(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে আমরা যখন রেস্তোরাঁ থেকে বের হচ্ছিলাম তখনো সেখানে হুল্লুড় চলছিল। টেবিলে টেবিলে চলছিল জমজমাট খাওয়া দাওয়া, সাথে রকমারী পানীয়। একটি ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, পাশের টেবিল নিয়ে কারো তেমন কোন কৌতূহল নেই। প্রতিটি টেবিলে স্বতন্ত্রভাবে আনন্দ করছে, করছে খাওয়া দাওয়া। কারো ব্যাপারে কারো নাক গলানো নেই, এমন হুল্লুড়ের মাঝেও কেউ কাউকে বিরক্তি দেখাচ্ছে না। যার যার চরকার নিজেরাই তেল দিচ্ছে। আমরা আরো কিছুক্ষণ বসতে পারতাম, আড্ডা দিতে পারতাম। আমাদের আড্ডাও বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের কিছু কেনাকাটা থাকায় কিছুটা আমাদের তাড়া করলো।
রেস্তোরা থেকে বের হয়ে এপথ ওপথ মাড়িয়ে আমরা বেশ বড়সড় একটি মার্কেটে ঢুকলাম। দোকানগুলো বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছিল। আমরা বেশ দ্রুত গিয়ে একটি সুপারশপ টাইপের দোকানে ঢুকলাম। একসাথে এতোগুলো কাস্টমার ঢুকতে দেখে মেয়েগুলো বেশ নড়ে চড়ে বসলো। শেষমুহূর্তে লক্ষী ধরা দিলে যা হয়! হরেক রকমের পণ্যের দারুণ পসরা চারদিকে। লায়ন ফজলে করিম এবং ভাবী কি কি সব কিনলেন। বেটিও কিছু জিনিসপত্র কিনে নিল। সংসারী মেয়ে, দারুণ গোছানো তার ঘরের সবকিছু। কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে পায়ের জুতা পর্যন্ত সবই রয়েছে দোকানটিতে। এমনকি তালাচাবিও। আমি একটি হ্যাভারস্যাক কিনলাম, কিনলাম একজোড়া স্যান্ডেলও। পণ্যের মান এবং ডিজাইন দেখে সস্তাই মনে হলো। আরো কিছু কেনাকাটা করলে কেমন হয়! এতো সস্তাই এমন চাইনিজ মাল ব্যাগ ভর্তি করে দেশে নিয়ে গেলেও খুব বেশি ডলার খরচ হবে না। কিন্তু এতদূর থেকে এতো বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া যুৎসই হবে বলে মনে হলো না। বিদেশে কেনাকাটা এবং সেই বোঝা বহন করা সাংঘাতিক কষ্টকর একটি ব্যাপার। অসংখ্যবার বিদেশ গেলেও এই কষ্টকর কাজটি আমি পারতপক্ষে করিনা। তবে বাধ্য হলে মাঝে মধ্যে কেনাকাটা করি। হ্যাভারস্যাকটি কিনলাম ঘোরার সময়কার সুবিধার জন্য। টুকটাক কিছু জিনিসপত্র নিয়ে পিঠের উপর ঝুলিয়ে দিলে কাজ শেষ। পানির বোতল থেকে শুরু করে শুকনো খাবার এমনকি একটি পোলো গেঞ্জি বা একটি তোয়ালে অনায়াসে হ্যাভারস্যাকে চালান করে দিয়ে দিব্যি ঘুরা যাবে। স্যান্ডেলটি কিনলাম হাঁটার সুবিধার জন্য। সবসময় সু বা ক্যাডস পরে থাকতে ভালো লাগে না। ধারে কাছে স্যান্ডেল দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া যায়। এতে করে ভ্রমণ শেষে এগুলোর কাজও শেষ হয়ে যাবে। দেশ পর্যন্ত বয়ে নেয়ার দরকার হবে না, ঘোরাঘুরি শেষে ফেলে দিয়ে চলে গেলেও সমস্যা হবে না। আর দাম এতো কম যে, কয়েকদিন দিব্যি চললে কড়ি পুরোটাই উসুল হয়ে যাবে!
