দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কুনমিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাচঘেরা টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে পথে নামতেই এক আলাদা আবহ অনুভব করলাম। বাতাসে ছিল একধরনের নির্মলতা, যেন কোনো দূষণ নেই, কোলাহল নেই, শুধু প্রশান্তি। আমি, আমার বন্ধু ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবী একই গাড়িতে ছুটছি কুনমিং শহরের দিকে। গাড়ির ভিতরটি বেশ আরামদায়ক। গাড়িটির ফুটওয়েল বেশ ভালো। আমাদের লাগেজগুলো সব পেছনের ডিক্কিতে দিয়ে দেয়ায় হাতপা ঝেড়ে বসেছি। গাড়ির এয়ার ফ্রেশনারের হালকা সুবাস এক ধরনের প্রশান্তি এনে দিল। গাড়ি চলছিল, আমাদের তিনজনের চোখই মুলতঃ জানালায়। বিমানবন্দর এলাকার অনন্য সৌন্দর্য আমাদের চোখ ফেরাতে দিচ্ছিলো না।

মূল সড়কে উঠতেই প্রকৃতি যেনো নিজেকে মেলে ধরলো। দু’পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, দূরে পাহাড়ের সারি, আর মাঝেমধ্যে ছোট ছোট গ্রাম। রাস্তার ধারের জমিতে কৃষকেরা কাজ করছে, চীনা কৃষক। তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান অনেক। প্রযুক্তিকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার এক অনন্য সফলতাও চীন অর্জন করেছে। কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও চাবাগানে সবুজের ঢেউ। গরুমহিষের ছোট ছোট পাল দেখা যাচ্ছে, তারা নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়াচ্ছে। চীনেও গরু মহিষ আছে!!

ডালিয়া ভাবী জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, কী সুন্দর জায়গা! মনে হচ্ছে যেন কোনো চিত্রশিল্পী যত্ন করে এঁকেছেন!! ভাবী আগেও কুনমিং বেড়িয়ে গেছেন। বেড়িয়ে গেছেন ফজলে করিম ভাইও। এবার শুধু আমার জন্যই তাদের কুনমিংয়ে আসা।

ফজলে করিম ভাই আমাকে বললেন, চীনের অন্যতম সুন্দর শহর এই কুনমিং। এটাকে বলা হয় চীনের স্প্রিং সিটিবসন্তের শহর। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৬ হাজার ২শ’ ফুট উঁচুতে। এখানের আবহাওয়া সারা বছরই খুবই আরামদায়ক থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক উঁচুতে হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময়ই ঝিরঝিরে বাতাসে শহরটি ভরে থাকে।

ড্রাইভার বিলকে বলে জানালার কাচ নামিয়ে দিলাম। শীতল একটি আবহ আমাদের শরীরের পাশাপাশি মনও ছুঁয়ে গেল।

বসন্তের শহর হিসেবে প্রকৃতির এক অপরূপ রূপ পুরো জনপদজড়ে। প্রকৃতি যেনো তার সবটুকু রঙ অকাতরে এই জনপদে ঢেলে দিয়েছে!

আমাদের গাড়ি পাহাড়ি পথে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছিল। রাস্তার এক পাশে ছিল গভীর উপত্যকা, অন্য পাশে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে লতাগুল্ম আর বুনো ফুলের সমারোহ, প্রকৃতি নিজ হাতে যেনো তুলির আঁচড়ে এক মোহনীয় দৃশ্য এঁকে রেখেছে। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ছোট ছোট ঘরবাড়ি, যেখানে স্থানীয় মানুষের বসবাস। তবে জায়গার তুলনায় লোকসংখ্যা অনেক কম বলে মনে হচ্ছিলো।

কিছুদূর আসার পর এক জায়গায় আমার চোখে আটকে গেলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা এক স্বচ্ছ ঝর্ণা। সূর্যের আলোয় পানির ধারাগুলো রূপালী ফিতার মতো ঝলমল করছিল। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি স্লো করতে বলে মোবাইলে কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম।

রাস্তার ধারে হঠাৎই ছোট একটা বাজারের মতো পেয়ে গেলাম। কয়েকজন গ্রামীণ নারী পাহাড়ি ফলমূল বিক্রি করছিলেন।

