দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ডিনার সারলাম আমরা। এখানে ডিনার মানে শুধু গপাগপ খাওয়া নয়, গল্পে গল্পে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়াদাওয়া। আন্তর্জাতিক ডিনারগুলোতে খাওয়ার চেয়ে কথা হয় বেশি, গল্পও। নানা দেশের নানা জাতের নানা গল্প যেনো একই ছন্দে বাজতে থাকে। কী যে ভালো লাগে! চীন দেশের সর্বত্রই যথেষ্ট বাছবিচার করেই খাবার খেতে হয়। তবে আমার সুবিধা হচ্ছে লায়ন ফজলে করিম ভাই চীনের প্রায় সব খাবারই কমবেশি চিনেন। ঝামেলার গুলো তিনি একটু বেশিই চিনেন। সুতরাং, ওনি কিংবা ডালিয়া ভাবী যেটা তুলে নেন, সেটাতে অনায়াসে হাত চালানো যায়। আর অনায়াসে হাত চালাতে গিয়ে নানা পদের খাবার একটু একটু করে চেখে দেখতে গিয়ে প্রচুর খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। আনন্দের সাথে খাওয়া দাওয়া করতে গেলে একটু বেশিই হয়ে যায়। চীনা ডিসে ঠাসা ডিনারের টেবিলে আমরা কখনো চামুচ দিয়ে, কখনো চপস্টিক দিয়ে খাবার খাচ্ছিলাম। কখনো হাসতে হাসতে, কখনো শার্টপ্যান্ট মাখামাখি করেও আমাদের আনন্দে ভাটা পড়ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ার উপর থাকার পর চেয়ার ছাড়তে গিয়ে টের পেলাম যে, স্যুপটা না খেলেই ভালো হতো।

হ্যাংঝো শহরের আলীশান হোটেলের রাজকীয় আতিথেয়তায় রাত কেটে গেল। তুলতুলে নরোম বিছানায় আপদমস্তক আরো নরোম লেপে মুড়িয়ে দুর্দান্ত একটি ঘুম দিলাম। রুমের এসি একেবারে লো করে রাতভর লেপের ভিতরে স্বপ্ন দেখা কী যে সুুখের! যে স্বপ্নের রেশ থেকে যায় পরদিন সকালেও। কিন্তু সাতসকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো, আরো একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো।

লায়ন ফজলে করিম ভাই ইন্টারকমে তাড়া দিলেন। বললেন, দ্রুত ব্রেকফাস্ট করতে হবে। বাস ছেড়ে দেবে। ব্যাগ ব্যাগেজসহ নেমে পড়েন, নাস্তা সেরে চেকআউট করে নেবো। সকালে চেকআউট করার মতো যন্ত্রণা দুনিয়াতে খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয়না। ভোর বা সকালের ফ্লাইট ধরতে কিংবা কোন ট্যুর থাকলে সবকিছুর বারোটা বেজে যায়। আমি লাগেজ গুছিয়ে রুমে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

রিসিপশনে লাগেজ রেখে রুমের চাবি বুঝিয়ে দিলাম। বললাম, চেকআউট করবো। হিসেবনিকেশ মিলিয়ে নিন। নাস্তা সেরে এসে ক্লিয়ারেন্স নেবো। এই ক্লিয়ারেন্স আগে নিতাম না। তবে প্যারিসের মারকিউর হোটেলের একটি ঘটনার পর থেকে কোন ফাইভ স্টার হোটেল থেকেই আমি ক্লিয়ারেন্সের কাগজ না নিয়ে বের হইনা। বছর কয়েক আগের একটি ঘটনা আমাকে অনেক বড় একটি শিক্ষা দিয়েছে। সামাজিক ব্যবসা ধারণার প্রবক্তা, শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের আমন্ত্রণে ওবার আমি তৃতীয়বারের মতো প্যারিস গিয়েছিলাম। আমাকে রাখা হয়েছিল প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রের মারকিউর হোটেলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই চেইন হোটেলটি থাকলেও এটির মালিকানা ফ্রান্সের। তাই প্যারিসে তাদের বেশ অনেকগুলো হোটেল রয়েছে। সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন শেষে আমি প্যারিস থেকে লন্ডন চলে যাই। যথারীতি হোটেল ছেড়ে যাওয়ার সময় রিসিপশন থেকে আমাকে একটি ছাড়পত্র দেয়া হয়। এই ছাড়পত্রের অর্থ হচ্ছে, হোটেলের সব পাওনা মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। মিনিবার ব্যবহার করিনি। আমার সাথে হোটেলের আর কোন লেনদেন নেই। কিন্তু সাতদিন পর গ্রামীণের ঢাকা অফিস থেকে আমার স্ত্রীকে ফোন করে আমার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। বলা হয় যে, আমি প্যারিসের হোটেল ছাড়িনি। তারা রুমটি আমার নামেই সাতদিন ধরে ভাড়া গুনছে। যা তারা গ্রামীণের কাছে দাবি করেছে। আমার স্ত্রী আমাকে লন্ডনের নম্বরে ফোন করে খবরটি দেয়ার পর আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিষয়টি টাকা পয়সার চেয়ে অনেক বেশি মনে হয় সম্মানের। যেখানে আমার দেশের সম্মান জড়িত, প্রফেসর ইউনূস স্যারের সম্মান জড়িত, জড়িত আমার কমনসেন্স এবং ব্যক্তিগত সম্মানের ইস্যুও।