আমাদের কেনাকাটা শেষের সাথে সাথে দোকানটিতেও তালা পড়লো। আমাদের হোটেলে ফেরার তাড়াও শুরু হলো। বেটি এবং তার স্বামীর দুই গাড়িতে দিব্যি আমাদের জায়গা হয়ে যায়। তারাও আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য খুব জোর করছিল। কিন্তু লায়ন ফজলে করিম ভাই বললেন, এতো রাতে তাদেরকে আর উল্টো পথে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদেরকে হোটেলে নামিয়ে আবার তাদেরকে এই পথে ফিরতি এসে বাড়ির পথ ধরতে হবে। তার থেকে আমরা ডিডি (উবার টাইপ) কার নিয়ে চলে যাবো। শেষতক ব্যাপারটি এমন দাঁড়ালো যে, করিম ভাইয়ের বড় ছেলে ধ্রুব একটি ডিডি কার কল করলো। অল্পক্ষনের মধ্যেই চকচকে একটি চাইনিজ গাড়ি আমাদের সামনে দাঁড়ালো। আমরা বেশ আরামেই হোটেলের পথ ধরলাম।
সাংহাই শহর, দিনের চেয়ে রাতে যেনো বেশি সুন্দর। চারদিকে আলোর বন্যা, আলোকোজ্জ্বল রাস্তা, আলোয় আলোয় ভরে থাকা ভবন, গাছ–গাছালী। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, ঘরে ফিরছে মানুষ। বিশ্বের সুপার মেগাসিটি সাংহাই, অতএব রাস্তায় গাড়ি কিংবা মানুষের অভাব নেই। দিনের মতো রাতেও প্রচুর মানুষ ছুটে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কেউ ঘরে ফিরছে, কেউবা বারে। নাইট ক্লাব বা ডিসকো’র আলোকচ্ছটা ঠিকরে ঠিকরে বের হয়ে আসছে রাস্তায়,পথে পথে।
শেরাটনের মতো হোটেলে থাকার সুবিধা অনেক। কাস্টমারদের মন ভরাতে এদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। গাড়ি থেকে নামতেই এগিয়ে এলো বেলবয়। আমাদের যেহেতু কোন লাগেজ নেই তাই হাত ইশারায় তাদের ধন্যবাদ দিয়ে সামনে এগুলাম। লবিতে লাস্যময়ীর হাসি, পাশে বার থেকে ধেয়ে আসছে হল্লা। পাঁচতারা হোটেলগুলোতে বার এবং নাইট ক্লাব একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। এগুলোর উপরই হোটেলের তারকা নির্ভর করে। শেরাটনে বার এবং ক্লাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে যেনো একটু বেশিই উজ্জ্বল। প্রচুর কাস্টমারের আনাগোনা বার এবং ক্লাবে। এখানে শুধু হোটেলের বোর্ডারেরাই নয়, ইচ্ছে করলে যে কেউ এসে মদ গিলতে পারে, গান শুনতে পারে, পারে ড্যান্স করতে। পকেটে কড়ির কড়কড়ানি আছে এমন লোকদের আনাগোনা রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে। আমি আড়চোখে ভেজানোর দরোজার দিকে দুয়েক ঝলক তাকিয়ে সামনে এগুলাম।
একসাথেই লিফটে চড়ে নির্দিষ্ট ফ্লোরে পৌঁছলাম আমরা। লায়ন ফজলে করিম ভাই আমাকে সুযোগ পেলে টিপ্পনি কাটলেও ছেলের সামনে কিছু বললেন না। আমরা যে যার রুমের দরোজায় দাঁড়িয়ে গুডনাইট জানিয়ে ঢুকে পড়লাম। রুমে ঢুকেই মনটি ভালো হয়ে গেলো। আমার এলোমেলো করে যাওয়া রুমটি নান্দনিকভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি বিছানার উপর রেখে যাওয়া আমার ট্রাউজারটাও সুন্দর করে ভাঁজ করা। ফুলদানিতে নতুন টাটকা ফুল। পানির বোতল এবং কফির ঝোগানও দেয়া হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে আমি কফি বানানোর তোড়জোড় শুরু করলাম।
লায়ন ফজলে করিম ভাই ইন্টারকমে বললেন, তিনি ঘুমাতে যাচ্ছেন, সকালে হাঁটার জন্য ডাকবেন। ভিতরে ভিতরে শংকিত হয়ে উঠলাম আমি। আমি জানি যে, রাতে আমার ঘুম হবে না, সাতসকালে ডাকাডাকি শুরু হলে খবর আছে! মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলে করিম ভাই পাবেন না, কিন্তু ইন্টারকম অফ করবো কি করে। সেটের ক্যাবল খুলে রাখবো নাকি! নাকি রিসিভারই তুলে রাখবো! কিন্তু এতে খুব বেশি লাভ হবে না। দরোজার কলবেল তো আর আমি বন্ধ করতে পারবো না। করিম ভাই সাতসকালে বেল টিপা শুরু করলে অশান্তি আরো বেশি হবে। অতএব মনে মনে করিম ভাইর ঘুম যেনো অতি সকালে না ভাঙ্গে সেই প্রার্থনা করে ফেসবুকিং শুরু করলাম।
সব প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না, করিম ভাইর ঘুম নিয়ে গতরাতে যে প্রার্থনা করেছিলাম তাও বাতিল হয়ে গেছে। অতএব সাতসকালে করিম ভাই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার তাগাদা দিলেন। ইন্টারকমের ক্যাবল না খোলায় করিম ভাইকে আর দরোজার কলবেল টিপতে হয়নি। ইন্টারকমের কর্কশ শব্দ আমার ঘুম এবং মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী দরোজায় দাঁড়িয়ে। ধ্রুব আলাদা কোন রুমে আরামে ঘুমাচ্ছে। আহারে, আমি যদি রাতে বুদ্ধি করে ধ্রুব’র রুমে চলে যেতাম! তিনজন একসাথে নেমে আসলাম। কোথায় হাঁটতে যাবো জানি না। কোন রাস্তা কোথায় গেছে তাও অজানা। এমন অচিন শহরে মর্নিংওয়াকের দরকারটাই বা কী তা বুঝতে পারছিলাম না।
আমরা সামনে হাঁটতে লাগলাম। তেমন কোন লোকজন রাস্তায় নেই। তবে হোটেলের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া চওড়া রাস্তা ধরে প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছিল একেকটি গাড়ি। স্পিডলিমিট কত কে জানে, তবে কেউ তা মানছে বলে মনে হলো না। বিপুল বেগে ছুটে চলা গাড়ি দেখে আমরা আর ওদিকে গেলাম না। হোটেলের সামনে থেকে পায়ে হাঁটার একটি রাস্তা ধরলাম। শানবাঁধানো টাইপের রাস্তা। ভিন্ন রকমের ইট দিয়ে অনেকটা ডিজাইন করা, ওয়াকওয়ে। সামান্য এগুতেই কিছুটা জঙ্গলের মতো একটি জায়গায় পৌঁছে গেলাম। গাছগাছালীতে ভরা, প্রচুর পাখি ডাকাডাকি করছে। আহা, কতদিন এমন পাখীর কলকাকলী শুনিনি, দেখিনি এতো পাখীও। নদীর পাড়ের কেওড়া গাছের মতো গাছগাছালী, উচ্চতাও তেমন। গাছগুলো আকাশ ছুঁয়নি, প্রতিবেশির হাত ধরেছে। কী এক উষ্ণতায় যেনো একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে আছে। আমরা গাছগাছালীর ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরে এগুচ্ছিলাম। আমাদের মাথার উপর নেমে এসেছে নাম না জানা নানা গাছের ডালপালা। উপরের আকাশ দেখা যাচ্ছিল না, শুধু গাছের ঢালপালা। গাছের পাতায় পাতায় ভোরের আলো খেলা করছিল। পায়ে হাঁটার পথটির দুইপাশ থেকে গাছগুলোর শাখা–প্রশাখা এমনভাবে ঝুঁকে এসেছে যে, আমরা যেনো কোন বনে ঢুকে পড়েছি। বুনো গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক, অন্যরকমের এক আবহ আমাদের চারপাশে। নরোম মিষ্টি আলোতে ভরা এই সাতসকালে আমরা যেনো উড়ে এসে অপূর্ব এক পরিবেশে নিজেদের ছড়িয়ে দিচ্ছি। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।