(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের কুংমিয়ের গুহার ভিতরে নদীর জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে অপার বিস্ময়ে পানির ছুটে চলা দেখছি। পাহাড়ের তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে এক নির্মল স্রোত, একটি ভূগর্ভস্থ নদী। বিপুল বেগে পানির ছুটে চলার শব্দ গুহার ভিতরের গম্ভীর নীরবতার মাঝে এক অবিস্মরণীয় আবহ তৈরি করছে। আমরা অপলক দৃষ্টিতে স্রোতের তীব্রতা দেখছিলাম। পানির এমন তোড়েও পাথরগুলো ভাংছে না, নাকি ভিতরে ভিতরে ভাংছে তা বুঝতে পারছিলাম না। একটি নদীর জন্ম দেখতে পাওয়া আমাকে মুগ্ধ, বিমোহিত, পুলকিত, রোমাঞ্চিত কিংবা শিহরিত করলো। হাঁটতে হাঁটতে কিংবা পাহাড় ডিঙ্গাতে ডিঙ্গাতে কাহিল হয়ে উঠা আমার পুরো শরীরে নদীর জন্মস্থান অন্যরকমের শিহরণ জাগালো। একটি নদী যেনো কেবলই নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমরা নদীটির জন্ম এবং এগিয়ে চলার জয়যাত্রা দেখলাম।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা এগুলাম। আরে, টাকা কামানের কল তো দেখি এখানেও বসিয়ে রাখা হয়েছে। গুহার ভিতরে সুন্দর একটি কৃত্রিম টানেল তৈরি করা হয়েছে। ওয়াটার পার্কের মতো। প্লাস্টিকের ওই টানেলে খেলার মতো করে লোকজনকে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা নিচে গিয়ে নামছে। পানির কাছে। ওখান থেকে সিঁড়ি ভেঙে অন্য পথে চলে যাচ্ছে। প্রতিজনের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৪০ ইউয়ান। আমার সাহস হলো না। ধুপ করে নিচে গিয়ে পড়লে হাড় বলে আর কিছু থাকবে না, সব ভর্তা হয়ে যাবে। তাই আমি একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। উন্মুক্ত পালকির মতো ট্রলিতে বয়স্ক এবং কিছুটা পঙ্গু অনেক মানুষই গুহা দেখছেন। অনেককেই দেখলাম এভাবে গুহা দেখতে এসেছেন, দেখছেন। আহা, মানুষের শখের শেষ নেই। কিন্তু বয়স যে কিছুতে সায় দেয় না সেটাও আমরা মানতে চাইনা। তবে এই মানুষগুলোর প্রকৃতি দর্শনের এমন দুর্বার আকর্ষণ এবং আয়োজন আমার ভালো লাগলো। প্রতিটি অক্ষম মানুষের সাথে সক্ষম মানুষের কাফেলা রয়েছে। কেউ বাবাকে এনেছেন গুহা দেখাতে, কেউ মাকে। বৃদ্ধ বাবা–মা বা গুরুজনের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা আমার মন ছুঁয়ে গেলো। কেউ কেউ ট্রলিতে চড়েন নি, লাঠিতে ভর দিয়ে নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ চলছেন, অপার বিস্ময়ে দেখছেন গুহার ভিতরকার সবকিছু। তাদের চোখেও বিস্ময়, শিহরণ, তৃপ্তি।
আমরা সামনে হাঁটছি। আবারো সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে কখনো উপরে কখনো বা নিচে নামছি। ভূগর্ভস্থ জলপ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে কানে। এই শব্দটা কানে লাগে না, বরং মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো।
ভিতরে অন্যরকমের আনন্দ খেলা করলেও শরীর কাটছিল না। একটির পর একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে গিয়ে আমার অবস্থা সত্যিকারের কাহিল হয়ে উঠেছিল। শরীর বলে কথা, কতই আর সহ্য করতে পারে!
ক্লান্ত পায়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকালাম বিলের দিকে। আর কত, কোথায় নিয়ে যাবে?
বিল হেসে বললো, একটু কষ্ট করুন। আর সামাণ্য এগুলেই সামনে ক্যাবল কার। আমরা কারে নেমে যাবো।
আমি চমকে উঠলাম। ক্যাবল কার? এই গুহায়!! কীভাবে সম্ভব! তারপরই মনে হলো, এটা চীন! চীনের প্রকৌশলীরা অসম্ভবকে সম্ভব করতেই পৃথিবীতে জন্ম নেন। আমাদের মতো খেয়ে পরে মরে যাওয়ার জন্য নয়।
ক্যাবল কারের কথা শুনে কিছুটা চাঙ্গা হলাম। খুব দ্রুত কয়েকটি সিঁড়ি ডিঙ্গালাম। পায়ে ভীষন টান পড়ছিল। তবুও উঠছিলাম পাহাড়ের শীর্ষপথে। তখনো গন্তব্য দেখা যাচ্ছিলো না, আর কতদূর গেলে সেই ক্যাবল কারের দর্শন মিলবে কে জানে!