আমরা গাড়ি থামালাম। দোকানে থরে থরে সাজানো ছিল চেনা অচেনা নানা ফল। ঢাউশ সাইজের কমলা ছাড়া আর কোনটা চিনলাম না। কিছু ফল কিনলাম, আর সেখানকার মানুষের সাথে বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু কথা বলারও চেষ্টা করলাম। করিম ভাই টুকটাক চীনা ভাষা জানেন। তাতেই তিনি দোকানিসহ স্থানীয়দের বেশ মুগ্ধ করলেন। বিদেশী লোকের মুখে নিজের ভাষা শুনার মধ্যে অন্যরকমের একটি আনন্দ আছে। তারাও সেই আনন্দ উপভোগ করছিলেন। তাদের হাস্যেজ্জ্বোল মুখ আর চোখের উজ্জ্বলতা বুঝিয়ে দিল ক্রেতা হিসেবে আমাদেরকে তারা পছন্দ করেছে।

আমাদের গাড়ি আবারো চলতে শুরু করলো। গাড়িতে বসে আমরা ফল খাওয়ার মহোৎসব শুরু করলাম। কমলার খোসা ছড়াতেই হাত ভিজে যাচ্ছিলো। এতো রসালো কমলা! মুখে দেয়ার সাথে সাথে অন্যরকমের এক অনুভূতি খেলা করছিল।

কখন যে শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি বুঝতে পারি নি। সুউচ্চ সব বহুতল ভবন দেখে বুঝতে পারলাম যে, অনন্য সুন্দর পথটি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এমন পথে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে চড়লেও বিরক্ত লাগে না। প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্য শুধু চোখই জুড়ায় না, হৃদয়েও দাগ কাটে।

শহরে প্রবেশ করার পর মনে হলো, প্রকৃতি এখানেও কৃপনতা দেখায়নি। রাস্তার দু’পাশে ফুলের গাছ, ঝরনার মতো ছোট ছোট পানির ধারা আর সুসজ্জিত একাধিক পার্ক।

আমাদের গাড়িটি হোটেলের সামনে পৌঁছে গেল। রিসিপশনে বসা চীনা সুন্দরী আমাদের পাসপোর্ট জমা রেখে রুমের চাবি বুঝিয়ে দিল। রুমের ভাড়াও এডভান্স নিয়ে নিলো।

আমরা দুইটি রুম নিয়েছি। করিম ভাই এবং ভাবী একরুমে। আমি অন্যরুমে। রুমে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ডুপ্লেক্স রুম। হোটেলে এমন রুম আমি কখনো দেখিনি। নিচতলায় বসার জায়গা,ওয়াশরুম। টেবিল চেয়ার সোফাসহ সবকিছুই সাজানো গোছানো। শুধু থাকার বিশাল বিছানাটা উপরে। নিচথেকে ঘুরপথে একটি কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে, সেটা দিয়েই দোতলার বিছানায় যেতে হবে।

বিছানাটি দারুণ, তুলতুলে নরোম। এই ধরনের হোটেলগুলোর বিছানা প্রায় একই রকমের। এতো নরোম বিছানায় থাকার অভ্যাস আমার নেই। এই ধরনের বিছানায় মাঝেমধ্যে থাকা যায়, সবসময় থাকা স্বাস্থ্যকর নয়। চারটি বালিশ দেয়া আছে বিছানায়, আমি দুইটিকে কোলবালিশ বানিয়ে ফেললাম। বিকেল গড়াতে শুরু করেছে। ছোট্ট একটি ঘুম দেয়ার লোভ পেয়ে বসলো আমাকে। করিম ভাইকে কথাটি জানিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

করিম ভাইয়ের ফোনে ঘুম ভাঙলো। বললেন, চলুন, ডিনার করে আসি। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই দারুণ একটি দোকান আছে, আমি চিনি। গতবার আপনার ভাবীকে নিয়ে খেয়েছিলাম।

হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই ঠান্ডা বাতাসের একটা হালকা ছোঁয়া পেলাম। কুনমিং শহর তখন রাতের আলোয় ঝলমল করছিল। চারপাশে উঁচু উঁচু ভবন, কোথাও আধুনিক আকাশচুম্বী, কোথাও আবার পুরনো চীনা স্থাপত্যের ছোঁয়া। রাস্তা জুড়ে নরম হলুদ বাতির আলো, সঙ্গে নীললালের নিওন সাইনবোর্ড, যা এক অন্যরকম রঙিন আবহ তৈরি করেছিল।

