(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জৌলুশ দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট গেটে পৌঁছে গেলাম। বিশাল এবং ব্যস্ত বিমানবন্দরের এই এক অসুবিধা, ট্রানজিটের গেট খুঁজে পেতে রেলে–বাসে চড়তে হয়। কখনো ছুটতে হয় দোতলায়, কখনোবা নিচতলায়। নানা পথ মাড়িয়ে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত গেটের দর্শন মিলে। আবার কখনোবা দেখা যায় যে, একেবারে পাশের গেটটিতেই পরবর্তী ফ্লাইটের এয়ারক্রাফট অপেক্ষা করছে। কী যে শান্তি লাগে!
আমাদের বোর্ডিং শুরু করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মেলবোর্নগামী ক্যাথে–প্যাসিফিকের বোয়িংটি বিশাল দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোর্ডিং ব্রিজের দরোজা খুলে দিলেই আমাদের সকলকেই অনায়াসে সে পেটে নিয়ে নেবে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এয়ারলাইন্সের তরুণী কর্মকর্তাকে গিয়ে বোর্ডিং কার্ডটি দিলাম। কার্ডের পেছনে সেঁটে দেয়া লাগেজ ট্যাকটি দেখিয়ে সেটি ঠিকঠাকভাবে বিমানের পেটে চালান হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম। বেচারি বেশ খুশী হয়ে হাতের ট্যাবে বিষয়টি চেক করে দেখলেন, চোখ ইশারায় আশ্বস্ত করলেন আমাকে। আমি নিশ্চিত হয়ে বিমানে চড়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বিশাল বোয়িংটি আমাদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে। রানওয়ে ধরে এগুচ্ছে ধীরলয়ে। সিগন্যাল পাওয়ার পর বিমানটি তীব্র শব্দে মনে হয় গর্জে উঠলো। যথারীতি গা ঝাড়া দিয়ে এমনভাবে দৌড়তে শুরু করলো যে, কিছুটা ভয়ও লাগলো। আলতো করে আকাশে ডানা মেলে দেয়ার পর সেই ভয় উবে গেলো। হংকংয়ের ঝলমলে আলোগুলো ক্রমে ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছিলো, রাতের আকাশ যেনো নেমে আসছিল নিচে। নিচে ছোট ছোট দ্বীপ, মাঝখানে সাগর, আর ওপরের দিকে শুধুই তারাভরা আকাশ। আকাশজুড়ে আলো আঁধারীর খেলা ততক্ষণে শুরু হয়েছে।
বোর্ডিং করার সময় বরাবরই আমি জানালার পাশের একটি সিট চেয়ে নিই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের চারজনকেই একই রো’তে দেয়া হয়েছে। বিমানটিতে আমাদের ঢাকা–চট্টগ্রামের অন্তত ৩০ জন লায়ন সদস্য রয়েছেন। তাই ভিনদেশি বিমানটির যাত্রীদের সিংগভাগ অচেনা হলেও কেমন যেনো নিজের নিজের মনে হচ্ছিলো।
বিমানের ভিতরে আলো ম্লান করে দেয়া হলো। রাতের ফ্লাইট, যাত্রীদের ঘুমানোর জন্য কিছুটা তাড়াতাড়িই যেনো আলো কমিয়ে দেয়া হলো। অন্তত ৩৫ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে বিমানটি যেনো স্থির হয়ে গেলো। আমি জানালায় চোখ দিয়ে বসে আছি, বাইরে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও এক অসীম আকাশ যেনো আমাকে তার বুকে ঠাঁই দিয়েছিল।
বিমানের কেবিনে আলো জ্বলে উঠলো। দারুণ সুন্দরী সব কেবিন ক্রুদের ছুটাছুটিও বৃদ্ধি পেলো। তারা নরম ভঙ্গিতে পা চালাচ্ছিলো, পরিবেশন করছিল খাবার। এই ধরনের বিদেশী এয়ারলাইন্সের টিকেট করার সময় খাবারের ক্ষেত্রে বাছ–বিচার করার সুযোগ থাকে। ‘মুসলিম ফুড’ নোট লিখে দিলে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।
আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, কেবিন ক্রু’রা লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী এবং আমার জন্য আগে ভাগে খাবার নিয়ে এলো। বুঝতে পারলাম যে, এগুলো মুসলিম ফুড। প্যাকেট খুলে ভাতের সাথে সবজি, মাছ এবং ম্যাশ পটেটো পাওয়া গেলো। ম্যাশ পটেটোকে আমার আলু ভর্তার আধুনিক সংস্করণ মনে হয়। একটি লেটুস পাতাও দেখা গেলো। ডিনার শেষ করে আমি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম। নিচের অন্ধকারে চোখ রেখে মনে হলো, হয়তো এই মুহূর্তে আমাদের নিচে ইন্দোনেশিয়ার কোনো দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একজন আমাকে বলেছিলেন যে, সাগরের ওপারেই অস্ট্রেলিয়া! ওইদিন সাগর সাঁতরে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য আমার ভিতরে একটি হাহাকার টের পেয়েছিলাম। আজ আমি সত্যি সত্যি সেই অস্ট্রেলিয়ার পথে!
