(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাই সাই করে ছুটছে আমাদের গাড়ি। গুহা দর্শণ শেষে ফিরছি কুনমিং শহরে। কুনমিংয়ে দেখার মতো হয়তো আরো অনেক কিছু আছে, কিন্তু স্টোন ফরেস্ট ও জিউশিয়াং গুহা দেখে আমার মন ভরে গেছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই সবুজ পাহাড় দেখছিলাম, দেখছিলাম পাথরের রাজ্যও। আকাশ ছুঁতে চাওয়া পাথরগুলো আমার হৃদয় পুরোপুরি ছুঁয়ে গেছে। গুহার আবহ আমার পরানটি পুরোপুরি ভরিয়ে দিয়েছে। ক্যাবল কারের সৌন্দর্য আমার হৃদয়ে আজীবনের স্মৃতি হয়ে পাকাপোক্ত বসতি গড়ে নিয়েছে। আমার বন্ধু লায়ন ফজলে করিম ভাইকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম, এমন একটি ট্যুরে আমাকে সাথী করার জন্য। শুধুমাত্র আমার খায়েশ পূরণ করতে এতো কষ্ট করে কুনমিং আসার জন্য। বিলকে ধন্যবাদ দিলাম, গুহার হদিশ দেয়ার জন্য।
গাড়ি ছুটছিল, স্টিয়ারিংয়ে বিল। আমার ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, পৃথিবীর বহুদেশেই গাড়ি চালিয়েছি। গাড়ি চালানোটা আমার অন্যতম শখের মধ্যেও পড়ে। কিন্তু চীনে এসে একদিনও স্টিয়ারিং ধরিনি। এমন সুন্দর রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে সুখ তা আমার দেশ বা চট্টগ্রামে কোনদিন মিলবে কিনা কে জানে! এতো মসৃন রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে সুখ তা আমার দেশের লাখো গাড়ি চালকের অজানাই রয়ে গেছে।
দিনের আলো মিলিয়ে গেছে অনেক আগে। কুনমিং শহরও কাছাকাছি চলে এসেছে বলে মনে হচ্ছিলো। দূরে দূরে সুউচ্চ সব আলোকোজ্জ্বল ভবন। চারদিকে আলোর মাঝেও আমার অন্তরে বিরাজ করছিলো গুহায় দেখে আসা মহাবিস্ময়কর নানাকিছু। আমি যেনো একটি ঘোরের মধ্যেই বসেছিলাম, অপার বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে।
আমরা যখন শহরে ফিরে এলাম, কুনমিং তখন অন্য এক রূপে জেগে উঠেছে। দিনের রঙিন ভ্রমণের পরে রাতের কুনমিং যেন শান্ত এক কাব্যগ্রন্থ, আলো–আঁধারি যেনো সেই গ্রন্থের এক মোহময় অধ্যায়। শহরের ভিতরের পথ ধরে চলছিল আমাদের গাড়ি। কী যে সুন্দর লাগছিলো বসন্তশহরকে! রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। এসেছি পর্যন্ত এতো গাড়ি রাস্তায় আর দেখিনি, কোন উৎসব আছে কিনা কে জানে!
