(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের চমকানি। তাইজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টার্মিনালের ভিতরে বসেও কাচের ভিতর দিয়ে বৃষ্টির তোড়জোড় এবং বিদ্যুতের ঝলকানিসহ প্রকৃতির উন্মত্ততা টের পাচ্ছিলাম। ফ্লাইট বিলম্বের কবলে পড়া আমাদের সামনে এগুনোর কোন উপায় ছিল না, ছিল না কিছু করারও। তাই টার্মিনালের লাউঞ্জে বসে ধূমায়িত ‘নায়–চা’র কাপ নিয়ে উদাস সময় পার করছিলাম। ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আমাদের গুয়াংজুগামী ফ্লাইট ডিলে করা হয়েছে। চেকইন করে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিয়েছি, লাগেজও দিয়ে দিয়েছি। ঝামেলা অর্ধেক কমে যাওয়ায় বিমানবন্দরের একটি ক্যাফেতে বসে জনপ্রিয় ‘নায়–চা’ খাচ্ছি।
আমাদের ফ্লাইট আরো এক ঘন্টা ডিলের ঘোষণা দেয়া হলো। রাত বাড়ছিল, বাড়ছিল দুশ্চিন্তা। কাঁহাতক বসে থাকা যায়! বিমানবন্দরে বসার আয়োজন সুন্দর। চেয়ার সোফা সবই আছে। কিন্তু কতক্ষণ! ইতোমধ্যে দুই দফা আমি চায়না সাউদার্ণের কাউন্টারে গিয়ে ফ্লাইটের খবর নিয়েছি। তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে না পারলেও ওয়েদারের রিপোর্ট ভালো হলেই প্লেন ছেড়ে দেবে বলে আশ্বস্ত করলেন। তারা জানালেন যে, এয়ারক্রাফট বিমানবন্দরেই রয়েছে। যাত্রীদের সব লাগেজও তোলা হয়ে গেছে। এখন সবাই রাডারের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশপথ ঠিকঠাক আছে–এমন খবর পেলেই আমাদের ফ্লাইট উড়াল দেবে। অর্থাৎ অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
লায়ন ফজলে করিম ভাই অনেকক্ষণ ধরে রয়ে সয়ে নায়–চা খাচ্ছেন, আমারটা শেষ। ডালিয়া ভাবী এবং সোহেল ভাইও মন খারাপ করে বসে আছেন। বসে আছেন আরো অনেক যাত্রী। বড় এয়ারক্রাফট। দুই শতাধিক যাত্রী এই ফ্লাইটে তাইজু থেকে গুয়াংজু যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘন্টা ঘন্টায় ফ্লাইট ডিলের খবরে মনে হলো সকলেই অস্থির হয়ে উঠেছেন।
চোখের সামনে কেএফসি দেখে আমি কফি খাওয়ার বায়না ধরলাম। ফজলে করিম ভাই ‘নায়–চা’র মগ উঁচিয়ে বললেন, তার কাপে চুমুক দেয়ার এখনো বহু সুযোগ আছে। সুতরাং তিনি নতুন করে কফি নেবেন না। আমি একটি ক্যাপুচিনো আনতে পা বাড়ালাম। কফির মগে চুমুক দেয়ার সাথে সাথেই মাইকে নতুন ঘোষণা শুনলাম। আমাদের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আজ রাতের জন্য আমাদেরকে নিকটস্থ একটি হোটেলে রাখা হবে। ফ্লাইট উড়ানো গেলে আমাদেরকে হোটেল থেকে নিয়ে আসা হবে। সবকিছু বলা শেষে তারা পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেও ভুললেন না।
কলজের ভিতরে মুচড়ে উঠলো। ফ্লাইট বাতিল! জীবনে শত শত বার ফ্লাইটে চড়েছি। ফ্লাই করেছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কিন্তু এর আগে কোনদিন ফ্লাইট বাতিল করে হোটেলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। জীবনে অসংখ্যবার ফ্লাইট ডিলে হয়েছে, তবে একবারও এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যেতে হয়নি। আমার বেশ মনে আছে যে, জীবনে একবার শুধু ফ্লাইট মিস করেছিলাম। নেদারল্যান্ডস থেকে প্যারিস যাওয়ার ফ্লাইট। তবে মাত্র ঘন্টা দুয়েক পরে আমাদেরকে অপর একটি ফ্লাইটে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার বিমানবন্দর থেকে হোটেলে নিয়ে যাবে। অবস্থা নিশ্চয় খারাপ। ক’দিনের জন্য এখানে আটকা পড়তে যাচ্ছি কে জানে!
