দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সাংহাই শেরাটনের আলীশান রুমের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া ফুলগুলো ভালো করে দেখলাম। একেবারে টাটকা। মনে হয় একটু আগেই তুলে আনা হয়েছে। নানা রঙের ফুল, দারুণ বর্ণিল। ছোট্ট ফুলদানিতে যেনো রঙধনুর আভা! ফুলের সাথে কয়েকটি পাতাও দেয়া হয়েছে। কোন রূপসী রুমটি সাজিয়েছে জানি না, তবে তার রুচিবোধের প্রশংসা করতে হলো। এতো সুন্দর করেও একটি রুম সাজিয়ে রাখা যায়! ফ্রুটস বাকেটের দিকে তাকালাম লোভাতুর দৃষ্টিতে। কি আছে কে জানে! অনেক সুন্দর করে র‌্যাপিং করা। র‌্যাপিং পেপার খুলে সত্যি সত্যি চমকিত হলাম। দুইটি করে কলা, আপেল এবং কমলা। কয়েকটি লিচু এবং স্ট্রবেরি। তারা মনে হয় দুজনের জন্য ফল দিয়েছে। হয়তো মনে করেছে কোন পশ্চিমা তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে রুমে থাকবে। অভাগা বাঙালি যে রুমটির দখল নেবে তা হয়তো সাজনেওয়ালির অজানা ছিল। ফলগুলো একেবারে টাটকা। লিচুর সাইজ দেখে ভিমরি খেলাম। এতো বড় লিচু জীবনে কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। রস যেন টসটস করছে। একটি লিচু হাতে তুলে নিলাম। খোসা ছড়িয়ে মুখে দেয়ার পর মনে হলো, না, এমন মিষ্টি, এমন রসালো লিচু আমি কখনো খাইনি। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম লিচুর শরীর জুড়ে থলথলে মাংস, বিচি একেবারে ছোট্ট। হাতে নিয়ে খেয়াল করে দেখলাম যে, বিচিটি মোটর দানার চেয়েও ছোট। চীনারা শুধু কলকারখানা বা ভবন বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ফলফলাদিতেও প্রচুর কাজ করেছে। আমি একটি একটি করে বেশ কয়েকটি লিচু খেয়ে ফেললাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বাইরে গেলে অবশ্যই লিচু কিনে ফিরবো।

আমার ক্ষুধা নেই। তাছাড়া আটদশটি লিচু খাওয়ার পর আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু হলদে বর্ণের দারুণ সাইজের কলা দুইটি কেমন যেনো হাতছানী দিচ্ছিলো। একটি কলার খোসা ছড়ালাম। আহ, কী দারুণ স্বাদ, গন্ধ! আমি নিশ্চিত হলাম যে, তারা শুধু লিচুতে নয়, কলা নিয়েও কাজ করেছে। চীনারা জাতিকে কলা দেখায়নি, কলাকে সুখাদ্য বানিয়ে জাতির হাতে তুলে দিয়েছে।

ঘরময় আলো খলখল করছিল। একপাশের দেয়ালের পুরোটাই জানালা। জানালায় ভারি পর্দা, তবে তা গুটিয়ে রাখা। পর্দাগুলো বন্ধ করে রুমটিকে অন্ধকার করতে চাইলাম। কিন্তু পর্দার ধারেকাছে কোন দড়ি টড়ি পেলাম না। পর্দা বন্ধ করবো কি করে! কিছুই যখন বুঝতে পারছিলাম না তখন হঠাৎই নজর পড়লো বেডসাইড টেবিলে লাগানো সুইচবোর্ডের দিকে। স্কিনটাচ সুইচ বোর্ড। তাতে ঘরের লাইট কিংবা এসি নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি পর্দা খোলাবাধার সুইচও দেখলাম। আলতো করে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়ার সাথে সাথে পর্দাগুলো নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আমি ভারী পর্দাগুলো টেনে দিলাম। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেলো রুম। এসি লো করে হিমহিম একটি আবহ আনার ব্যবস্থা করলাম। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিলে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে উঠবে। কফি খাওয়ার জন্য প্রাণটা কেমন আনচান করলেও কফি বানানোর মতো মনের জোর ছিল না, ইচ্ছেও করলো না। আহারে, কেউ একজন যদি এক মগ কফি বানিয়ে দিতো! ভীষণ মনে পড়ছিল ভারতের নানা অঞ্চলে ঘোরার দিনগুলোর কথা। প্রিয়তমা স্ত্রী সাথে থাকায় যখনতখন কফির মগ হাতে আসতো। এখন সেই সুযোগ নেই। মনটি কেমন কেমন যেনো করতে লাগলো।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বুঝতে পারলাম না। ইন্টারকমের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। এখানেও ফোন! বুঝতে পারছিলাম যে, লায়ন ফজলে করিম ভাই ফোন করেছেন। ‘হ্যালো’ বলতেই করিম ভাই বেশ তাড়া দিয়ে বললেন, রেডি হন, খেতে যাবো। দুপুর নাকি রাতের খাবার তা ঠাহর করতে একটু সময় লাগলো। ক্ষুধা নেই, ঘুমও চোখ জুড়িয়ে রাখছিল। না খেলেই ভালো হতো। কিন্তু ‘খাবো না’ বলার আগেই করিম ভাই ফোন রেখে দিলেন।

লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের বড়পুত্র ধ্রুব ‘ডিডি কার’ কল দিয়েছে। গাড়ি আসতে যতক্ষণ সময় লাগছে ততক্ষনে আমরা হোটেলের সামনের চত্বরে ঘোরাঘুরি করলাম। দারুণ করে সাজিয়ে রাখা ছোট্ট চত্বর। একটি গোলাকার মঞ্চের মতো করে তার উপরে স্থাপন করা হয়েছে ধবধবে সাদা পাথরের দুইটি হাতি। যেনো লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে হাতি দুইটিকে। পাশেই চমৎকার একটি খাল। খালপাড়ে বসার মতো সিঁড়ি, গাছগাছালী। দারুণ ডিজাইনের একটি সেতুও রয়েছে খালটির উপর। আমি হেঁটে খালপাড়ে গেলাম। বাহ, কী সুন্দর! স্বচ্ছ পানিতে টুইটম্বুর। খালের কোথাও একটি পলিথিন নেই, একটি বোতল নেই। একরত্তি ময়লা নেই। জ্বী, ঠিকই পড়েছেন, কোথাও একটুও ময়লা নেই।

আমাদের গাড়ি চলে এসেছে। চকচকে একটি প্রাইভেট কার। চীনা ড্রাইভার। ধ্রুব তার সাথে কি কি কথা বললো বুঝতে পারলাম না। আমাদের গাড়ি ওই সেতুটির উপর দিয়ে বের হয়ে বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে এগুতে লাগলো। আবারো সেই রাস্তা, সেই ফুলে ফলে ছেয়ে থাকা রাজপথ। ৮ লেনের চওড়া সড়কটি ধরে ছুটছে শত শত গাড়ি। কিন্তু একটিও হর্ণ নেই। লেন ধরে ছুটছে গাড়িগুলো। ওভারটেক করলেও লেন মেনেই করছে। কী দারুণ এক শৃংখলা রাজপথে!

সাংহাই শহরের রাজপথ ধরে ছুটছি আমরা। তকতকে ঝকঝকে একটি শহর। বিশ্বের বৃহত্তম শহর সাংহাই। যেখানে বাস করে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ। এতো এতো মানুষের এই মেগাসিটিকে কোন যাদুবলে এমন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হয়েছে তা বুঝতে পারছিলাম না। শুধু রাস্তাতেই নয়, রাস্তার কোনাকানাতেও কোন ময়লা নেই। কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য!! আমার চোখ জুড়িয়ে গেলেও বুকে কেমন যেনো হিংসে হচ্ছিল।

চারদিকে সুউচ্চ সব ভবন। আড়াই কোটি মানুষ যেই শহরে থাকে সেখানে বহুতল ভবন না থাকলে চলবে কি করে! পঞ্চাশ ষাট তলার ভবনকে ছোট লাগছিল শততলার ভবনগুলোর পাশে। কিন্তু শুধু সুউচ্চ ভবনই নয়, রাস্তা এবং রাস্তার পাশের নানা নান্দনিকতাও চোখ কপালে তুলছিল। এতো এতো গাছ, এতো এতো বাগান কি করে যে করে রাখা হয়েছে তা নিয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে উঠছিল। আহা, কী সুন্দর শহর, কী গোছানো একটি নগর!