বিল আমাদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা ডিনারের জন্য বের হলাম। করিম ভাই বললেন, আজও ওখানে যাবেন, নাকি অন্য কোথাও খাবেন? বললাম, আগে সামনে যাই। যেখানে হোক খাওয়া যাবে। ডিনারে কিছু একটা খেলেই হবে।
আমরা রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। শহরের রাস্তাগুলো ঝকঝক করছে, তবে কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই। বাতাসে এক ধরনের শান্ত শীতলতা, যেনো প্রকৃতি নিজেই রাতের শহরকে একটু প্রশান্তির পরশ দিচ্ছে। বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে ঝকঝকে লাল কাগজের লণ্ঠন, চোখে পড়ে কিছু প্রাচীন ধাঁচের ছাদের ওপর নরম আলো। কুনমিংয়ের ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্য যেন রাতের নিঃশব্দ গল্প বলে যাচ্ছে।
আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, শহরের রাস্তায় ময়লা আবর্জনাতো দূরের কথা, একটু ধুলোবালিও নেই। ডালিয়া ভাবী বললেন, আহারে, আমাদের যদি এমন একটি রাস্তা থাকতো তাহলে সকালে হাঁটার সময় এতো ময়লা মাড়াতে হতো না! হাসলাম, কোন উত্তর দিলাম না।
তিনতলা একটি ভবন থেকে ছিটকে ছিটকে আসছিলো আলো। প্রচুর লাইটিং করা হয়েছে ভবনটিতে। ভবনের আলো সামনের রাজপথে অদ্ভুদ এক সৌন্দর্য তৈরি করছে। আমার মনে হলো, কোন রেস্টুরেন্ট, বিয়ে বাড়ির মতো সাজিয়ে রেখেছে। করিম ভাইকে বললাম, চলেন, এটাতে ঢুকি।
করিম ভাই হাসলেন। বললেন এটা নাইট ক্লাব। ভিতরে যাওয়া যাবে না। আমি এক ঝলক ভাবীর দিকে তাকালাম, আর কথা বাড়ালাম না।
সামনে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আমাদের গ্রিলওয়ালাই ভালো। করিম ভাইকে বললাম, চলেন, ওই দোকানে যাই। তার কাছ থেকে বিদায়ও নিয়ে আসা হবে।
আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছি, কী যে সুন্দর ফুটপাত! টাইলস বসানো। গাছগাছালীতে ভরা রাস্তা, বিশাল বিশাল গাছ রাস্তার পাশে। ফুটপাতের পাশেও সাঁট দেয়া বাহারী গাছ। সেই গাছের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে বৈদ্যুতিক লাইট। ফুটপাতজুড়ে আলো আঁধারীর খেলা। মোহনীয় এক আবহ চারদিকে।
করিম ভাই আর হারালেন না। আমরা গলিপথ ধরে শর্টকাটে পৌঁছে গেলাম সেই খোলা চত্বরে। সেখানে সারি সারি অনেকগুলো খাবারের দোকান। প্রতিটি দোকানেই কয়লার উনুন জ্বলছে। তার ওপর গ্রিল করা হচ্ছে সবজি, মাংস, মাছ। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে তপ্ত ধোঁয়া আর সুগন্ধি মশলার মনভোলানো ঘ্রাণ। দোকানগুলোর সামনে ভিড় জমেছে স্থানীয় তরুণ–তরুণীদের। তাদের হাসি, কথা, উচ্ছ্বাসে যেনো প্রান পাচ্ছে রাত, জেগে রয়েছে।
যুগলেরা স্থানীয়, সবাইকে চীনা বলেই মনে হচ্ছিলো। তারা খাচ্ছে, আর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে রেস্তোরা মাতিয়ে রাখছে। তরুণ–তরুণীদের কেউ কেউ এসেছে দল বেঁধে, কেউবা যুগল হয়ে। টেবিলে রাখা আছে ক্যান ক্যান বিয়ার, স্থানীয়ভাবে তৈরি নানা প্রকার মদ। কেউ চুমুক দিচ্ছে, কেউ ঢকঢক করে গলায় ঢেলে নিচ্ছে। তুমুল বেগে টানছে সিগারেট। চীনারা প্রচুর সিগারেট টানে বলেও এ ক’দিনে আমার মনে হয়েছে। মেয়েগুলোও বেশ কায়দা করে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। হালকা নেশার আবেশে আচ্ছন্ন তারা। তবে সবই করছে নিজেদের মধ্যে। আমরা তিনজন মানুষ যে সেখানে গেলাম, তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপ দেখা গেলো না।
