দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বনের মধ্যে জীবনে কম রাত কাটাইনি। বনের ভিতরে গা ছমছম করা অন্যরকমের একটি আবহে ঘুমানোর তৃপ্তি অতীতেও নানা দেশে নানাভাবে পেয়েছি। পেয়েছি নিজের দেশেও। স্বদেশে পার্বত্যাঞ্চলে রাত কাটানোর দারুণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে ভয়াল দুইটি রাতের কথা জীবনে কখনো ভুলবো না। সেটি সুন্দরবনের। সুন্দরবনের গহিনে নদীতে ভাসমান জাহাজে রাত কাটাতে গিয়ে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। চীনের সুঝৌ শহরের যেই কটেজে আমাদের নিশিযাপনের ব্যবস্থা হয়েছে সেটা আক্ষরিক অর্থে বন না হলেও পুরোপুরিই বনের আদলই রয়েছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, যেখানে একটি একতলা ঘরে চারদিকে অযুত নিযুত গাছগাছালী এবং পোকামাকড়ের গানবাজনার ভিতরে রাত কাটাচ্ছি সেটা সুন্দরবনের মতো গহীন কোন বন নয়। নয় হিমাচল প্রদেশের সেই পাহাড়ী বনানীও। আমাদের কটেজের কয়েকশ’ মিটারের মধ্যে বয়ে গেছে ৬ লেনের বিশাল রাস্তা। শত শত গাড়ি চলছে ওই রাস্তা দিয়ে। কিন্তু আমরা যেখানে রয়েছি সেখানে গাড়িঘোড়ার কোন আওয়াজ নেই। বনের সোঁদা গন্ধ এবং পোকামাকড়ের বৈচিত্র্যময় আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বনের ভিতরে রাত কাটানোর ভয় লাগলেও ভয়টি ঠিক ভয়ের মতো হয়ে আসছে না। শুধুমাত্র সাপের ভয় ছাড়া অন্য কোন ভয় করছিলাম না আমি। আমার ঘরের কাচের জানালার বাইরে যে পরিমান বড় বড় গাছ গাছালীর সাথে জংলি গাছের সমাহার তাতে বড় বড় সাপখোপের বসতি থাকা অসম্ভব নয়। এখন সাপের যদি হঠাৎ করে নরমাংস কিংবা রক্ত খাওয়ার লোভ জাগে তাহলে তারা তো এদিকে উঁকি মারতেই পারে! কটেজটির চারদিকে প্রচুর কার্বোলিক এসিডের বোতল ঝুলিয়ে রাখা আছে জেনে কিছুটা নির্ভার হলাম। এতে বুঝতে পারলাম যে, হোটেল কর্তৃপক্ষও নিশ্চয় সাপের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছে।

রাত নেমেছে বেশ আগে। পোকামাকড়ের ডাকও কমে এসেছে। তবে হঠাৎ হঠাৎ পাখির ডাক ভেসে আসছিল বন থেকে। আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্রোগ্রাম নেই। এমন বন থেকে বের হয়ে একা একা বাইরে যাওয়াও অসম্ভব। তাই রুমের ভিতরেই টিভি দেখে সময় পার করছিলাম। আমাদের ডিনারের আয়োজন এই হোটেলেই। ডিনারের কথা শুনলে ভয় লাগে! কী পরিমাণ খাবার যে এরা টেবিলে দেয়, কত খাবার যে এরা নষ্ট করে!

লায়ন ফজলে করিম ইন্টারকমে কল দিয়ে ডিনারে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বললেন। তিনি আমার রুমের সামনে আসছেন বলেও জানালেন। ক্ষুধা কিংবা ইচ্ছে না থাকলেও আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম।

ডিনারের আয়োজন কটেজেরই রেস্টুরেন্টে। একটি চারতলা ভবনের টপ ফ্লোরে। আমরা বিভিন্ন রুম থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে জড়ো হলাম। আমাদের প্রটোকল অফিসার ফ্রাঞ্চি এবং শাসা আগে থেকেই জানালার পাশের একটি গোলাকার টেবিলে বসে আছে। আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে ফ্রাঞ্চি টেবিলটিতে বসতে বললো। আমার মনে হলো রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে সুন্দর টেবিলটিতে আমাদের বসতে দেয়া হয়েছে। পাশেই কাচের জানালা। জানালার ওপারে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছিলো সব যেনো বন। কোথাও এক রত্তি আলো নেই। অন্ধকারের যেই এক অপরূপ সৌন্দর্য তা যেনো বনের ভিতরে বসে টের পাচ্ছিলাম আমরা।

