(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকংয়ের ডাইনিং টেবিলে শুটকিসহ নানা পদের দেশি খাবার অসাধারণ লাগলো। কত কিছু যে ভাবী রান্না করিয়েছেন! সবই নিখাদ দেশি, চট্টগ্রামের। এই এক রোগ, দেশে থাকলে আমরা চাইনিজ এবং হংকংয়ের নানা খাবার খেতে পছন্দ করি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওই সব খাবারের অর্ডার করি। রুচি পাল্টাতে মাসে এক দুইবার দলবেঁধে রেস্টুরেন্টে যাই। অথচ বিদেশে গেলে আর ওসব খাবার মুখে রুচে না। তখন দেশি খাবারের জন্য পরানে হাহাকার ওঠে। বিদেশের মাটিতে দেশি খাবারের কদর যে কী প্রকট হয়ে উঠে তা বলে বা লিখে বুঝানো অসম্ভব। তাই আমার বন্ধুপত্নী যখন চিংড়ী শুটকি দিয়ে পুঁইশাক টেবিলে রাখলেন তখনি আমার মনে হলো পুরো বাটি উপোড় করে দিই। বেগুন এবং আলুর সাথে ছুরি শুটকি যে কী অমৃত তা সবাই বুঝবেন না।
শুধু কী শুটকি! মাছ মাংসের নানা পদও ঠাঁই পেয়েছে টেবিলে। সাদা ভাতের সাথে এক একটি তরকারি শরীরের জন্য ক্ষতিকর জেনেও প্রচুর খেয়ে ফেললাম। জম্পেশ খাওয়া–দাওয়ার পর কফির কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা পিটালাম। যথারীতি হংকংয়ের নানাকিছুর সাথে দেশীয় অনেক বিষয়ও উঠে আসলো আমাদের আলোচনায়। কথা বাড়ছিল, বাড়ছিল আশা, স্বপ্ন ভঙ্গের নানা গল্পও হচ্ছিলো। বাড়ছিল রাত। একসময় বিদায় নিলো আমার বন্ধু স্বপন। বিদায় নেয়ার সময় দরোজায় দাঁড়িয়ে সে কোলাকুলি করে আমার থেকে যেনো একটু বাড়তি বিদায় নিল। কারণ তার সাথে আমার আর দেখা হবে না। হংকংয়ে আমার থাকার সময় দ্রুত ফুরোচ্ছে। এখান থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যাবো আমি। আমার বন্ধুর ড্রাইভারই আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবে। স্বপন দেশে গেলে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিলো। রাত অনেক হয়ে গেছে। তাই তাকে আমার বন্ধুর গাড়ি বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। স্বপনের ফেরাটা নিশ্চিত হওয়ায় নিশ্চিন্ত হলাম আমি।
সময় দ্রুত ফুরোচ্ছিল। আমার বন্ধু বললেন, এমন সময় আসলেন যে আপনার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। পরে আবার সময় নিয়ে আসবেন। আমি সুস্থ হলে হংকংয়ে অনেক কিছু আপনাকে দেখাবো। কত কিছু যে দেখার আছে এখানে! আমি হাসলাম। আবার কী আসা হবে! আদৌ আর কোনদিন হংকং আসা হবে কিনা তাও জানি না। দুনিয়ার অন্যতম সেরা পাসপোর্টের দেশ হংকং অনুন্নত দেশের মানুষকে ভিসা দিতে প্রচুর কড়াকড়ি করে। নানাভাবে যাচাই বাছাই করে, মেইলের পর মেইল দেয়। সবগুলোর সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারলে সাধারণ মানুষকে হংকংয়ের ভিসা দেয়া হয়না। ব্যবসায়ী বা কর্পোরেট ব্যক্তিত্বদের জন্য এতো কড়াকড়ি না থাকলেও সাংবাদিকদের জন্য কড়াকড়ির মাত্রাটা আরো একটি বেশি। অবশ্য পৃথিবীর বহু দেশই সাংবাদিকদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করে।
