(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের কুনমিংয়ের স্টোন ফরেস্টে ঘুরতে ঘুরতে নানা ভাবনায় যখন আমি আচ্ছন্ন তখন আমাদের গাইড বিল আমাদের নিয়ে চলেছেন একটি জনপ্রিয় পয়েন্টের দিকে। যার নাম ‘ফুং কং’ পথ। স্থানটি এমন যে, যেখানে পাথরের ফাঁক ফোকরে তৈরি সরু ও বাঁকানো একটি সিঁড়িপথ দেখলাম। পথটি সুউচ্চ কয়েকটি পাথরের একেবারে চূড়ায় উঠে গেছে। অন্তত চার তলা উচ্চতার পাথরের উপরে তৈরি করা হয়েছে একটি ঘর। ঝুঁকিপূর্ণ পথ মাড়িয়ে শত শত পর্যটক ওখানে উঠছেন, নামছেন। আমরাও উঠে গেলাম। বিল জানালো এই পথটির নামই ‘ফুং কং’। আর ঘরটিকে বলা হয় প্যাভেলিয়ন। ফুং কং এর বাংলা বিল বলতে পারেনি তবে বলেছে যে এটি স্টোন ফরেস্টের খুবই জনপ্রিয় একটি পয়েন্ট। দর্শকেরা পাথরের চূড়ায় উঠে চারদিকে খোলা ঘরটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম এবং চারদিকে বিস্তৃত পাথরের বন দেখার সুযোগ পান।
প্যাভেলিয়নে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। ঘরটিতে পাথরের লম্বা টুল দেয়া আছে। অনেকেই বসে আছেন। আমিও কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর দূরে এবং কাছে খেয়াল করে দেখলাম যে, পাথরে পাথরে পুরো এলাকাটি একাকার। ধুলুর ঢেউয়ের মতো পাথরের বন। পাথরগুলো দেখতে যেন স্থির হয়ে যাওয়া এক বিশাল সমুদ্র, কিন্তু সেটা পাথরের, স্থির। অথচ প্রবাহমান এক সৌন্দর্য! একইসাথে শান্তি, বিস্ময়, রোমাঞ্চ এবং এক অন্যরকমের শিহরণে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। আমি নিজের ভিতরে বেশ পরিবর্তন টের পাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, স্টোন ফরেস্ট যেন শুধু ভূগোল নয়, এটি একটা গল্পের দেশ। যেখানে প্রতিটি পাথর একটি করে কবিতা, প্রতিটি ভাঁজে লুকানো ভালোবাসা, বিস্ময়, কিংবদন্তি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
স্টোন ফরেস্টের সর্বোচ্চ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে চারদিকে বিস্তৃত পাথরের রাজত্বের মাঝে নিজেদের মনে হচ্ছিলো কয়েকজন ক্ষুদ্র মানব–মানবী। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি আমাদের ক্ষুদ্রতা যেনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলো।
আরো অনেকক্ষন আমরা পাথরের বনে ঘুরলাম। কত রকমের পাথর যে দেখলাম তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমি চোখ বন্ধ করে পাথরের বনটিকে দেখার চেষ্টা করলাম। যেনো জীবনের শেষ সময়েও আমি মানসচক্ষে এই বনটি দেখে তৃপ্ত হতে পারি। এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিলো না। মনে হচ্ছিলো ভর চাঁদনী রাতে যদি এই বনে ঘুরতে পারতাম, কিংবা কোন তুমুল বর্ষায়! কিন্তু থাকার জো নেই। ফিরতে রাত হয়ে যাবে বলে করিম ভাই আমাকে তাড়া দিলেন। বিলও ফিরতে হবে বলে আগে আগে হাঁটতে শুরু করলো। একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে আমাদেরকে আবারো পর্যটকবাহী গাড়ি তুলে নিল।
ফিরবার পথে মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটা যেন শুধু পাথরের বন নয়, এটি এক রহস্যময় কাব্য। যেখানে প্রকৃতি নিজেই শিল্পী, আর প্রতিটি পাথর তার কবিতা।
