(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাইরে থেকে বেটি নিজে ডিজিট ঘুরিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকলেও দরোজা খুলতেই সামনে পড়লো দুজন আস্ত মানুষ। পুতুলের মতো সুন্দর একটি শিশুকে নিয়ে খেলছে এক তরুণ। কিছুটা চমকিত হলাম। ড্রয়িং রুমে দুজন মানুষ খেলা করছে, অথচ বেটি কল বেল না বাজিয়ে নিজেই লক খুলে ভিতরে ঢুকলো! বুঝতে পারলাম, এটা হয়তো চীনা কারবার। অন্যকে কষ্ট না দেয়ার একটি মানসিকতা হয়তো তাদের ভিতরে সবসময়ই কাজ করে।
বাচ্চাটি বেটির, আর তরুণ বেটির স্বামী। লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের পরিবারের সাথে তরুনের আগে থেকেই পরিচয় ছিল, আমার সাথে বেটি পরিচয় করিয়ে দিলো। খুবই হাসি খুশী একজন মানুষ। আমি ড্রয়িং রুমের চারদিকে চোখ বুলালাম। দারুণ গোছানো, ছিমছাম। চীনা একটা পার্বন উপলক্ষ্যে দেয়ালে আলপনা করা হয়েছে, ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে মরিচ বাতি টাইপের কিছু বাতিও। তবে এগুলোর ডিজাইন আমাদের মতো নয়, একটু যেনো অন্যরকম। এগুলোকে আদর করে নাকি উইশ বল ও র্যাটন বল নামেও ডাকা হয়। ড্রয়িং রুমের পাশেই ডাইনিং স্পেস, পাশে একটি কাচের বড়সড় বাক্সের মতো দেখা গেলো। সেটি নাকি রান্না ঘর। দুর্দান্ত একটি ওয়াল কেবিনেট, নিচে অত্যাধুনিক চুলা। বুঝতে পারছিলাম যে, রান্নাবান্নার আয়োজন এই ঘরে খুব কমই হয়। রান্নাঘর এতো সুন্দর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে পারে তার ধারণা আমার ছিল না। এটা কোন অবসর কাটানোর স্টুডিও স্যুট নয়। বেশ বড়সড় এবং প্রায় ১৮শ’ বর্গফুটের তিন বেডের ফ্ল্যাট। এখানে নিয়মিত বসবাস করে একটি পরিবার, অথচ রান্নাঘরের কোথাও একটি দাগও নেই। রান্নাঘরের সবকিছুই ড্রয়িংরুম থেকে দেখা যাচ্ছিল।
বেটি আমাদেরকে ঘর দেখাতে নিয়ে গেল। ড্রয়িং রুমের পাশেই ছোট্ট একটি করিডোর দিয়ে সামান্য এগুতেই মনে হলো সে দেয়াল ঠেলে দিল। অমনি চোখের সামনে কলকল করে উঠলো বেটির বেডরুম। বেড রুমের সাথেই কাঁচ ঘেরা ড্রেসিং রুম, সাথে ওয়াশ রুম। কী যে সুন্দর, পরিপাটি। বেডরুমে একটি খাট ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। বেটি একটি রিমোর্টে চাপ দেয়ার সাথে সাথে পুরো একপাশের দেয়াল জুড়ে সিনেমা চলতে শুরু করলো। পুরো দেয়াল জুড়েই টেলিভিশন, কিন্তু পুরোটাই একটি প্রজেক্টর। দেয়ালের রঙের ফাঁকে ফাঁকে কাপড়ছোপড় রাখার আলমারি, ওয়্যারড্রপ। চীনা বুদ্ধির ষোলকলা পূর্ণ করা হয়েছে বেটির ফ্ল্যাটে। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই ঘোর লাগছিল চোখে। স্বাভাবিকভাবেই লায়ন ফজলে করিম ভাইকে ফ্ল্যাটটির দাম জিজ্ঞেস করলাম। করিম ভাই বেটির কাছে জানতে চাইলেন। বেটি সলজ্জ ভঙ্গিতে যেই চাইনিজ মুদ্রার দাম বললেন, করিম ভাই তা কনভার্ট করে বললেন, বাংলাদেশের চব্বিশ কোটি টাকা। ১৮শ’ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ২৪ কোটি!! করিম ভাই হাসলেন, বললেন–এটি সাংহাই। ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা বিক্রি হয় এখানে!