অল্পক্ষনের মধ্যে আমরা গুহার মুখ পেয়ে গেলাম। যেখান দিয়ে বের হওয়ার পরই চোখের সামনে খলখল করে উঠলো একটি সবুজ পৃথিবী। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়, সবুজ আর সবুজ। গাছ গাছালী এবং জঙ্গলে ভরা সেই পাহাড়গুলোর উপর দিয়ে একটি তারের সাথে ঝুলছে অসংখ্য কেবিন– কেবল কার। কাচের ক্যাবলকারগুলোও দেখতে বেশ সুন্দর। দূর থেকে আসতে থাকা কারগুলোকে মনে হচ্ছিলো এক একটি বড়সড় পাখির বাসা। এমন সবুজ বনানীতে পাখীর বাসার চেয়ে ভালো কোন উদাহরণ আমার মনে পড়লো না।
আমরা ক্যাবল কার স্টেশনে পৌঁছালাম। দারুণ একটি জায়গা। পাহাড়ের শীর্ষে তৈরি করা হয়েছে একটি ছোট প্ল্যাটফর্ম। এখান থেকে চারদিকে যতদূর চোখ যায়–পাহাড় আর সবুজ। একটা অপার্থিব শুদ্ধতা যেন ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। প্ল্যাটফর্মের পাশে টিকেট কাউন্টার। একজন চীনা নারী কাউন্টারে বসে টিকেট বিক্রি করছেন। টিকেট ছাড়া সামনে এগুনোর কোন সুযোগ নেই, পথে ব্যারিয়ার রয়েছে। ব্যারিয়ারের ওপারে দুইজন নারী পর্যটকদের কারে তুলে দিচ্ছিলেন। এই পাহাড়ের ভিতরে কাজ করছে মাত্র তিনজন চীনা তরুণী। তাদের কী ডর ভয় নেই। পাশেই পাহাড়, পুরোটা আচ্ছাদিত ঘন জঙ্গলে। যে কোন দুষ্টু লোক চাইলে যা ইচ্ছে করতে পারে। কিন্তু এদের কেউ কিছু বলে বা বলেছে বলেও তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো না। তারা অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই পর্যটকদের হাত ধরে ক্যাবল কারে তুলে দিচ্ছিলো। কেবিনের সিট বেল্ট এবং লক লাগিয়ে সেটিকে ঠেলে পাহারের উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছিলো। আসলেই, আইনের ঠিকঠাক প্রয়োগ হলে শুধু জঙ্গল কেন, পুরো পৃথিবীই বুঝি নিরাপদ হয়ে যায়।
প্রতিজনের জন্য ১২০ ইউয়ান। টাকার অংকে খুব একটা কম না। বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই হাজার টাকার বেশি। আমার বন্ধু লায়ন ফজলে করিম চারজনের জন্য টিকেট করে ফেললেন। চীনা মেয়েগুলো ডালিয়া ভাবী এবং করিমভাইকে একটি কেবিনে, এবং আমাকে আর বিলকে অপর একটি কেবিনে তুলে দিল।
ক্যাবল কারে ওঠার মুহূর্তটা ছিল রোমাঞ্চে ভরা। পা রাখা মাত্রই একটা হালকা দোল খায় কেবিনটা। কিছুটা উদ্বেগ, আর অনেকখানি কৌতূহল নিয়ে জানালার কাচে কপাল ঠেকিয়ে সামনে তাকাই। জীবনে বহুদেশে বহুবার ক্যাবল কারে চড়েছি। কিন্তু এটির সবকিছুই যেনো অন্যরকম, আলাদা।
ক্যাবল কার ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করে। নিচে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে সবকিছু। নীল আকাশের নিচে পাহাড়ের উপর দিয়ে ক্যাবল কার এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো, প্রকৃতির সুর যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চারপাশে যেদিকেই তাকাই, সবুজ আর সবুজ। অগভীর নয়, একেবারে গভীর বন। সেই বনের উপর দিয়ে বুক চিরে চলে যাচ্ছে আমাদের ক্যাবলকার। নিচে উঁচু–নিচু পাহাড়, মাঝে মাঝে দেখা যায় সরু আঁকাবাঁকা পথ, যেখানে বনের ছায়া পড়ে গভীর রহস্য তৈরি করছে। যেন সিনেমার দৃশ্য, অথবা কোনো স্বপ্নপুরীর। নিচে কিছু বাড়িঘরও দেখা গেলো। দেখা গেলো গরুরও। কোন একটি ট্রেনিং সেন্টারও রয়েছে। যেখানে কিছু মানুষের হাঁটাহাঁটিও চোখে পড়লো।