আমাদের গাড়ি ফিরছিল খুবই ধীর গতিতে। জানালার কাচ নামিয়ে শেষবারের মতো পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আশিমার সেই নারী অবয়বের পাথরটিকে। নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, যুগ যুগ ধরে হয়তো এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে, হয়তো আরেকটি বসন্তের জন্য তার এই অপেক্ষা অনন্তকাল বহমান থাকবে।
স্টোন ফরেস্টের রহস্যঘেরা সৌন্দর্য পেছনে ফেলে যখন আমরা কুনমিং শহরের দিকে ফিরছিলাম, তখন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে পড়ছিল। পথের ধারে ধূসর পাথরের ছায়া আর সবুজ গাছপালার ফাঁকে ঝিরিঝিরি বাতাসে যেন একটি নরম সুর বাজছিল। সারাদিনের ক্লান্তির ভেতরেও মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির এই বদলে যাওয়া রূপ আমার অন্তরজুড়ে যেন এক নতুন গান গুনগুনিয়ে শুনিয়ে চলেছে।
আমাদের গাড়িটি ছুটছিল পাহাড়ি পথ ধরে। ফ্রন্ট সিটে বসে আমি তাকিয়ে ছিলাম অপলক দৃষ্টিতে। দূরের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে গাঢ় নীল হয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার কুয়াশা নামছিল ধীরে ধীরে, যেন আকাশ নিজ হাতে পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরছে।
খেয়াল করলাম যে, ফজলে করিম ভাই আর ডালিয়া ভাবি একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছেন। আমার মুখেও রা নেই। পাথরের বন যেন আমাদের মনের ভেতরেও এক নিঃশব্দ দাগ কেটে রেখে গেছে। স্টোন ফরেস্টই যেনো বিরাজ করছে আমাদের তিনজনেরই মনজুড়ে।
আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বিল বললো, সামনে খুব ভালো চা পাওয়া যায়। খাবেন? কোনকিছু না ভেবেই মাথা নাড়লাম। রাস্তার একটি বাঁকে গাড়ি থামল বিল। সামনে ছোট্ট একটি চা দোকান। আমরা নেমে এলাম। দোকানের পাশে কয়েকটা বাঁশের চেয়ার পাতা, একপাশে জলপাই রঙের গাছ, অন্য পাশে একটা সরু জলধারা, যেন পাহাড়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া শান্ত অশ্রু।
বিলই চায়ের অর্ডার দিল। দোকানি একজন নারী, উপজাতীয় টাইপের। বেশ পরিস্কার মগে আমাদেরকে চারটি চা দেয়া হলো। একেবারে টাটকা চা। মনে হয় এইমাত্র বাগান থেকে তুলে আনা পাতা দিয়ে বানানো হয়েছে। স্বাদ এবং গন্ধে মন ভরে গেলো। ফজলে করিম ভাই চীনে এসেছি পর্যন্ত ‘নায়–চা’ নিয়ে মেতে থাকলেও তিনি এই চায়েরও বেশি সুনাম করলেন।
আমাদের গাড়ি আবারো চলতে শুরু করেছে। কনে দেখায় আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিকের প্রকৃতি। ধীরে ধীরে নেমে আসছিল সন্ধ্যা পাহাড়ের গায়ে নরম আলো ঝরছে, ঠিক যেন নববধূর মুখে প্রথম আলো পড়েছে। সূর্য তখনো অস্ত যায়নি, কিন্তু তার তীব্রতা কমে গিয়ে যেন কোমল রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা আলো এতটাই মোলায়েম লাগছিল, মনে হচ্ছিল প্রকৃতি নিজেই যেন চুপিচুপি ফিসফিস করে কথা বলছে।