আমি তড়িঘড়ি কফি শেষ করলাম। এয়ারলাইন্সের লোকজনের ছোটাছুটি চোখে পড়ছিল। তারা মুখে অদ্ভুত এক ভঙ্গি করে ওই ফ্লাইটের গুয়াংজুর যাত্রীদের খোঁজাখুঁজি করছিলেন। আমি কফির মগ উঁচিয়ে শেষ করে আসছি বলে জানালাম। কিন্তু মেয়েটি আমাকে অনেকটা টেনে বিমানবন্দরের ‘এক্সিট’ দরোজা দেখিয়ে দিলেন। আমাদের জন্য বিমানবন্দরের লবিতে বাস নিয়ে আসা হয়েছে। অপর এক নারীকর্মী আমাদেরকে সেই বাসে তুলে দিলেন। বললেন, ওয়েদার ঠিক হলে আপনাদের জানানো হবে। এখন হোটেলে চলে যান।
বাসে চড়ে বসলাম। অনেক যাত্রী। পুরো বাস ভর্তি। এরূপ বাস আরো ক’টি নিতে হয়েছে কে জানে! বৃষ্টি ঝরছিল। আমাদের বাস বৃষ্টির মধ্যেই পথে নামলো। চলার পথে এয়ারপোর্টের ধারে কাছে বেশ কয়েকটি হোটেল দেখলাম। তবে ওইসব হোটেলে না গিয়ে বাসটি চলতে থাকলো। আমাদেরকে বেশ কিছুটা দূরে একটি পাঁচতারকা হোটেলে এনে নামিয়ে দেয়া হলো। রিসিপশনে পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আমাদের প্রতি দুইজন যাত্রীর জন্য একটি রুম দেয়া হলো। আমার সাথে সোহেল ভাইকে দেয়া হলো। ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীকে অপর একটি রুম। আমরা নির্দিষ্ট রুমে গেলাম। রুমটিতে ঢুকে চোখ বোলাতেই মনে হলো বিলাসিতার কমতি নেই। পৃথক দুইটি খাটে ধবধবে সাদা নরম বিছানা। সুবিন্যস্ত আসবাব, ঝকঝকে পরিবেশ। সবকিছু্ই সাজানো গোছানো। রুমটির আবহ আমার দারুণ পছন্দ হলো। ফ্লাইট মিস হলেও নতুন একটি হোটেলে রাত কাটাতে এসে খুব একটা খারাপ লাগছিলো না। ফ্রেশ হয়ে আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াতেই মনে পড়লো–পোষাক বদলাবো কী করে! সবই তো লাগেজে, যা এতোক্ষণে নিশ্চয় বিমানের পেটে। বুঝতে পারলাম যে, প্যান্ট–শার্ট পরেই রাতটা কাটাতে হবে। সোহেল ভাই বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী পাশের রুমে কী করছেন কে জানে!
আমাদের সব দায়দায়িত্ব এখন ফ্লাইট অপারেটরের। হোটেলে রাখা থেকে শুরু করে রাতের ডিনার, সকালের নাস্তাসহ যতক্ষন এখানে থাকি তার সব খরচই তাদের। শুধু অর্ডার দিয়ে কিছু খেতে চাইলে নিজেকে পেমেন্ট করতে হবে। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, রুমের ভিতরে কফিমেকার রয়েছে, রয়েছে কফি বানানোর সব সরঞ্জামও। অতএব কফির জন্য অর্ডার করার প্রয়োজন হবে না। মিনিবারে ফ্রিজ ভর্তি মদ–বিয়ারসহ নানা ড্রিংকস, বাদাম চিপ্স। কফি ফ্রি হলেও মিনিবারের সব জিনিসই পকেটের কড়ি দিয়ে কিনতে হবে।
সোহেল ভাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাকের হালকা আওয়াজে বুঝতে পারছিলাম যে, সারাদিনের ধকলের পর বেচারা ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছেন। ভাবলাম, ডিনারের ডাক এলে ওনাকে জাগাবো। আমি কফিমেকার চালিয়ে দিলাম।
চীনে ডিনারের টাইম বহু আগেই গত হয়ে গেছে। হোটেলের নিয়মিত অতিথিদের জন্য যে খাবার রান্না হয়েছিল ইতোমধ্যে তা শেষ। এখন একসাথে এত বেশি লোক এয়ারলাইন্স থেকে পাঠানো হয়েছে যে, নতুন করে চুলা জ্বালাতে হচ্ছে। রিসিপশন থেকে আমাদের বলা হয়েছে যে, খাবার রেডি হচ্ছে, আধাঘন্টা লাগবে। সব রেডি করে আমাদের জানানো হবে।
কফি শেষ করে সোফায় বসে টিভি অন করলাম। চীনা ভাষার কিছু না বুঝলেও বডি–ল্যাঙ্গুজের শরণাপন্ন হয়ে সময় পার করছিলাম। ইন্টারকমে খবর এলো যে, ডিনার রেডি। রেস্টুরেন্ট দোতলায়। সোহেল ভাইকে জাগালাম। করিম ভাইকেও ডেকে নিলাম। দোতলায় গিয়ে রেস্টুরেন্টে ব্যুফে ডিনারে কোনটি খাওয়া যায় তার খোঁজ করে দেখলাম যে, আয়োজন অনেক। আসলে তারকাখচিত হোটেলগুলোর ভাবসাবই আলাদা। মাত্র আধাঘন্টার মধ্যে বিয়ে বাড়ির আয়োজন করে ফেলেছে!
বিশাল রেস্টুরেন্ট, অনেক মানুষ। বুঝতে পারছিলাম যে, সবাই এয়ারলাইন্সের যাত্রী। আমরা চারজন একটি খালি টেবিল খুঁজে নিয়ে বসলাম। আমি স্যুপের বাটিতে রয়ে সয়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। অন্যান্য খাবার নিতে যাবো এমন সময় খবর এলো যে, ওয়েদার ঠিক হয়ে গেছে, ফ্লাইট ছাড়বে। আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বাসে চড়ার তাগাদা দেয়া হলো। বুঝতে পারলাম না, এটা কী হলো!
তড়িঘড়ি করে নাকে মুখে কিছু গুঁছে দিয়ে বাসে চড়লাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি। বৃষ্টির মাঝে ওয়েদার কিভাবে ঠিক হলো কে জানে! বৃষ্টিতে ফ্লাইট চলাচলে অসুবিধা হয় না। তবে মেঘের তোড়জোড় মাঝেমধ্যে ঝামেলা করে। এয়ার গ্যাপের ধকলও সামলে নিতে হয়। গুয়াংজুর ঘূর্ণিঝড়ের কি অবস্থা জানি না। কোন অনিশ্চয়তায় পথে নামছি বুঝতে পারছিলাম না। তবে ভরসার কথা হচ্ছে, রাডারের সাহায্যে ওয়েদারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ফ্লাইট অপারেটর বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত নিতো না। চীনা রাডার ঠিকঠাকভাবে রিডিং দিচ্ছে তো!
বিমানবন্দরে বাস থেকে নামার সাথে সাথেই এয়ারলাইন্সের নারী কর্মীরা আমাদেরকে অনেকটা ছোঁ মেরে নেয়ার মতো করে সামনে নিয়ে গেলেন। আমাদের বোর্ডিং করা আছে, লাগেজ দেয়ার ঝামেলা নেই। ডোমেস্টিক ফ্লাইটে ইমিগ্রেশন নেই। এখন শুধু সিকিউরিটি চেকিং সম্পন্ন করে এয়ারক্রাফটে চড়ে বসা। আর এই কাজগুলো এয়ারলাইন্সের না হলেও তারা সবগুলো কাজেই আমাদের সাথে থাকলেন এবং অসম্ভব দ্রুততায় সব সম্পন্ন করে আমাদেরকে বোর্ডিং গেটে নিয়ে গেলেন। গেটের মুখে আমাদের কার্ডের অর্ধেক ছিঁড়ে রেখে এয়ারক্রাফটের দিকে এগুনোর নির্দেশনা দেয়া হলো। বোর্ডিং ব্রিজ ধরে আমরা ফ্লাইটের পেটে ঢুকে পড়লাম। আমি উইন্ডো সিট নিয়েছিলাম। জানালায় চোখ দিয়ে দেখলাম যে, বৃষ্টি ঝরছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। আমার বুকের ভিতরের দুরু দুরু বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।