দোকানি ছেলেটা খেয়াল করলো। অনেকটা ছুটে এসে করিম ভাইর সাথে কৌশল বিনিময় করলো। সে আমাদেরকে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটি টেবিলে বসালো। পানির বোতল এনে টেবিলে দিলো। ছোট্ট রেস্তোরাঁটির পরিবেশ অন্যগুলোর তুলনায় শান্ত। আমরা কয়েক ধরনের গ্রিলড সবজি আর গ্রিলড ফিশ অর্ডার করলাম। ঢেঁঢশ, বেগুন, কাঁচামরিচ, পুঁই শাকের মতো একটি শাকসহ আরো কি কি সব যেনো বলেছিলাম। ছেলেটি কয়লার আগুনে রোস্ট হওয়া সেই খাবারগুলো একে একে আমাদের টেবিলে এনে দিল। আমরা আনন্দের সাথে খাবার খেলাম। খাবারগুলোর স্বাদ ছিল দারুণ। খোলা আকাশ, হালকা শীতল বাতাস, দূরের ঝুলন্ত আলো আর মানুষের কলতান, সব মিলিয়ে ডিনারটি বেশ জমে উঠেছিলো।
খুব মনে পড়ছিলো নিজের পরিবার পরিজনের কথা। বিশেষ করে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা। তাকে যদি সাথে নিয়ে আসতে পারতাম! আমার বাচ্চাগুলোও স্থানীয় এসব খাবার খুবই পছন্দ করতো। ভিডিও কল করলাম, স্ত্রী সন্তানের সাথে কথা বললাম। ঢাউশ সাইজের কাঁচামরিচের গ্রিল করার কৌশল দেখে তারা হেসে কুটিকুটি।
খাওয়া দাওয়া শেষে দোকানি থেকে বিদায় নেয়ার পালা। খাবারের বিল পরিশোধ করে করিম ভাই তাকে বললেন, কাল চলে যাবো। আর দেখা হবে না। আপনার খাবারগুলো আমরা খুবই আনন্দের সাথে খেয়েছি। আমাকে দেখিয়ে বললেন, উনি কাঁচামরিচ গ্রিলড দারুণ পছন্দ করেছে। শেষে বললেন, ভালোভাবে ব্যবসা করুন, আপনার ব্যবসার সফলতা কামনা করি। দোকানি করিম ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। কোলাকুলি করলো, আমাকেও বুকে টেনে নিলো। বিদায় দেয়ার সময় মনে হলো সে কোন স্বজনকে বহুদিনের জন্য দূরদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আহারে মায়া, কখন যে কোথায় কে কোন মায়ায় পড়ে তা কেউ আগে জানে না। দোকানি আমাদেরকে আবারো কুনমিং আসার আমন্ত্রন জানিয়ে বললো, নিশ্চয় এখানেই আমি থাকবো। আপনাদের আবারো গ্রিলড আইটেম খাওয়াবো। অন্য কিছু পছন্দ করলেও বললে আমি রেঁধে দেবো। আমরা হাসলাম। বললাম, কুনমিং যদি আবারো কোনদিন আসা হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার দোকানে আসবো।
ভরপেট খাওয়ার পর হেঁটে হেঁটে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। শহরের রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা, বাতিগুলো নির্ভার আলো ফেলছে পথের ওপরে। কোন কোন ভবনের কাচের জানালা দিয়ে উঁকি মারছে আলো। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়া এসে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে চুল। বসন্তশহরে রাতের নরম আলো দারুণ এক আবহ তৈরি করেছে। ভীষণ রোমান্টিক এক সময় যেনো পার করছিলাম কুনমিংয়ের রাজপথে।
নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটছি, মনে হচ্ছিলো আমরা তিনজন ছাড়া রাস্তায় আর কোন মানুষ নেই। মাঝে মধ্যে দুচারটা গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছিলো। গাড়ির হেডলাইটের আলো রাজপথের আলো আঁধারীতে ঝলক তুলছিল। এই হাঁটা, এই নির্জনতা, এই আলো–আঁধারি আমার ভেতরটাকে কেমন এক কোমল আবেগে ভরিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সময় থেমে থাকুক, শুধু হাঁটিৃ এই শহরের সাথে, এই রাতের সাথে।
সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কুনমিং আমাকে কিছু বলছে। না, চেঁচিয়ে নয়, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, হৃদয়ের গভীর কোনো জায়গা ছুঁয়ে। এক অচেনা শহর, কিন্তু তার রাত যেন চেনা এক সুর হয়ে বাজছে মনের ভেতর।
সেই রাতের কুনমিং ছিল নিঃশব্দে কথা বলা এক শহর। না ছিল কর্ণভেদী শব্দ, না ছিল উজ্জ্বল কৃত্রিমতা। তবুও ছিল এক অপার সৌন্দর্য, ছিল এক গভীর শান্তি। একটু আগে দেখে আসা তারুণ্যের হুল্লোড়, এখন রাস্তাজুড়ে নিঃশব্দ ভালোবাসার ছায়া। সব মিলিয়ে বসন্তশহর যেনো প্রেমেরই জয়গান গাচ্ছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।