অফিসপাড়ার মতো নিরিবিলি একটি জায়গায় এসে থামলাম। চারদিকে লাখো গাছগাছালীর ভিতরে অগুনতি ভবন। প্রথম দেখায় মনে হলো কোন অভিজাত আবাসিক এলাকাতে এসে পড়েছি। কিন্তু একটি খেয়াল করে দেখলাম যে, ভবনগুলোর নিচতলাতে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট, বার, ক্লাব। কিন্তু কোথাও কোন হৈ চৈ নেই। মানুষজন আছে বলেও মনে হচ্ছিল না। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে দুয়েকজনকে দেখা গেলেও ব্যস্ততা যেনো তাদের তাড়া করে হাওয়া করে দিচ্ছিলো।

গাড়ি বিদায় করে ধ্রুব আমাদের নিয়ে একটি ভবনের নিচতলায় ঢুকলো। রেস্টুরেন্ট। ডালিয়া ভাবী বললেন, এটা মুসলিম রেস্টুরেন্ট। এদের খাবার দারুণ। আমরা আরো একবার এখানে এসেছিলাম।

সাংহাই শহরে মুসলিম রেস্টুরেন্ট! কিছুটা আশ্চর্য হলেও কাউকে বুঝতে দিলাম না। ঢুকে দেখি, একপাশের টেবিলে দুই জোড়া তরুন তরুণী খাবার খাচ্ছে। ক্যাশে এক যুবক, অপর একটি হিজাব পরিহিত তরুণী বাইরের দিকে বসে ছোট্ট একটি বাচ্চার সাথে খেলা করছে। রেস্টুরেন্ট হলেও কোন ব্যস্ততা নেই। কেমন যেনো আলস্য ঘরজুড়ে।

ধ্রুব এবং ডালিয়া ভাবী ক্যাশে গিয়ে যুবকের সাথে কী কী সব খাবারের অর্ডার দিলেন। আমি এবং করিম ভাই ওদিকে না গিয়ে নিজেদের মতো গল্প করছিলাম। অর্ডার দেয়ার সাথে সাথে যুবকটি কিছু একটা বললো, আর তরুণী দ্রুত উঠে ভিতরের দিকে চলে গেলো। অল্পক্ষণের মধ্যে লেবু দেয়া গ্রীন টি’র একটি মগ এবং চারটি গ্লাস আমাদের টেবিলে রেখে গেলো।

একটির পর একটি খাবার আসতে লাগলো। সবগুলো খাবারই আনছিল হিজাব পরিহিতা তরুণী। কী শালিন তার চালচলন, কী ভদ্র তার আচরণ। এমন আলতো করে ডিশগুলো টেবিলে রাখছিল যে কোন শব্দই হচ্ছিলো না। ধ্রুব জানালো যে, এরা স্বামীস্ত্রী। দুজনে মিলে রেস্টুরেন্টটি চালায়। রেস্টুরেন্টটি এখানকার বেশ জনপ্রিয়। আশেপাশে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট থাকলেও এই দোকানে ভিড় লেগে থাকে। তবে আমরা দেরি করে আসায় লাঞ্চের আসল ভিড়টা দেখতে পেলাম না। এখানের মানুষ বেশ আর্লি লাঞ্চ এবং ডিনার সারে।

স্যুপ থেকে শুরু করে নানা পদের খাবার দেয়া হলো আমাদের। সবই ডালিয়া ভাবী এবং ধ্রুব’র অর্ডার। তাদের পছন্দ। আমি যেহেতু কোন খাবার সম্পর্কে কিছু জানি না, কোনটি কি দিয়ে তৈরি তাও বুঝি না। তাই কিছু না বলে একটু একটু চেকে দেখছিলাম। যেটা ভালো লাগছিল সেটা খাচ্ছিলাম, যেটা মুখে লাগছিল না সেটা ঠেলে দিচ্ছিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাগুরু
পরবর্তী নিবন্ধআখেরী চাহার শোম্বাহ’র গুরুত্ব তাৎপর্য ও আমল