আমরা হাঁটছিলাম। সড়কের পাশে স্ট্রিটফুডের দোকান, আমাদের ভ্যান গাড়ির দোকানের মতো। তবে ওগুলো বেশ আধুনিক, কাচে ঘেরা। নানা ধরনের খাবার বিক্রি করছিল। এক ধরনের গন্ধ চারদিক ভরেছিল। খাবারগুলো আমাদের অপরিচিত। তাই ওদিকে না গিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলাম। শহরটি বেশ শান্ত! বড় শহর হলেও তেমন কোন কোলাহল নেই।

রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ, অনেক গাছের ডালে লাল কাগজের লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখা। সেখান থেকে বর্ণিল আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে। পথচারীরা বেশিরভাগই ধীরস্থিরভাবে হাঁটছিল, কেউ কেউ সাইকেলে করে চলে যাচ্ছিল। অচিন শহরে রাত হলেও গা ছমছম করছিলো না।

লায়ন ফজলে করিম ভাই কিছুটা বিভ্রান্ত। যে দোকানে খাওয়ানোর কথা বলে আমাদের হাঁটাচ্ছেন সেই দোকানটি কোন গলিতে সেটা মনে হয় গুলিয়ে ফেলেছেন। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা সরু গলি ধরে কিছুটা সামনে হাঁটলাম আমরা। বেশ বড়সড় একটি ভবনের পাশে খোলা চত্বর, তার পাশে ছোট ছোট অনেকগুলো খাবারের দোকান। কাঠের টেবিলচেয়ার বসিয়ে দোকানিরা তাজা সিফুড, নুডলস, গ্রিলড মাংস আর বাষ্পে রান্না করা নানা ধরনের সবজি বিক্রি করছিল। দোকানের সামনে বাষ্পের কুয়াশা উঠছিল, আর সেই সঙ্গে খাবারের সুঘ্রাণ যেন ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিল।

একটি দোকানের সামনে এসে করিম ভাই দাঁড়ালেন। দোকানি এক গাল হাসিতে করিম ভাইকে স্বাগত জানালেন। দুই বছর আগে জীবনে একবারই মাত্র তাদের দেখা হয়েছিল। অথচ কী সুন্দরভাবেই না দোকানি করিম ভাইকে মনে রেখেছেন।

দোকানে নানা ধরণের মাছমাংসের পাশাপাশি সবজিও গ্রিল করছিল। বেগুন এবং ঢেঁড়শের পাশাপাশি কাঁচা মরিচের গ্রিল। মরিচের সাইজও বিশাল। একটি মরিচ আমাদের চারটির সমান।

আমরা দুইটি মাছ এবং কয়েকটি সবজির গ্রিল অর্ডার করলাম। কাঁচা মরিচের গ্রিল তো নিতেই হবে। কয়লার চুলায় খাবারগুলো গ্রিল করা হচ্ছিলো। বাইরে টেবিলে বসে জ্বলন্ত উনুনের দিকে আমাদের লোভাতুর দৃষ্টি। আমাদের পাশের টেবিলগুলোতে অসংখ্য চীনা তরুণতরুণী হৈ হুল্লুড় করে ডিনার সারছে। টেবিলে টেবিলে বিয়ারের বোতলের স্তুপ। চীনে প্রকাশ্যে মদ বিয়ারে কোন বাধা নেই। যার যত ইচ্ছে খেতে পারে। দোকানে কোল্ড ড্রিংকসের পাশাপাশি ফ্রিজ একেবারে ভর্তি মদ বিয়ারে।

দুর্দান্ত এক ডিনার সারলাম। বেগুনের গ্রিল অনেকটা আমাদের বেগুন ভর্তার মতো। কিন্তু ঢেঁড়শ এবং কাঁচা মরিচের গ্রিল একেবারে অপরিচিত। মাছের গ্রিলটাও ছিল অসাধারণ। ফুরফুরে মেজাজে যখন হেঁটে হোটেলে ফিরছিলাম তখন কুনমিংয়ের রাত আরও অনেক বেশি মোহনীয় হয়ে উঠেছিল। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈশাখী দিন
পরবর্তী নিবন্ধতারুণ্যের জয়গানে ঐকতান