দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অভাবনীয় অভ্যর্থনার পর আমাদেরকে একটি হলরুমে নিয়ে যাওয়া হলো। দারুণ নান্দনিক একটি অফিস, একেবারে চকচক করছে। ময়লা আবর্জনার কোন চিহ্নই নেই, কাগজপত্রের বালাই নেই বললেই চলে। টেবিলে টেবিলে ল্যাপটপ, কম্পিউটার। সেলাই মেশিনসহ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ প্রস্তুতকারক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় কেমনে এতো সুন্দর হয় তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। জ্যাক কোম্পানির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আসলেন। আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। তারা আমাদেরকে পুরো অফিসটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। অসাধারণ একটি জিনিস দেখলাম অফিসটিতে। একটি জাদুঘর বানানো হয়েছে,সেলাই মেশিনের জাদুঘর। পায়ে চালানো মেশিন, হাতে চালানো মেশিনের যুগ থেকে কি করে ইলেক্ট্রিক মেশিন, ইলেক্ট্রিক মেশিন থেকে রোবটিক মেশিনসহ সবকিছু এতো সুন্দর করে তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কোন মেশিনটি কতসালে বাজারে এসেছে তাও লিখে রাখা হয়েছে।

প্রধান কার্যালয়ের পাশেই অপর একটি ভবনে কারখানা। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। কী করে সেলাই মেশিন থেকে বোরট পর্যন্ত কারখানাটিতে বানানো হচ্ছে তা চাক্ষুস দেখানো হচ্ছিল। ছোট্ট একটি লোহার টুকরো মেশিনে দেয়ার পর অপর পাশে বেরিয়ে যাচ্ছে সেলাই মেশিনের কাঠামো। পরে সূচসহ অন্যান্য পার্টস জোড়া দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আস্ত মেশিন। লোহার টুকরো থেকে বানানো হচ্ছে রোবট, ডিভাইজ। আবার সেই রোবটকেই কারখানার নানা কাজে লাগানো হচ্ছে। মেশিনের রঙ করা থেকে স্ক্রু লাগানো পর্যন্ত সব কাজই করছে রোবট। আবার প্রস্তুতকৃত মেশিন প্যাকেট করার পর তা গুদামে নিয়ে যাচ্ছে রোবট। ওয়্যারহাউজে রোবট নিয়ে একুশ তাক উচ্চতায় জিনিসপত্র রেখে আসছে। নিজে নিজে লিফট চালিয়ে এই তলা ওতলায় পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। শিপমেন্টের সময় রোবটই পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে ডেলিভারি পয়েন্ট পর্যন্ত। এই রোবটও আবার বানানো হচ্ছে জ্যাকেরই কারখানাতে। একটি রোবট দিয়ে গড়ে একশ’ মানুষের কাজ করাচ্ছে জ্যাক। কী সাংঘাতিক! আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্ট মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে কে জানে! কর্মহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠির ভারে একদিন পৃথিবীর অবস্থা কি হবে তা ভেবে শিউরে উঠলাম। প্রতিটি খাতে প্রযুক্তির এমন উৎকর্ষতা পৃথিবীকে কী হুমকির মুখে ফেলছে!

বিশাল কারখানা ঘুরে ঘুরে আমরা দেখলাম। দেখলাম উৎপাদনের নানা প্রক্রিয়া থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত সবকিছুই। হাঁটতে হাঁটতে শরীর কাহিল হয়ে উঠলো, তবুও যেনো শেষ হচ্ছিলো না। একসময় আমাদের লাঞ্চের জন্য বলা হলো। বললো যে, কর্মরত সবার জন্য অফিস থেকে লাঞ্চ দেয়া হয়। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে উন্নতির শীর্ষে যাওয়া মি.জ্যাক অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুপুরের খাবার ফ্রিতে খাওয়ান। আজ আমরাও তাদের সাথে খাবো।