আমার স্ত্রী যখন ফোন করে তখন আমি লন্ডন আই’র সামনে ঘোরাঘুরি করছিলাম। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে পড়ছিল যে, মারকিউর হোটেল থেকে চেকআউট করার সময় আমাকে একটি কাগজ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অতি অনাদরে রাখা কাগজটি ঠিক কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। তবে মনে হচ্ছিল কাগজটি আমার কাছে থাকবে। দ্রুত ফিরে গেলাম লন্ডনের আমার অস্থায়ী আস্তানায়। সব ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজে এ৪ সাইজের কাগজটি পেয়ে গেলাম। সেটির ছবি তুলে দ্রুত মেইল করলাম ঢাকায় গ্রামীণ অফিসে। আরো বেশি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই সময়কার গ্রামীণের সিইও লামিয়া মোরশেদ আপা এবং প্রফেসর ইউনূস স্যারের তৎকালীন ব্যক্তিগত সহকারী তানভির ভাইকেও মেইল করি। পরে অবশ্য মারকিউর হোটেল দুঃখ প্রকাশ করে। তাদের ওই দুঃখ প্রকাশ আমার যে হয়রানি তা লাঘব হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে জীবনের তরে একটি শিক্ষা লাভ করায় আমি মনে মনে স্বস্তি পেয়েছি। কাগজটি যদি ওদিন খুঁজে না পেতাম বা না রাখতাম তাহলে কোনভাবেই বিশ্বাস করাতে পারতাম না যে, আমি রুমের ইলেক্ট্রনিক্স চাবি জমা দিয়ে চেকআউটের যাবতীয় ফর্মালিটি অনুসরণ করেই হোটেল ছেড়েছি।

যাক, ওই যাত্রায় বেঁচে গেলেও সবসময় বেঁচে যাবো এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই দুনিয়ার যেখানেই যাই না কেন, যার যেভাবে ইচ্ছে হোটেল ছাড়ুক, আমি ক্লিয়ারেন্স পেপার হাতে না নিয়ে রিসিপশন থেকে নড়ি না। তড়িঘড়ি নাকে মুখে কিছু খাবার গুজে দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। কফির মগটি হাতে নিয়েই হাজির হলাম রিসিপশনে। যথারীতি ক্লিয়ারেন্স নিয়েই বাসে চড়লাম।