ফ্রাঞ্চি এবং শাসা আমাদের সাথে ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের পরিচয় করিয়ে দিলো। তারাও রয়েছে কটেজটিতে। জ্যাক কোম্পানির অতিথি হয়ে সারা দুনিয়া থেকে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং নির্দিষ্ট কিছু দেশের সাংবাদিক রয়েছেন। ভারত থেকে আসা কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এই আমাকেও একই কটেজে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আপাতত বাংলাদেশ, ভারত এবং কলম্বিয়ার ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের সাথে আমাদের টুকটাক পরিচয় এবং কথাবার্তা হলো।

ফ্রাঞ্চি ওয়েটারদের চীনা ভাষায় কি কি সব বললো। ব্যস্ততা বেড়ে গেলো ওয়েটার মেয়েগুলোর। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বড়সড় রেস্টুরেন্টের প্রায় সবগুলো টেবিলই গোলাকার। আর প্রায় প্রতিটি টেবিলেই লোকজন ডিনার সারছেন। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ওয়াইন এবং বিয়ারের ক্যান নিয়ে মেতে রয়েছেন। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় বেশ ভালোভাবে খেয়াল করেছি যে, ইউরোপের মতো এরাও ডিনারে মূল খাবারের আগে মদ বিয়ারে গলা ভিজায়। চুক চুক করে মদ বিয়ার নিয়ে মজা করে সময় কাটায়, পরে ডিনার করে।

ডিনার মানে মাছ মাংসসহ তরিতরকারির ভোজোৎসব। ভাত রুটির পরিমাণ খুবই কম। আমাদের টেবিলে মদ বিয়ারের ঝামেলা নেই, তাই শুরু থেকেই শাকসবজি এবং মাছ মাংস আসতে শুরু করলো।

কয়েক রকমের শাক লতা পাতা, কচু পোড়া, আলু পোড়া, লাল আলু পোড়া, পেঁয়াজুর মতো বড়া, বেশ কয়েক রকমের মাছ, হাঁস মুরগিসহ নানা জাতের মাংসের রকমারি পদ। আমরা টুকটুক করে বেছে বেছে খেলাম। এতো এত্তো খাবার যে কোনভাবেই খাওয়া সম্ভব হয়না তা তাদের বুঝানো যায় না। বহু খাবারই নষ্ট হয়।

আমাদের ভারতীয় এবং কলম্বিয়া সহযাত্রীদের টেবিলে চোখ রাখলাম। তাদের টেবিলজুড়ে আনন্দের বন্যা। দারুণ হুল্লুড় করে তারা মজা লুটছে বলেও মনে হলো।

লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবী চট্টগ্রামে হাফ চাইনিজ নামে পরিচিত। আমাদের লায়নদের বহু প্রোগ্রামেই তারা টেবিলে ঘুমিয়ে যান। সন্ধ্যার পরপরই তারা ডিনার সারেন, নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে বিছানা। তাই এখানে এই চীনে এসে তাদের অবস্থা যেনো কিছুটা বেশি কাহিল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তাদের চোখে ঘুমও নামে। সুঝৌর কটেজে ডিনারের টেবিলে তাদের অবস্থা বেশ শোচনীয় মনে হলো। তাদের চোখজোড়ায় ঘুমের হাহাকার দেখে আমরা টেবিল ছাড়লাম।

রুমে ফিরে কাচের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল জঙ্গলে চোখ ফেললাম। বনের ভিতরে কিছু দেখা যায় কিনা দেখার চেষ্টা করলাম। না, ঘন অন্ধকার। কটেজের মালিক গা ছমছম ভাব আনার জন্যই মনে হয় চারদিকে অন্ধকার নামিয়ে রেখেছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জঙ্গল দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গলো ফজলে করিম ভাইয়ের ফোনে। তিনি সাতসকালে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে হাঁটাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ফোন করেছেন। মর্নিংওয়াক। কী এক অভ্যাস! এই বিদেশে বেড়াতে এসেও উনার যেনো শান্তি নেই। সকাল হলেই হাঁটার জন্য পা যেনো নিশপিশ করে!

বাইরে বেরিয়ে চোখ জোড়া ভরে গেলো। চারদিকে ঘন সবুজের মাঝে ওয়াকওয়ে। হোটেল কম্পাউন্ডের ভিতরেই। এমন আয়োজনকে চমৎকার বললে কম বলা হবে। কিছুটা কুয়াশা ভেজা পথ মাড়িয়ে আমরা বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পথ চলছিলাম। মনের সুখে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম আমরা। বেশ ক্ষুধা লেগে গেলো। হোটেলেই আমাদের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। আবারো চারতলার সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য ফ্রাঞ্চি করিম ভাইকে ফোন করলো। আমিও নাস্তা সারতে চাচ্ছিলাম। তাই তাগাদা দিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির সান্নিধ্যে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না