আমাদেরকে বিশাল এক ডাইনিং রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। অনেক চেয়ার টেবিল। শত শত। ব্যুফে খাবার। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। স্যুপের সাথে এ্যাপাটাইজার নিলাম। নানা ধরনের এ্যাপাটাইজার এবং মেইন ডিসের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দুই ধরনের স্যুপ, চিকেন এবং ভেজিটেবল। লায়ন ফজলে করিম ভাই আমাকে ভেজিটেবল ক্লিয়ার স্যুপ নিতে পরামর্শ দিলেন। ভাজাভুজি জাতীয় এ্যাপাটাইজার অনেক রকমের। তবে আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিলাম। মিক্সড ভেজিটেবল, লাল আলু এবং ভুট্টা সেদ্ধ, পুই শাকের মতো একটি সবুজ শাক, মাছ ভাজা, মাছের গ্রিল এর সাথে ভাত খেলাম। সালাদ আইটেমে শসার সাথে গাজর এবং কাঁচামরিচ ছিল। আমার লাঞ্চ জমে যেতে এর থেকে বেশি কিছুর দরকার ছিল না। লাঞ্চ শেষে এক মগ কফি আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিলো।

খাওয়াদাওয়ার পর আমাদেরকে আবারো বাসে তোলা হলো। আমাদের প্রটোকলে থাকা শাসা এবং ফ্রাঞ্চি আমাদের বাসটি খুঁজে নিলো। পার্কিংয়ে অনেকগুলো বাস। সবগুলোই একইরকম। আবার সবগুলো বাসেরই ড্রাইভার চাইনিজ, তাদের সবার চেহারাও অনেকটা একইরকম। এতে করে প্রটোকল অফিসারেরা বলে না দিলে আমাদের বাস খুঁজে নিতে কষ্ট হতো।

জ্যাক হেডকোয়ার্টার থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলো আমাদের বাস। তাইজু শহরের দিকে যাচ্ছিলাম আমরা। অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা। দুইপাশে সারি সারি কারখানা। বিখ্যাত সব শিল্প কারখানাই হবে মনে হয় এগুলো। তবে চীনা ভাষার একটি সাইনবোর্ড কিংবা বিলবোর্ডও পড়তে পারলাম না।

বেশ বড়সড় একটি ভবনের সামনে এসে বাস থামলো। আমাদেরকে বলা হলো হোটেলে পৌঁছে গেছি। বাস থেকে লাগেজ নিয়ে নামতে বলে শাসা ও ফ্রাঞ্চি অনেকটা দৌঁড়ের উপর ভিতরে চলে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে, তারা আগে গিয়ে আমাদের রুমের চাবি নেবে। যাতে রিসিপশনে আমাদের বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে না হয়।

বাস থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে এগুতে হোটেলের লোগোতে চোখ পড়তেই আমার মন ভালো হয়ে গেলো। শেরাটন। তাইজু শেরাটন। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই চেইন হোটেলের সেবা বেশ দামি। জ্যাকের মতো কোম্পানির শেরাটন না হলে যেনো মানাতোই না। দেশের শেরাটনে কোনদিন থাকার সুযোগ না পেলেও আমেরিকা এবং মিশরে শেরাটনে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাই তাদের সার্ভিস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রয়েছে। রিসিপশনের লবিতে গিয়ে ফ্রাঞ্চির সাথে চোখাচোখি হলো। বললো, একটু অপেক্ষা করেন, সোফায় গিয়ে বসেন। আমাদের চেকইন ফ্রাঞ্চি ও শাসা করাচ্ছে। তারাই আমাদেরকে চাবি এনে দেবে। ডেস্কের সামনে গিয়ে আমাদের দাঁড়ানোর দরকার হচ্ছে না। বেশ সুন্দর একটি ট্রেতে ওয়েলকাম ড্রিংকস সার্ভ করলেন এক চীনা সুন্দরী। পানীয়টি অসাধারণ। শেরাটনের প্রথম চমকটি মনে হয় ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়েই দেয়া হলো।

রুমের চাবি দেয়া হলো। অনেকগুলো লিফট হরদম উঠানামা করছে। আমার রুম ১১ তলায়, করিম ভাইয়ের ১৬ তলায়। সোহেল ভাইকে দেয়া হয়েছে ১৯ তলায়। এটি উপরের দিকে আরো কত তলা আছে কে জানে! প্রত্যেকেই আমরা প্রত্যেকের রুম নম্বর লিখে নিলাম। খুব টায়ার্ড লাগছিল। ঘুমাবো বলে জানিয়ে পরস্পরের থেকে বিদায় নিলাম।

