(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের নানা অঞ্চলে ভ্রমণের রেশ কাটার আগেই ব্যাগ গোছালাম অস্ট্রেলিয়ার জন্য। বহুদিন ধরে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার একটি সুপ্ত ইচ্ছে ছিল ভিতরে। বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই অস্ট্রেলিয়া থাকেন, থাকে অনেক প্রিয়জন। কিন্তু ব্যাটে বলে না মেলায় অস্ট্রেলিয়া যাওয়া হয়ে উঠেনি। একবার ইন্দোনেশিয়ার বালি গিয়েছিলাম। ওখানে আমার গাইড সাগরের ওপার দেখিয়ে বলেছিল, ওখানেই অস্ট্রেলিয়া। তিনি এমনভাবেই সাগরের ওপার দেখাচ্ছিলেন যে, আমার ইচ্ছে করছিল সাঁতরে অস্ট্রেলিয়া চলে যাই। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন ছিল।
যাক, অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার যাওয়ার একটি উপলক্ষ তৈরি হলো। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক কনভেনশন হচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে আমি ভিসা প্রসেসিংসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম।
বিদেশ যাওয়ার জন্য আমার বিশেষ কোন প্রস্তুতি থাকে না। কেউ বললেই লাগেজটি টেনে নিয়ে পথে নেমে পড়ি। এবারও তাই হলো। লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং মেট্রোপলিটনের টিম থেকে আমরা চারজন একসাথেই যাত্রা করলাম।
লায়ন ফজলে করিম ভাই, ডালিয়া ভাবী এবং লায়ন বিজয় শেখর দাশ আগেই ঢাকায় পৌঁছেছেন। আমিও দৌড়ের উপর গিয়ে পৌঁছলাম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। নতুন দেশ দেখতে যাওয়ার একরাশ উত্তেজনা আমার ভিতরে। ঢাকা থেকে অস্ট্রেলিয়ার সরাসরি ফ্লাইট নেই। বিভিন্ন এয়ারলাইন্স তাদের হাব ব্যবহার করেই গন্তব্যে পৌঁছায়। আমাদের টিকেট করা হয়েছে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সে। এটি হংকংকে হাব হিসেবে ব্যবহার করে। অর্থাৎ আমাদেরকে ঢাকা থেকে হংকং নিয়ে যাবে এক প্লেনে। সেখান থেকে অন্য প্লেনে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। পথে হংকং বিমানবন্দরে ছয় ঘন্টারও বেশি ট্রানজিট। বিমানযাত্রায় এই ট্রানজিট টাইমটি একটি হাঙ্গামার ব্যাপার। এক বিমান থেকে নেমে অপর বিমানের জন্য অলস বসে থাকা, কিংবা বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরি করা! অপেক্ষার ওই সময় কাটতে চায়না। ট্রানজিট টাইম দুয়েক ঘন্টা হলে কোনরকমে সহ্য করা যায়। ছয় সাত ঘন্টা হলে ভোগান্তির শেষ থাকে না। এয়ারলাইন্সগুলো কোনভাবেই ট্রানজিট টাইম আট ঘন্টায় নিতে চায় না। তাহলে যাত্রীকে বিমানবন্দরের বাইরে নিয়ে হোটেলে রাখতে হয়। ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের সাড়ে সাত ঘন্টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরিতে আটকে রাখা হয়। দুবাই বিমানবন্দরে একবার আমার ৭ ঘন্টা ৫০ মিনিটের এক অবর্ণনীয় ভোগান্তির অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
যাক, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। হংকংগামী বিমানে উঠে জানালার পাশে বসে আমি নতুন দেশে যাত্রার সময়টাকে উপভোগ করতে লাগলাম। বিমানটি আকাশে উঠতেই নিচের শহর ছোট হয়ে যেতে থাকে, আর মেঘের দেশে প্রবেশ করার পর আকাশে চারদিকে এক ভিন্ন আবহ বিরাজ করে। আকাশজুড়ে ভাসতে থাকে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘের ভেলাগুলো কোনটি হাতির মতো, কোনটি ঘোড়ার মতো আবার কোনটিইবা মেঘবালিকার মতো। বিমানের জানালায় চোখ রেখে এদের দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। কোন তন্দ্রা আছে, কখনোবা ঘুম। বিমানবালাদের চা–কফি কিংবা খাবার দাবারের হাঁকডাকে সেই তন্দ্রা বা ঘুম উবে যায়, নতুন করে আকাশদর্শনে মনোযোগ দিতে হয়।
হংকং পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। এশিয়ার রত্নখ্যাত এই দেশটির সাথে আমার বেশ আবেগও জড়িত। আমার অতি প্রিয় বন্ধু ইউছুপ আলী এই হংকংয়ে থাকতেন, ব্যবসা করতেন। আমার বন্ধু সেখানে মারা গিয়েছেন, করোনাকালে তার লাশ দেশে আনা সম্ভব হয়নি। দাফন করতে হয়েছে হংকংয়ে। আমি তার জীবিতকালে একবার হংকং গিয়েছিলাম। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কবর জেয়ারত বা ভাবী এবং সন্তানদের সান্ত্বনা দিতে সেখানে যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি।
আজ আমি হংকং হয়ে মেলবোর্ন যাচ্ছি। হংকং বিমানবন্দরে বসে থাকবো ছয় ঘন্টা। অথচ হয়তো ছোট্ট দেশটির আধাঘন্টার দূরত্বে আমার বন্ধুর কবর। সেটি দেখার সুযোগ আমার হবে না। নিজের পাসপোর্টের অক্ষমতা এতো বেশি কষ্ট দিচ্ছিলো যে, আজ যদি আমার কাছে শক্তিশালী একটি পাসপোর্ট থাকতো তাহলে বিমানবন্দরে নেমেই আমি অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বন্ধুর কবরটি দেখে আসতে পারতাম। হংকংয়ের মতো ছোট্ট একটি শহরে শুধু একটি বাসা বা কবর জেয়ারত করে আসার জন্য ছয় ঘন্টা অনেক সময়। দেশটির ট্রাফিক এবং মেট্রোর যেই শৃংখলা হংকং ভ্রমণকালে দেখেছিলাম তাতে আমার মনে হয়েছে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরতে ছয় ঘন্টা লাগে না। অথচ আগে থেকে হংকংয়ের ভিসা করা না থাকলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট দিয়ে সেটি সম্ভব না।
আমাদের বহনকারী ক্যাথে প্যাসিফিকের ফ্লাইট অবতরণের ঘোষণা দিল। আমি জানালায় চোখ রাখলাম। বিমান এখনো অনেক উপরে। নিচের তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের বোয়িং আরো নিচে নেমে আসলো, ক্রমেই নিচে নামছিল। আর বিশ্ববাণিজ্যের রাজধানী হংকং কলকলিয়ে হাসছিল। কতকিছুই যে দেখা যাচ্ছিলো। হংকংয়ের আকাশছোঁয়া সব ভবন, নীল হয়ে থাকা সাগর, সবুজে সবুজে একাকার পাহাড়গুলোর দেখা মিলতে শুরু করলো। আমি অধির আগ্রহে জানালায় চোখ দিয়ে বসে থাকলাম, ভাবতে চেষ্টা করছিলাম ঠিক কোন জায়গাটিতে আমার প্রিয় বন্ধুর কবর।
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। তাবত দুনিয়ার মানুষ দেশটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবে অধিকাংশই আসে ব্যবসার জন্য। বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মানুষ ছোটাছুটি করে। কেউবা পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য, কেউবা ইমিগ্রেশন করে হংকং প্রবেশের জন্য। ইমিগ্রেশনে আমাদের কোন কাজ নেই, লাগেজ নেয়ার ঝামেলা নেই। ক্যাথে প্যাসিফিকই ঢাকা থেকে নেয়া আমাদের লাগেজগুলো মেলবোর্নের ফ্লাইটে তুলে দেবে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে বিমানে উঠার আগ দিয়ে ফাইন্যাল বোর্ডিং কার্ড চেকের সময় লাগেজটি ঠিকঠাকভাবে এই বিমানে তোলা হয়েছে কিনা সেটি এয়ারলাইন্সের অফিসারের কাছ থেকে জেনে নেয়া।
ধীরেসুস্থে বিমান থেকে নেমে আসলাম। নিচে কোন তাড়া না থাকায় হেলে দুলে টার্মিনালের ভিতরে হাঁটছিলাম। আমাদের পরবর্তী ফ্লাইটের গেট নম্বর বোর্ডিং কার্ড থেকে দেখে নিলাম। ওই গেটে গিয়ে সোফায় আরাম করে বসলাম। কাছেই ক্যাফে। করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী কফি খাবেন না, বিজয় দা’ আমার আগে ক্যাফের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমার অন্তর হু হু করে উঠলো। আমার বন্ধু শুয়ে আছেন অদূরে, আমি কফি খাচ্ছি এখানে। অথচ বছর তিনেক আগে এই হংকং শহরে কত জায়গায় না ঘুরে ঘুরে তিনি আমাকে কফি খাইয়েছেন, খাইয়েছেন কতকিছু। শুধুমাত্র আমাদের তিনজনের সাথে দেখা করতে আমার বন্ধুটি হংকং থেকে চট্টগ্রামে চলে আসতেন। রাতভর আমরা ঘুরতাম, খেতাম, আড্ডা দিতাম। বন্ধুপত্নী শাহীন ভাবী মজা করে আমাদের এই ঘোরাঘুরি নাম দিয়েছিলেন ‘অভিসার’। কাচের ভিতর দিয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে আমি শক্তিশালী একটি পাসপোর্টের তীব্র অভাব বোধ করছিলাম।
ফোন করলাম শাহীন ভাবীকে। জানালাম আমি হংকং বিমানবন্দরে, অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। সবার খবরাখবর নিলাম। ভাবীকে বেশ মনমরা মনে হলো। আসলে, স্বামী হারানো একজন নারীর মনে আনন্দই বা কোত্থেকে থাকবে। টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলে ফোন রেখে দিলাম।
শাহীন ভাবীর সাথে কথা শেষ করে হঠাৎ আমার মাথায় যেনো বিদ্যুতের চমক খেলে গেলো। ফেরার সময়ও আমাদের টিকেট ক্যাথে প্যাসিফিকের। অর্থাৎ হংকংয়ে ট্রানজিট হয়েই ঢাকায় ফিরবো। তাহলে এখন ভিসার আবেদন করে দিলে কেমন হয়! আমার অস্ট্রেলিয়ায় ঘোরাঘুরি শেষ হতে হতে তো হংকংয়ের ভিসা হয়েও যেতে পারে।
আমি জানি যে, হংকং এখন ই–ভিসা দেয়। সশরীরে কোথাও হাজির হতে হয়না। আবার পাসপোর্টও পাঠাতে হয়না। তাহলে আবেদন করছি না কেন?
সোফায় নড়ে চড়ে বসলাম। মোবাইল রোমিং করা, ইন্টারনেট কানেকশনও রয়েছে। আমি হংকংয়ের নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকে ভিসার আবেদন টাইপ করতে শুরু করলাম। অস্ট্রেলিয়ার ভিসার জন্য যোগাড় করা আমার সাম্প্রতিক ছবি, চাকরি, ব্যাংক, ইনকাম ট্যাক্সসহ ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রের স্ক্যান কপি মোবাইলে রয়েছে। আমি সবকিছু দিয়ে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে আবেদন সাবমিট করে দিলাম। সাথে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা এবং ক্যাথে প্যাসিফিকের এয়ার টিকেটও দিয়ে দিলাম। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে হংকংয়ের ভিসার জন্য আবেদন করে আমি আরো এক মগ কফি নিয়ে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম। লায়ন ফজলে করিম এবং বিজয় দা’ আমার কান্ড দেখে হাসলেন। বললেন, শুধু শুধু কষ্ট করলেন। হংকং এখন ভিসা নিয়ে যে কড়াকড়ি করে তাতে বিমানবন্দরে বসে আবেদন করে ভিসা পাবেন সেই আশায় গুড়ে বালি! আমি হাসলাম, অসহায় হাসি। বললাম, ভিসা পাবো সেই আশা করে আবেদন করিনি। আমি শুধু বন্ধুর কাছে দায়মুক্তির জন্য আবেদন করেছি। পরকালে আমাদের যখন আবার দেখা হবে তখন তো অন্তত বলতে পারবো যে, আমি চেষ্টা করেছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।