যাওয়ার সময়ও এই পাহাড়গুলো দেখেছিলাম। দেখেছিলাম এই পাহাড়ি প্রকৃতি। কিন্তু এখন এই সন্ধ্যায় প্রকৃতি যে সবকিছু পাল্টে একেবারে নতুন করে নিয়েছে। দূরের পাহাড়গুলো একটার পর একটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর নীল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল দিগন্তে। মাঝে মাঝে আকাশের নিচে ছড়িয়ে থাকা ধোঁয়াশার মতো মেঘরাশি পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকছিল, ঠিক যেন কোনো গল্পের দেশে চলে এসেছি। পাহাড়ের কোলে জেগে উঠছিল ছোট ছোট আলো, দূর গ্রামের বাড়িগুলোর মিটমিটে আলো। পথের পাশে গাছগুলোও যেন শান্ত হয়ে গেছে। বাতাসে ছিল হালকা শীতলতা, কিন্তু কাঁচের ভেতর থেকে তা ছুঁয়ে যাচ্ছিল হৃদয়ের ভেতর।
এই আলো, এই নীরবতা, এই পাহাড়ি পথ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে সব ভ্রমণই একদিন শেষ হয়, কিন্তু কিছু মুহূর্ত হৃদয়ে থেকে যায় চিরকাল। যেমনটি স্টোন ফরেস্টের আজকের দিনটি আমি এক জীবনে ভুলবো না।
আমাদের গাড়ি ছুটছিল। রাস্তায় অনেক গাড়ি। সবই ছুটছিল তীব্রবেগে, কুনমিং শহরের দিকে। একসময় কুনমিং শহরের আলো জ্বলজ্বল করতে শুরু করল। দূর থেকে আলোকোজ্জ্বল শহর দেখে মনে হচ্ছিল কুনমিং এক নতুন সাজে সেজেছে, ডাকছে আমাদের। দিনের আলোর শহর আর সন্ধ্যারাতের শহর যেনো দুই রূপের কুনমিং। বহুতল ভবনের আলো, গাড়ির হেডলাইট, দোকানের সাইনবোর্ড–সব মিলিয়ে এক আধুনিক শহর যেনো হাতছানি দিচ্ছে।
শহরের ঢোকার আগেই আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড মি. বিল আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এতোক্ষণে সে ভালোমতোই বুঝে গেছে যে, নয়া জিনিস দেখার জন্য আমার ভিতরে বড় রকমের পাগলামির বসবাস রয়েছে। বিল বললো, স্যার, দারুণ একটা জায়গা আছে। মিলিয়ন বছর আগের গুহা। জিউসিয়াং ক্যাভ। যাবেন নাকি? সে ‘দারুণ’ বলে এমনভাবে চোখ নাচালো যে, আমার নাচুনে মন নেচে উঠলো। বললাম, চল।
কিন্তু সে আমাকে হতাশ করে বললো, এখনো তো যাওয়া যাবে না। কাল সকালে যেতে হবে। পুরোদিন চলে যাবে। শহর থেকে যেতেই দুই ঘন্টার মতো লাগবে। লায়ন ফজলে করিম ভাই কিংবা ডালিয়া ভাবীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি সকালে তাকে হোটেল থেকে আমাদের তুলে নিতে বললাম। মনে হলো, আমার এই নাচুনে মন তাকে বেশ খুশী করতে পেরেছে!
গাড়ি এসে হোটেলের সামনে থামলো। করিম ভাই বললেন, খুবই দ্রুত বের হতে হবে। নাহয় ডিনারে অনাহারে থাকতে হবে।
চীনারা খুবই আর্লি ডিনার করে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে, ডিনারের সময় ইতোমধ্যে শেষদিকে চলে এসেছে। আর দেরি করলে যে কোন দোকানপাট খোলা পাওয়া যাবে না সেটি নিশ্চিত।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত বের হলাম। একটু পরই করিম ভাই এসে গেলেন। বললেন, আপনার ভাবী খাবেন না। আমরা আসার সময় কিছু একটা নিয়ে আসবো। বুঝলাম যে, দিনের ধকল ভাবী সামলে উঠতে পারেন নি।
করিম ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সেই রাস্তা, সেই আলোকোজ্জ্বল পথ। ভবনে ভবনে আলো, নিয়ন সাইনের উজ্জ্বলতা। সবই নজরে পড়ছিল।
করিমভাইকে গতরাতের মতো গ্রিল আইটেম দিয়ে ডিনার করার পরামর্শ দিয়ে বললাম, চলেন, ওই দোকানটিতে যাই। তিনি হাসলেন। বললেন, আবার কাঁচা মরিচের গ্রিল খাবেন? আমিও হাসলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।