আমি কেবিনের কাচে কপাল ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলাম। চারপাশে শুধু সবুজ, গাঢ় বনভূমি, আর একের পর এক পাহাড়। নিচে ছুটে চলা সরু পাহাড়ি রাস্তা, গাছে গাছে ছায়া, আর দূরের পাহাড়গুলো মেঘে ঢাকা–সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজের হাতে আঁকা একটা ছবি আমাদের চোখের সামনে ধরে রেখেছে।
হাওয়ার ছোঁয়া জানালার ফাঁক দিয়ে এসে গায়ে লাগছিল। সেই বাতাসে ছিল পাহাড়ি শীতলতা, গাছের ঘ্রাণ, আর এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মাঝে মাঝে কেবল কার হালকা দুলে উঠছিল হাওয়ার তোড়ে। মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি যেন আমাদের সঙ্গে খেলছে।
কেবিনে বসে মোবাইল টিপে যাচ্ছি। ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। কেবিনের জানালা গলে ঝিরিঝিরি বাতাস খেলা করছিল আমার চোখে মুখে, উড়িয়ে দিচ্ছিল চুল। গুহার ভিতরে পাহাড়ের তলদেশে গুহার ভিতরে যে গরম লেখেছিল এখানে তার ছিঁটেফোটাও নেই। হালকা বাতাস শরীর মন সব জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো। এই বাতাসে ধুলোর কোন ছোঁয়া নেই, নেই কোনো গন্ধ, কেবল এক নিখুঁত শুদ্ধতা। সেই হাওয়া বয়ে আনে পাহাড়ি ফুলের হালকা গন্ধ, বয়ে আনে পাখিদের ডাক, যা আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত আমাদের অন্তরে অন্যরকমের এক প্রশান্তি তৈরি করছিল। মাঝে মাঝে কেবল কার একটু দুলে ওঠে হাওয়ার তোড়ে, যেন প্রকৃতি নিজেই ছুঁয়ে দেখে আমাদের। আহারে সুখ, আহারে শান্তি। কী অনাবিল এক প্রকৃতি।
নিচের দিকে তাকালাম। কলজের ভিতরে একটি মোছড় টের পেলাম। ক্যাবল কারের তার থেকে কাচের কেবিনটি ছিঁড়ে নিচে পড়লে কি বাঘ বাল্লুকের খোরাক হবো! কেউ কি উদ্ধার করতে পারবে। চারদিকে এতো এতো ঘন বনের ভিতরে খুঁজে পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়।
ক্যাবল কার থেকে পাহাড় দেখছিলাম, দেখছিলাম প্রকৃতি। উপভোগ করছিলাম সময়। পাহাড়ের রঙ ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছিলো। কখনো গাঢ় সবুজ, কখনো ধূসর পাথর। আবার কখনো হালকা ঝোপঝাড়। প্রকৃতি নিজেই কথা বলছে, বাতাসের মধ্য দিয়ে, পাতার ফিসফিসে আওয়াজে, গাছের মাথায় পড়া রোদের আলো, আর মাঝে মাঝে ছায়ায় লুকিয়ে থাকা পাখিদের ওড়াউড়ি– সব মিলিয়ে এক অন্য জগৎ। দূরের পাহাড়গুলো নীলচে রঙে মিশে গেছে আকাশের সঙ্গে।
যখন মাঝপথে পৌঁছাই, নিচের গহীন বন হয়ে ওঠে আরও গাঢ়। সেই বনে সূর্যের আলো ঢুকছে রোমান্টিক ছায়া ফেলে। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একেকটি খাল বা পাহাড়ি ঝরনা, যা নিচের দিকে স্রোতের মতো ছুটে চলেছে। কেবল কারের ছায়া মাঝে মাঝে পড়ে সেই জঙ্গলের গায়ে, যেন এই যান্ত্রিক বস্তুটিও প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। দূরে সুউচ্চ কিছু পাহাড়ের মাথায় মেঘ আটকে গেছে, যেন নীলাম্বরী আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।