আমাদের বাস ছেড়ে দিল নির্ধারিত সময়েই। প্রটোকল অফিসার ফ্রাঞ্চি এবং শাসার দাবড়ানিতে কারো পক্ষে দেরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমাদের গন্তব্য তাইজু। এটি হ্যাংঝো থেকে প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার দূরে। বাসে চার ঘন্টার মতো লাগবে। আমি মনে মনে আমাদের দেশে এই দূরত্বের হিসেব কষলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার যে দূরত্ব তার থেকে বেশি। চট্টগ্রাম থেকে গাজীপুর পার হয়ে গেলেই তিনশ’ কিলোমিটার হয়ে থাকে। এই দীর্ঘপথ বাসে বসে থাকবো, নাকি পথিমধ্যে কোথাও নামিয়ে চা কফি খাওয়াবে বুঝতে পারছিলাম না। তবে গাড়িতে প্রচুর শুকনো খাবার। বাদাম, চিপস, বিস্কিট, পানি এবং কোল্ড ড্রিংকস নেয়া হয়েছে। আমরা একেকজন দুই সিট নিয়ে বসেছি। ইচ্ছে করলে চার সিটও নিতে পারি। এরপরও বাসের বহু সিট খালি। যে পরিমাণ শুকনো খাবার গাড়িতে রাখা হয়েছে সেগুলো আমরা মাত্র জনাকয়েক মানুষের চার ঘন্টা নয়, চারদিনে শেষ করাও কঠিন হবে।

তাইজুতে আমি আগেও গিয়েছি। তবে ওবার সাংহাই থেকে বিমানে তাইজু গিয়েছিলাম। পথে এই যে এতো কিছু নতুন নতুন দেখে দেখে যাচ্ছি গতবার তা দেখার সুযোগ হয়নি। এতে করে গতবারের চেয়ে এবারকার সফরটিই বেশ আনন্দদায়ক হচ্ছে। মনে হচ্ছে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কতকিছুই না কুড়িয়ে নিচ্ছি। আসলেই, কত কিছু যে দেখলাম!

গাড়ি চলছে, সেই বিশাল চওড়া রাস্তা। একেবারে মসৃণ। এতো মসৃণ রাস্তা আমি ইউরোপআমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতেই কেবল দেখেছি। তবে ওসব দেশের রাস্তার সাথে চীনের রাস্তার বেশ বড় একটি পার্থক্য চোখ ভরিয়ে দিচ্ছিলো। এতোএত্তো ফুল আমি পৃথিবীর কোন দেশেই রাস্তার পাশে দেখিনি। এমনকি বিশ্বের ফুল উৎপাদনের শীর্ষ স্থানে থাকা নেদারল্যান্ডসেও রাস্তার পাশে এতো ফুল নেই। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ফুল উৎপাদনকারী দেশ আমেরিকার রাস্তাতেও নেই এতো ফুল। কিন্তু চীনের মহাসড়কের দুই পাশেই শত শত প্রজাতির ফুল গাছ, রাস্তার দু’পাশ জুড়ে কেবলই ফুলের বাহার! কত রকমের গাছগাছালী যে রাস্তার দু’পাশে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

মহাসড়কের পাশে বহু ক্ষেত খামার, ফলের বাগান। তাইজুর কমলা পৃথিবীর বিখ্যাত কমলাগুলোর একটি। গতবার তাইজুতে কমলাবাগানে ঢুকে ইচ্ছেমতো কমলা খেয়েছিলাম গাছ থেকে ছিঁড়ে। কিনেও নিয়েছিলাম খামারীর কাছ থেকে। এবারও ইচ্ছে আছে, সুযোগ পেলে কমলা বাগানে ঢুঁ মারতে হবে। তবে এতো টাইট প্রোগ্রাম দিয়ে রাখা হয়েছে যে, শেষতক কমলা বাগান কপালে জুটে কিনা তা নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।

হ্যাংঝোতাইজো মহাসড়কের পাশেই অনেকগুলো শহর,উপশহর এবং জনপদ দেখলাম। এসব শহরের নাম মনে রাখা কঠিন, চীনা ভাষার একটি সাইনবোর্ডও পড়তেও পারি নি। তবে নানা ডিজাইনের নান্দনিক সব সুউচ্চ ভবনই জানান দিচ্ছিল যে, এখানেও জমজমাট ব্যবসা চলে, অভিজাত জীবনযাত্রার পাশাপাশি আলীশান কাজবারের কমতি নেই শহরউপশহরগুলোতে। রাস্তার পাশে অসংখ্য শিল্প কারখানা। বহু ধরনের কলকারখানার চাকা ঘুরছে রাতেদিনে। আমার মনে হলো, এসব শিল্পকারখানাই চীনকে ‘বিশ্বের কারখানায়’ পরিণত করেছে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ের মহামায়া ইকোপার্ক ও খইয়াছড়া ঝর্না দর্শন
পরবর্তী নিবন্ধভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক