনেকগুলো ডেস্ক,বহু অফিসার বসে আছেন। পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা করে যাত্রীদের ইশারায় এক্সিট ওয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। আমার সামনে বহু মানুষ। আমি বেশ শক্ত করে আমার সবুজ পাসপোর্টটি ধরে রেখেছি। এত দূরের পথ পেরিয়ে, এতো এতো সময় পার করে এসেছি, এখন শুধু মিনিট কয়েকের অপেক্ষা!
ইমিগ্রেশন অফিসার নারী, বয় কার্ট চুল। চাহনীতে দারুণ স্মার্টনেস, ধবধবে ফর্সা। অস্ট্রেলিয়ান নারীরা সুন্দরীই হয়ে থাকে। কাচের ভিতরে বসা নারী অফিসারের দিকে আমি পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিলাম। জানতে চাইলেন কোথায় যাবো, কোথায় থাকবো। পাসপোর্টের সাথে দেয়া আমার এম্বারকেশন ফরমে সবকিছু উল্লেখ আছে। তবুও কথা না বাড়িয়ে আমি হোটেল বুকিংসহ সব কাগজপত্র বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আর কিছু না বলে কম্পিউটারে কি কি সব টিপলেন, আমাকে পাসপোর্টটি বাড়িয়ে চোখের ইশারায় সামনে যেতে বললেন। পাসপোর্টে কোন সীল দেয়া হলো না, আমি যে মেলবোর্নে এসেছি তার কোন প্রমাণ পাসপোর্টে থাকলো না। আমি একটি সীল দেয়ার অনুরোধ করলাম। তিনি হাসলেন, একেবারে মন ছোঁয়া হাসি। বললেন, ‘আই উড লাভ টু স্ট্যম্প ইট, বাট আই হ্যাভ নাইদার দ্য সিস্টেম নর দ্য স্ট্যাম্প।’ আমি হেসে উঠলাম। তিনি সীল দিতে ভালোবাসেন,কিন্তু সীল দেয়ার সিস্টেম নেই, তার কাছে সীলই নেই। আমি থ্যাঙ্কু বলে সামনে এগুনোর সময় তিনি বেশ মিষ্টি করে বললেন, ‘ওয়েলকাম টু মেলবোর্ন’।
তরুণী ইমিগ্রেশন অফিসারের হাসিমাখা মুখের শুধু তিনটি শব্দ, অথচ মনে হলো, কোনো এক মহাসমুদ্র পেরিয়ে আমি নতুন এক জীবনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি।
ব্যাগেজ বেল্টে এসে দেখি এলাহী কারবার। অনেকগুলো বেল্ট। বেশ কয়েকটি চলছে। আমাদের লাগেজ কোন বেল্টে দেয়া হয়েছে তা মনিটরে দেখে নিলাম। নির্দিষ্ট বেল্টে গিয়ে দাঁড়ালাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং বিজয় শেখর দা’ ট্রলি যোগাড় করে আনলেন। এই ট্রলি মাগনায় নাকি কড়ি দিয়ে নিতে হয়েছে জানি না। বিশ্বের বহুদেশেই ট্রলি ফ্রি নেয়া যায়, তবে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে ট্রলির পেটে আগে ডলার বা পাউন্ডের কয়েন দিতে হয়। মাটির ব্যাংকের মতো ছোট্ট মুখটিতে কয়েন দেয়ার পরই কেবল ট্রলির চাকা ঘুরে। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ট্রলির চাকা মাগনায় নাকি কড়িতে ঘোরে সেটা জানা হয়নি। দুইটি ট্রলিতে আমাদের চারটি লাগেজ অনায়াসে হয়ে যাবে বিধায় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করারও কিছু ছিল না। কারোসেলের উপর দিয়ে একটার পর একটা ব্যাগ আসছে। মানুষের মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবু কোথাও একটা চাপা আনন্দ লুকিয়ে আছে। সবাই জানে, এই মাটিতে তাদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কারো জন্য ভালোবাসা, কারো স্বপ্ন ধরা দেয়া, কারো বা নতুন জীবন শুরু হওয়া। আবার কারো জন্য নতুন দেশ দেখা, মহাদেশ স্পর্শ করা। মেলবোর্নের লাগেজ বেল্ট বেশ প্রশস্ত এবং পরিপাটি। আমাদের লাগেজগুলো একটির পর একটি এসে পৌঁছালো। সবগুলো লাগেজ যেনো একই সারিতে ছিল। লাগেজ চারটি দুই ট্রলিতে নিয়ে তার উপর ক্যাবিন ব্যাগ বসিয়ে সামনে এগুলাম। কোনো ধাক্কাধাক্কি বা বিশৃঙ্খলা নেই।
পাশে কাস্টমস চেক করার গেট। এখানে ‘ডিক্লেয়ার’ এবং নাথিং টু ডিক্লেয়ার দুইটি লাইন করে রাখা। আমাদের যেহেতু ঘোষণা দেয়ার মতো কিছু নেই তাই সরাসরি বেরিয়ে এলাম। গেট পার হওয়ার সময় কাস্টমস বা অন্য কেউ আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। বাইরে মেলবোর্নের মুক্ত বাতাসে পা রাখলাম। আমি সত্যি সত্যি এক নতুন মহাদেশে এসে পড়েছি। আমার গাল ছুঁয়ে গেলো শীতল হাওয়া। বেশ মোলায়েম করে যেনো আদর দিয়ে গেলো। বেশ স্পর্শ করে গেলেও এই ঠান্ডা তীব্র নয়, উপভোগ্য। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।