(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমাদের বিমান কেবলই উপরে উঠছিল, ওড়ছিল। ঘন্টায় প্রায় সাতশ’ কিলোমিটার বেগে ছুটছে আমাদের বোয়িং। দেড় হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে আমাদের দুই ঘন্টারও বেশী সময় লাগবে। গুয়াংজু থেকে সাংহাইর দিকে ছুটছি আমরা। গল্পে গল্পে সময় পার করলেও ভিতরে কাজ করছে তীব্র উত্তেজনা। প্রথমত চীন সফরের জন্য আমি খুবই এক্সাইটেড, দ্বিতীয়ত সাংহাই। চীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নগরীর কথা শুনে আসছি বহু বছর ধরে। আদা ব্যাপারীর নাকি জাহাজের খবর নিতে হয়না। কিন্তু আদা বেপারীর চেয়ে বহু বেশি নগণ্য হলেও দৈনিক আজাদীর বদৌলতে আমাকে অনেকদিন ধরে নিয়মিত জাহাজের খবরাখবর রাখতে হয়, বন্দর এবং কন্টেনার আমার লিখিত বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর অন্যতম। আর এই বন্দরের কথা লিখতে গিয়ে, কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিসংখ্যান তুলতে গিয়ে অগুনতি বার লিখতে হয়েছে সাংহাইর নাম। বিভিন্ন সময় শিপিং বিষয়ক বিভিন্ন আড্ডায় কত শত বার যে এই সাংহাইর নাম উচ্চারণ করেছি তার কী ইয়ত্তা আছে! বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর হিসেবে সাংহাইর অবস্থান বেশ পোক্ত। আন্তর্জাতিক শিপিং বাণিজ্য সাংহাইকে বাদ দিয়ে কল্পনাও করা যায়না। শিপিং রিপোর্টিং করতে গিয়ে বহুবছর ধরে শুনে আসা এই সাংহাইর নাম নতুনভাবে আলোচনায় আসে কর্ণফুলীর তলদেশের টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহনের শুরু থেকে। এই টানেল নিয়ে যত শত রিপোর্ট লিখেছি তার প্রায় প্রতিটিতেই অবধারিতভাবে এসেছে চীনের এই শহরটির নাম। চট্টগ্রামকে সাংহাইর আদলে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশের নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ শব্দটিও প্রথম শুনেছিলাম সাংহাই’র মাধ্যমে। পৃথিবীতে বহু শহরই নদী দিয়ে বিভক্ত। নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে শহর। এই ধরনের শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ বলা হয়। কিন্তু কর্ণফুলীর তলদেশের টানেল নির্মাণকালে পৃথিবীর আর কোন নদী দিয়ে বিভক্ত শহরের নাম উল্লেখ করা হয়নি। একেবারে শুরু থেকে বলা হচ্ছে যে, এই টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে সাংহাইর মতো করে গড়ে তোলা হবে। আর এভাবে শুনতে শুনতে সাংহাইর প্রতি একটি ভালোবাসাও তৈরি হয় একেবারে মনের গহিনে। শুধু আমারই নয়, এই ধরনের ভালোবাসা মনে হয় আরো অনেকের মনে বসতি গড়েছে। আমাদের স্বপ্নের সাংহাই শহরে এসে গেছি কিংবা অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে অবতরণ করতে যাচ্ছি এমন ভাবনায় বেশ উচ্ছ্বসিত আমি।
নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ফ্লাইট সাংহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করলো। এখানেও দারুণ ল্যান্ডিং। কলজে মোচড় দেয়ার কোন ঘটনাই ঘটলো না। সাংহাইর রানওয়ে যেনো একেবারে আলতো করে আমাদের বোয়িংকে নিজের কোলে তুলে নিল!