রুমে ঢুকেই যথারীতি মনটি ভালো হয়ে গেলো। অসাধারণ সব আয়োজন রুমের পরতে পরতে। রুমটি বিশাল। ধবধবে সাদা বিছানা, কাপল বেড। চারটি বালিশের সাথে দুইটি পিলুও দেয়া আছে। বড় স্কিনের টিভি, ডিভাইন, সোফা, চেয়ারটেবিল, টেবিল ল্যাম্প, মোবাইল চার্জার, মিনিবার, কফি মেকার, চা কফি বানানোর সরঞ্জাম। ওয়াশরুমে ঢুঁ মারলাম, দারুণ। ঝকমক করছে। ঢাউশ সাইজের দুইটির সাথে মাঝারী ও ছোট আকৃতির সাদা তোয়ালে। মনে হচ্ছে একেবারে নতুন, যেনো আজই এনে দেয়া হয়েছে। টুথ পেস্টব্রাশ, শেভিং কীট, স্যাম্পু, সাবান, বডি লোশন, হেয়ার ড্রায়ারসবই এক ঝলকে দেখে নিলাম। একজন মানুষের যা যা প্রয়োজন তার সবই রুম এবং ওয়াশরুমে দিয়ে রাখা হয়েছে।

ফ্রেশ হলাম। এসির ডিজিটাল সুইচটি ঠিকঠাক করে রুমের আবহ একেবারে শীতল করে লেপমুড়ি দিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবো না। সকালে আর্লি ঘুম থেকে উঠা, দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া এবং জ্যাক হেডকোয়ার্টারে দৌড়াদৌড়ির ফলে শরীর বেশ কাহিল ছিল। বিছানায় গড়ানোর সাথে সাথে লেগে এসেছিল চোখ। সেই ঘুমে কি করে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা গড়িয়েছে বলতে পারি না। কী কী সব স্বপ্ন টপ্নও মনে দেখেছিলাম। ঠিকঠাক মতো মনে করতে পারলাম না। টেলিফোনের আচমকা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলে এমন বরফশীতল জায়গায় আমি কি করে এলাম তা মনে করতেও কিছুক্ষণ সময় লেগে গেলো। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে করিম ভাই নিচে নামার তাগাদা দিয়ে বললেন, ডিনারে যাবো।

এক কাপ কফি বানাবো কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু মনে হলো, ডিনারের আগে কফি খাওয়া ঠিক হবে না। ডিনার সেরে এসে চুমুক দেবো। চীনারা যে সন্ধ্যার পরপরই ডিনারে বসে যায় সেটা আমি জানি, কিন্তু আমার শরীর তো সেটা মানতে চাচ্ছে না। ক্ষুধা না থাকলেও আমি ডিনারে যোগ দিতে রেস্টুরেন্টের পথ ধরলাম।

চীনের রেস্টুরেন্টগুলো প্রায়ই একই আদলের। বিশাল এবং ঘূর্ণায়মান টেবিল। রেস্টুরেন্টের ভিতরে ছোট ছোট রুমও রয়েছে। যেখানে একটি বা দুইটি টেবিল দেয়া থাকে। নিজেদের মতো করে হৈ হৈ করতে করতে লাঞ্চ ডিনার সারা যায়। এতে সুবিধা হচ্ছে প্রাইভেসি যেমন রক্ষা হয়, তেমন অন্যদেরও ডিস্ট্রাব হয় না। আমাদের কয়েকজনের জন্য এই ধরনের একটি রুমে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। খাবারের কাফেলা আসা শুরু হলে আমার চোখজোড়া কপালে উঠার উপক্রম হয়। টেবিলে জায়গা হচ্ছিলো না। এরা কেন যে এতো এত্তো খাবারের অর্ডার করে কে জানে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বর্গ দুয়ার খুলে
পরবর্তী নিবন্ধসাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়াকে যেমন দেখেছি