সামনের সিটের পেছনে মনিটর। রিমোট টিপে সেখানে ইচ্ছেমতো সিনেমা বা গান শুনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সবাইকে এয়ারফোন দেয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে চাদরও। গায়ে চাদর জড়িয়ে একটি সিনেমা দেখার জন্য মনিটর অন করলাম। কোন বাংলা সিনেমা বা নাটক আছে কিনা দেখলাম, নেই। কখনো থাকে না। হিন্দি এবং ইংরেজি সিনেমার জয়জয়কার। রয়েছে চাইনিজ সিনেমাও। আমি খুঁজে একটি এ্যাকশনধর্মী চাইনিজ সিনেমা চালিয়ে দিলাম। চীনাদের ক্যারাটে আমার কাছে দুর্দান্ত লাগে।
বিমানের কেবিনের আলো আবারো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। রাতের যাত্রা বলেই হয়তো আশেপাশের প্রায় যাত্রীই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি কিন্তু ঘুমোতে পারছিলাম না। ভিতরে এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করছিল। অস্ট্রেলিয়ার সফর নিয়ে আমার কল্পনাগুলো কেবলই ঢালপালা বিস্তার করছিলো। বিমানের শব্দ, অল্পস্বল্প আলো, আর নীল আকাশজুড়ে মেঘের ওড়াওড়ি আমাকে এক অন্যরকম আবেশে জড়িয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছিলো। চীনা তরুণ–তরুণীর মারদাঙ্গা টাইপের ক্যারাটে দেখার চেয়ে আমি চোখ বন্ধ করে অস্ট্রেলিয়ার সাগরপাড় কল্পনা করতে যেনো বেশি আরাম পাচ্ছিলাম। সিডনি অপেরা কিংবা সিডনি হারবার ব্রিজ যেনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। অবশ্য, আমি যাচ্ছি মেলবোর্নে, সেখান থেকে সিডনি বহুদূর!
হংকংয়ে বিমানে ওঠার পর থেকেই যেন এক দীর্ঘ রাতের গল্প শুরু হয়। প্রায় ৯ ঘণ্টার ফ্লাইট, কত সাগর মহাসাগরের উপর দিয়ে যাত্রা। জানালার ওপাশে কেবল অন্ধকার আর আকাশের মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠা তারা। মাঝেমধ্যে ককপিট থেকে ঘোষণা আসে, পাইলট নানা ধরনের তথ্য জানান। অবশ্য, ইচ্ছে করলে এসব তথ্য সিটের সামনের মনিটরেও দেখা যায়। দেখা যায় ফ্লাইটের অবস্থানও।
পাইলট ককপিট থেকে ঘোষণা দিলেন, আমাদের বিমানটি ৩৯ হাজার ফিট উচ্চতায়, বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের আরো ৫ ঘন্টার মতো লাগবে। আবহাওয়ায় সামান্য সমস্যা রয়েছে। এয়ার গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই যাত্রীদের সিল বেল্ট লাগিয়ে রাখার অনুরোধ করা হলো।
মনিটরে সিনেমা চলছিল। দারুণ রোমান্টিক ছবি। প্রেমের জন্য মারামারি কিংবা খুনোখুনি মনে হয় সব সমাজেই রয়েছে। চীনা এই সিনেমাটিতেও প্রেমের জন্য হরদম মারামারি হচ্ছে। আমাদের বাংলা সিনেমাতেও হয়। হলিউড বলিউড কিংবা দক্ষিণের সিনেমাতে শুধু হরদমই নয়, হয়তো কিছুটা বেশিই মারামারি হয়ে থাকে। চায়নিজ সিনেমার কথোপকথনের একটি শব্দও বুঝতে পারছিলাম না, তবে বডি ল্যাঙ্গুজে পুরো গল্পটি বেশ হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলাম রাগ, ক্ষোভ, অভিমান বা প্রতিবাদের সবকিছু।
চোখে ঘুম নেই, যাত্রীদের অনেকেই ইতোমধ্যে আড়মোড়া দিয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ শেষবারের মতো গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। বিমানবালারা যাত্রীদের চাহিদার যতটুকু সম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করছে। আমিও কি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম! ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিলো। কিছুটা আড়ষ্টভাব নিয়ে বিমানবালার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। এক কাপ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। এতো রাতে বেচারীকে চুলা জ্বালাতে হয়তো হবে না, তবে ইলেক্ট্রিক হিটার জ্বালিয়ে পানি গরম করতে হবে।
অল্পক্ষনের মধ্যে তরুণী আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে হাজির হলো। আমি ‘সরি, অনেক রাতে কষ্ট দিলাম’ বলে বিনয় দেখিয়ে কফির কাপটি হাতে নিলাম। তরুণী বিগলিত হলো, বললো– নো ইস্যু। আর কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইলো। আমি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো ধন্যবাদ দিলাম।
ঘুম আর জাগরণে কাটানো রাত শেষে, এক সময় জানালার ওপাশে হালকা আলোর দেখার মিললো। হয়তো দূরের সূর্য উঠে আসছে। ধীরে ধীরে বিমানের কেবিনে সকালের আলো জেগে ওঠে। ঘুম ভাঙা মুখে যাত্রীরা একটু একটু করে প্রস্তুত হয় অবতরণের জন্য। পাইলট অল্পক্ষণের মধ্যে বিমান মেলবোর্নে অবতরণের ঘোষণা দেন। তিনি স্থানীয় সময়, বাইরের তাপমাত্রা, আবহাওয়ার অবস্থা সবই বলে দিলেন। ভোরের আলোয় বিমানের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত ভূমি। সবুজে সবুজে ঢাকা জনপদ, কোথাও ভবন–বাড়ি ঘর, কোথাও বা পাহাড়, কোথাও সাগর বিচ খালসহ নানা কিছু। ভোরের পবিত্র আলোয় এক অনন্য রূপ নিয়ে চোখে পড়ছিল মেলবোর্ন। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।