সাংহাই নামটির সাথেও কেমন যেন একটি ছন্দ রয়েছে। সাংহাই! বেশ মমতা মোড়ানো একটি শব্দ। কেমন যেনো একটু ভালোলাগাও রয়েছে শব্দটির পরতে পরতে। সাংহাই শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘সাগরের উপরে’। যতটুকু জেনেছি সাংহাইতে সাগর এবং নদী দুইটি রয়েছে। নদীর দু্ই পাড়ে ঘটেছে শহরের বিস্তৃতি। হাজার বছর ধরে এই শহর কেবলই সমৃদ্ধ হয়েছে। চট্টগ্রামে শহর বিস্তৃত হয়েছে কর্ণফুলীর একপাড়ে। কর্ণফুলীর মতো অভাগা নদী দুনিয়াতে খুব বেশি নেই। এই নদীর দুই পাড়ের জায়গা জমির যে বেহাল অবস্থা তার তুলনাও দুনিয়ার কোথাও মিলানো যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে নদীর পাড়ই হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান জায়গা, সুন্দর জায়গা। বহুদেশে কৃত্রিম নদী তৈরি করে জায়গার মান বাড়ানো হয়েছে। শহরের বুকে কৃত্রিম ভাবে নদী নিয়ে আসা হয়েছে। নদীর পাড়ে শান্তি খুঁজেন লাখো কোটি মানুষ, অথচ অভাগা কর্ণফুলীর পাড়ে পাড়ে জাল শুকানোর মহোৎসব চলে। চলে জাল বুননের কাজও। বস্তির অবাধ বিস্তার কিংবা মাছের বাজারসহ নানা অনিয়ন্ত্রিত স্থাপনার কবলে কর্ণফুলীর পাড়। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে নদীর অপর পাড়, দক্ষিণ পাড়। শহর তো দূর অস্ত, সেখানে স্বাভাবিক মানবিক জীবনযাত্রাও বহুক্ষেত্রে অকল্পনীয়। লাশবাহী খাটিয়া নেয়া যাবে না এমন বহু জায়গা রয়েছে নদীর পাড়ে গড়ে উঠা বাড়িগুলোতে। অথচ এমন নদীর এমন পাড় নিয়ে দুনিয়ার বহু দেশের মানুষই নজরকাড়া কত কিছু যে করে, চোখ ধাঁধানো কত কি বানায়! আশার কথা হচ্ছে, কর্ণফুলীর তলদেশের টানেল চালু হলে নদীর অপরপাড়েও শহরের বিস্তৃতি ঘটবে, অপরপাড়েও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। তখন চট্টগ্রামও সাংহাইর আদলে গড়ে উঠবে!
বিমানবন্দরে অবতরণ করে আমি একটু ভড়কে গেলাম। চারদিকে চোখ ধাঁধানো জৌলুশ। গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখে চোখ কপালে উঠেছিল, এখন মনে হচ্ছে চোখ মাথার তালুর দিকে যেতে শুরু করেছে। এত বড় বিমানবন্দর! ডোমেস্টিক টার্মিনাল এত বড় এবং চটকদার হলে আন্তর্জাতিক টার্মিনালের কী অবস্থা!! জীবনে অসংখ্যবার সাংহাইর সাথে চট্টগ্রামের তুলনা করতে গিয়ে অবচেতন মনে শহর দুইটির মধ্যে একটি মিলও আমি কল্পনা করেছিলাম। এখন শুধু বিমানবন্দর দেখেই আমার কল্পনার ফানুস ফুটো হতে শুরু করেছে, আমি যে কত বড় ভুলের মাঝে ছিলাম তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
আমার ভাবসাব দেখে লায়ন ফজলে করিম বললেন, কোন সমস্যা লিডার? কি ভাবছেন? আমি সাংহাই বিমানবন্দরের বিশালতায় চমকে যাওয়ার কথা জানালাম। লায়ন ফজলে করিম হাসলেন, বললেন, আপনি কিন্তু একটি বিমানবন্দর দেখছেন। সাংহাইতে কিন্তু আরো একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। একটি শহরে দুইটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর! এর একটি সাংহাই পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ফ্লাইট উঠা নামা করে। ওই বিমানবন্দরের চারটি রানওয়েতে হরদম চলে বিশ্বের দুইশ’টিরও বেশি দেশের সাথে চলাচলকারী শত শত বোয়িং,এয়ারবাস। অপর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাংহাই হংকিয়াও বিমানবন্দর। এটির দুইটি টার্মিনালের একটি থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটগুলো পরিচালিত হয়। অপর টার্মিনাল থেকে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওড়াওড়ি করে। চীনের সরকারি বেসরকারি অনেকগুলো ফ্লাইট অপারেটর তাদের হাব (প্রধান ঘাঁটি) হিসেবে ব্যবহার করে এই দুইটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে। দুইটি বিমানবন্দরে পাঁচটি আলাদা রানওয়ে এবং একাধিক টেক্সিওয়ে রয়েছে। বিমানবন্দর দুইটিতে বছরে অন্তত ১২ কোটি যাত্রী হ্যান্ডলিং করে। আমাদের ফ্লাইট নেমেছে হংকিয়াও বিমানবন্দরে। এই বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারেরও বেশি ডোমেস্টিক ফ্লাইট উঠানামা করে।
একটি শহরে দুইটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর!! একটি শহরে বছরে ১২ কোটি বিমানযাত্রী হ্যান্ডলিং! আমি যেন একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছিলাম। কোন বিচারে এতদিন সাংহাইর সাথে চট্টগ্রামের তুলনা করে আসছিলাম কে জানে!
মোবাইলে ওয়াই-ফাই কানেকশন করে দ্রুত নেট দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম। সাংহাই’র ব্যাপারে একটু লেখাপড়া করতে শুরু করলাম। চোখের সামনে মোবাইল ধরে পথ চলতে কিছুটা অসুবিধা হলেও এক একটি তথ্য আমার মগজে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল। বিস্তারিত কোন লেখাপড়া না করে শহরটিতে এসে পড়া ঠিক হয়নি। আরো কিছু তথ্য উপাত্ত আগেভাগে জেনে রাখলে বেড়ানোটা আনন্দময় হতো! কেন যে সাংহাইকে আমাদের পোড়া শহরের মতো ভাবছিলাম কে জানে! লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমরা। অনেকগুলো বেল্টই ক্রমাগত ঘুরছে। আমাদের জন্য নির্ধারিত বেল্টে এসে দাঁড়িয়ে আছি। অন্য একটি ফ্লাইটের যাত্রীদের লাগেজ দেয়া হয়েছে। এটি শেষ হলে আমাদের লাগেজ দেয়া হবে। লাগেজ বেল্টেও কিউ! কত ফ্লাইট আর যাত্রী হলে এই ঘটনা ঘটতে পারে!
লাগেজের অপেক্ষা করতে করতে মোবাইল ফোনে সাংহাইর ব্যাপারে নানা কিছু পড়ছিলাম। পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মেগাসিটি সাংহাই। আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম, জনবহুল এবং ব্যস্ততম এই শহরে। এর বাইরে প্রতিদিন অন্তত ৭০ লাখ লোক শহরটিতে আসা যাওয়া করে। তিন কোটিরও বেশি মানুষের সাংহাই শহরে প্রবেশ করার আগেই আমার ধারণা একেবারে পাল্টে গেল। ৬২০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক হাজার বছরেরও বেশি পুরানো শহরটিতে মানুষের জয়গান রচিত হয় রাতে দিনে। এই শহরে মাটির উপরে যেমন করে গিজগিজ করে মানুষ, ঠিক তেমনি মাটিরও নিচেও মানুষের হরদম আনাগোনা চলে। পুরো শহর জুড়ে পাতাল ট্রেনের নেটওয়ার্ক শহরটিকে বিশ্বমানের বাসযোগ্য শহরে উন্নীত করেছে। আমি লায়ন ফজলে করিমের দিকে তাকালাম! তিনি নিজের মতো করে কার সাথে যেন কথা বলছিলেন। আমি আমাদের সফরসঙ্গীদের দিকে তাকালাম। কারো চোখে মুখে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কি করে যে চট্টগ্রামের সাথে সাংহাইর তুলনা করে এতগুলো দিন পার করলাম তা এক ভাবনার মহাসাগরে ফেলে দিল আমাকে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।