ঘরদোর দেখে আমরা ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম। বেটি আমাদের জন্য টেবিলে নানা ধরণের ফলমুল দিলো। কলা, কমলা, আপেল, লিচু। আমি চীনা লিচুর প্রেমে পড়েছি আগেই, অতএব এখানেও অন্যদিকে হাত না বাড়িয়ে লিচু খেতে লাগলাম। বেটি অনেকগুলো লিচু দিয়েছে টেবিলে, আমরা একটা একটা করে প্রায় সবগুলোই খেয়ে নিলাম। লিচু যে এমন রসালো এবং সরস হয় তা চীনে না আসলে অজানা থেকে যেতো। পার্বন উপলক্ষে তৈরি বিশেষ একটি খাবারও বেটি টেবিলে রাখলো। এটির নাম জংজি। জীবনে এমন খাবার আর কখনো দেখিনি।
কী ধরণের পার্বন উপলক্ষে বেটি ঘর সাজিয়েছে জানতে চাইলে যে তথ্য জানলাম, তাতে আমার ভিতরটি নেচে উঠলো। এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল প্রাচীনতম উৎসব হিসেবে খ্যাত চীনের ঐতিহ্যবাহী ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালকে ঘিরেই নাকে এই সাজসজ্জা। প্রতিটি ঘরেই নাকি সাজ সাজ রব। নৌকা ভাসানো, সর্বশক্তি নিয়ে দলবেঁধে সেই নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামা এই উৎসবের বেশ উপভোগ্য অংশ। বিশেষ খাবার জংজি। অতিথিদের বিশেষ এই খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। এইদিনে প্রচুর উপহার বিনিময় হয়। বেটি এবং তার পরিবারের জন্য লায়ন ফজলে করিম ভাই ও ডালিয়া ভাবী চট্টগ্রাম থেকেই উপহার বয়ে এনেছেন। গাড়ি থেকে প্যাকেটটি বয়ে এনেছে করিম ভাইর পুত্র ধ্রুব। এখন সেটি বেটির হাতে দেয়া হলো। ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষ্যে আনা না হলেও একইদিন হয়ে যাওয়ায় বেটির চোখে মুখে আনন্দ খেলে গেলো।
বেটির সাথে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল নিয়ে কথা বললাম। দেখতে চাইলাম। বেটি যা জানালো তা হচ্ছে, চীনের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সূচিত হলেও এশিয়াজুড়ে এই উৎসবের জয়জয়কার। এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল উৎসব হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে নৌকা বাইচ কেন্দ্রিক বিশেষ এই অনুষ্ঠানের। রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্বও। চীনসহ সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলোর আস্তিক, নাস্তিক কিংবা ধর্মহীন মানুষের মাঝেও এই উৎসব দারুণ এক আবহ তৈরি করে। শুধু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীই নন, অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষও এই উৎসবকে ঘিরে আনন্দ করে। প্রতিবছর চীনাদের হিসেবে পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখে এই উৎসব হয়। দিনটি সরকারি ছুটির দিন পুরো চীনে। গত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা এবং উৎসবমুখর পরিবেশে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হবে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নারী পুরুষ নৌকা বাইচ উপভোগ করে।
বেটি বেশ ভালো শ্রোতা পেয়ে মন ভরে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের গল্প জুড়ে দিলো। ঐতিহাসিক এক বিয়োগান্ত ঘটনা থেকে এই উৎসবের প্রচলন হয় বলে জানা গেছে। উৎসবের সূচনা নিয়ে চীনের মানুষের মাঝে মতানৈক্য থাকলেও উৎসবের ষোলকলা পূর্ণ করতে তাদের আয়োজনের কমতি থাকে না।
তিনটি ঘটনার যে কোন একটি থেকেই যে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয়েছিল সেই সম্পর্কে সবাই একমত। ঘটনা তিনটিও চীনাদের মুখে মুখে। দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই তিনটি ঘটনা চীনাদের আলোচনায় রয়েছে।
এরমধ্যে একটি ঘটনাকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরশীল বলে মনে করেন অধিকাংশ চীনা নাগরিক। তারা বলেন, চৈনিক সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের। তারা বিশ্বাস করেন যে, হোয়াংহো নদীর তীরে চৈনিক যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস ধারণ করে।
তাদের মতে, ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয় প্রায় ২ হাজার ২০০ বছর আগে। এক ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ফেস্টিভ্যালের শুরু। ওই সময় আধুনিক যে বিশাল চীন তা খন্ড খন্ড অসংখ্য রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সবগুলোই ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র। পৃথক পৃথক শাসক রাজ্যগুলো শাসন করতেন। ওই সময় মিলুও নদীর দু’পাশের উর্বর বসতি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল চু নামের একটি রাজ্য। ওই চু রাজ্যে জনপ্রিয় একজন কবি ছিলেন কু ইউয়ান। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন। রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষের উন্নতি এবং সুখ শান্তি নিশ্চিত করতে কাজ করতেন তিনি। এতে করে দিনে দিনে তিনি রাজা এবং প্রজাদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেন। কিন্তু প্রসারে শত্রুর জন্ম হয়। কু ইউয়ানেরও হয়েছিলেন। রাজসভারই কতিপয় সদস্য রাজাকে তাঁর সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনী বুঝিয়ে কান ঝালাপালা করে দেন। এক পর্যায়ে রাজাও বিশ্বাস করেন। কু ইউয়ানকে রাজসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়। বিতাড়িত কু ইউয়ান নানাভাবে অপদস্ত হয়ে একাকি থাকেন। ওই সময় কু ইউয়ানের রাজ্যে প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলো থেকে একের পর এক হামলা চালানো হয়। চালানো হয় ধ্বংসযজ্ঞ। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ নানা নির্যাতনে সুখী রাজ্যটির বাসিন্দাদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠে। সাজানো গোছানো একটি রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষদের কষ্ট অবর্ণনীয় হয়ে উঠে। এমনতর দুর্দিনে মানুষের জন্য কিছু করতে না পারায় বেদনায় পঞ্চম চন্দ্র মাসের পাঁচ তারিখে কু ইউয়ান একটি কবিতা লিখেন। কবিতাটা লিখে শেষ করার পর তিনি মিলুও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একজন ভালো মানুষ এবং কবির আত্মহত্যার ঘটনায় পুরো রাজ্যে হাহাকার ওঠে। তারা দল বেঁধে নৌকা নিয়ে মিলু নদীতে কু ইউয়ানের মরদেহের সন্ধান করতে থাকে। কিন্তু মরদেহ পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই সময় এক ব্যক্তি ভাতের গোলাকার পিন্ড বানিয়ে নদীতে ছুঁড়তে থাকেন এবং বলতে থাকেন যে, যতক্ষণ এই নদীর মাছগুলো এই খাবার পাবে ততক্ষণ তারা কু ইউয়ানের শরীর স্পর্শ করবে না।
চীনাদের বিশ্বাস, ওই ঘটনার পর থেকেই ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা। কালের বিবর্তনে যা এক বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
অপর একটি বিয়োগান্ত ঘটনা থেকে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা বলেও চীনারা বিশ্বাস করে। সেটিও প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। একজন সম্মানিত শিক্ষক এবং তার বড়পুত্রকে শত্রুদের মিথ্যাচারে রুষ্ট হয়ে রাজা ফাঁসিতে ঝুলান। ওই শিক্ষকের ছোটপুত্র পরবর্তীতে পাশের রাজ্যে আশ্রয় নেন। বেশ কয়েক বছর পর শিক্ষকপুত্র পাশের রাজার অত্যন্ত প্রিযভাজন হয়ে উঠেন এবং ওই রাজাকে নিয়ে পিতা এবং ভাই হন্তক রাজার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে রাজা, রাজপুত্র, রাণীদের হত্যা করে রাজ্য দখল করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবারো শত্রুদের মিথ্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা তাকে ফাঁসিতে ঝুলান। এই মৃত্যুর ঘটনার পরও রাজ্যজুড়ে হাহাকার উঠে। যা স্মরণীয় করে রাখতে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয় বলে জিয়াংশু ও ঝেইজিয়াং অঞ্চলের বাসিন্দাসহ অনেক চীনা বিশ্বাস করেন।
তৃতীয় ঘটনাটি পিতার প্রতি কন্যার এক দুর্দান্ত ভালোবাসার। প্রাচীন হান রাজবংশ শাসিত রাজ্যে পানিতে ডুবে মারা যান এক ব্যক্তি। কিন্তু টানা কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করেও ওই ব্যক্তির মরদেহের সন্ধান মিলে না। তার একটি মেয়ে ছিল। ঘটনার ১৭ দিন পর পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখে মেয়েটি পিতার মরদেহের খোঁজে নিজেই নদীতে নেমে পড়ে এবং লাশ নিয়ে উঠে আসে। পিতার প্রতি মেয়ের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় লোকজন নদীর পাড়ে একটি মন্দির বানায়। এরপর থেকে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা বলেও প্রচলিত রয়েছে।
ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল মুলতঃ নৌকা বাইচ। এই দিনে চীনের নানা অঞ্চলে বর্ণাঢ্য সাজে সুসজ্জিত নৌকা নিয়ে বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। ড্রাগন চীনের জাতীয় প্রতীক। নৌকাগুলোর সাজসজ্জায় ব্যাপকভাবে ড্রাগনের ছবির ব্যবহার করা হয়। কোন কোন নৌকার দুই প্রান্তে ড্রাগনের আকৃতি দেয়া হয়। তাই ফেস্টিভ্যালের সাথে ড্রাগন শব্দটি জুড়ে গেছে। এই দিনের জনপ্রিয় এবং ব্যাপক ব্যবহৃত খাবার হচ্ছে ‘জংজি’। কলা পাতার ভিতরে বিন্নীভাতের মতো আঠালো ভাতের ভিতরে নানা প্রাণীর মাংস দিয়ে গোলাকৃতির জংজি বানানো হয়। বাইরে ভাতের পিন্ডের ভিতরে মাংস। অনেকটা সিঙ্গারার মতো। সুতলি দিয়ে কলাপাতা বেঁধে ভাপের উপর রান্না করা হয়। এই খাবার দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। যেমনটি আমাদের টেবিলেও জংজি সাজিয়ে দিয়েছে বেটি। (চলবে) লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।