আরো অনেকক্ষন নানা গল্প এবং কয়েক কাপ চা কফি শেষ করে তিনতলায় রুমে চলে আসলাম। রুমের সামনের উঠোনের মতো খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় এবং অগুনতি সুউচ্চ ভবন দেখছিলাম। আকাশের তারাগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে হংকংয়ের ভবনগুলোর আলো। এক একটি দ্বীপের মধ্যে কী করে যে এতো উঁচু উঁচু ভবন তারা নির্মাণ করলো কে জানে! আমাদের দেশে ত্রিশ তলা ভবন করতে তিনশ’ বার ভাবতে হয়, অথচ এখানে শত শত ভবনই আশি নব্বই তলার উপরে। একশ’ তলার উপরে রয়েছে অনেকগুলো। পুরো হংকং দ্বীপটাকে উঁচু ভবনের স্বর্গরাজ্য বললে কম বলা হবে।
পাহাড়ের সবুজ ছুঁয়ে আসা সাগরের নোনতা হাওয়া আমার গা–গতরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। এতো শান্তি লাগছিল যে, রুমে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেলাম যে, আমার শীত লাগছে। গায়ে একটি ছাদর জড়িয়ে হংকংয়ের রাত দেখতে ভালো লাগতো। তবে এতো রাতে আবার চাদর খোঁজাখুঁজি করতে ইচ্ছে করলো না। রুমে গিয়ে সোফায় বসে কয়েকটি ফোন করলাম। হংকংয়ের চেয়ে দুইঘন্টা এগিয়ে আমরা। এতে করে গভীর রাতে আমি যখন বাসায় ফোন করছিলাম তখন চট্টগ্রামে নিশুতি রাত। ঘুম ঘুম কন্ঠে ফোন রিসিভ করলেও কথা বেশিদূর এগুলো না। শুধু খবরাখবর নিয়েই ফোন রেখে দিলাম।
দরোজা বন্ধ করার কোন ব্যাপার নেই। ট্রিপলেক্স বাড়িটির এখানে চোর ওঠারও কোন আশংকা নেই। আবার হংকংয়ে চোর আছে বলেও মনে হয় না। ঘরের জিনিসপত্র চুরি করার মতো চোর বিশ্বের বহুদেশেই নেই। আহা, আমার দেশে দরোজা খোলা রেখে ঘুমানোর দিন হারিয়ে গেছে! দেশ নিয়ে আরো কি কি সব যেনো ভাবছিলাম।
আজ আমি দেশের পথ ধরবো। হংকং থেকে থাইল্যান্ড হয়ে ঢাকায়। তবে ফ্লাইট রাতে, সকালে কোন হুড়োহুড়ি না থাকায় মন স্বস্তিতে ভরে গেলো।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন ঘড়ির কাঁটা বেশ এগিয়ে গেছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। আমি এ ক’দিনে বুঝে গেছি যে, আমার বন্ধু বেশ আগেভাগে ঘুম থেকে জেগে যান। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বেচারার নাকি ঘুমই হয় না। সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠে বেলা দশটা এগারোটা পর্যন্ত নাস্তা না করে বসে থাকা কষ্টকর। আমার বন্ধু আমাকে ছাড়া নাস্তার টেবিলে যান না, এতে করে প্রতিদিনই একটা অপরাধবোধ তাড়া করে আমাকে। নিচে নেমে যথারীতি আমার বন্ধুর সাথে দেখা হলো। সোফায় গা এলিয়ে গায়ে একটা চাদর দিয়ে টিভি দেখছেন তিনি। আমাকে দেখে হাসলেন। বললেন, টেবিলে চলেন, নাস্তা করবো।
নাস্তাপর্ব শেষে চা খেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ভাবী কফিও দিলেন। আমরা গল্প করছিলাম। বন্ধু বললেন, কয়েকদিন আপনি ছিলেন, বেশ ভালো লাগছিলো। আপনি চলে যাবেন, মনটি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কালেভদ্রে এখানে দেশের দুয়েকজনের সাথে দেখা হয়। নাহয় বিদেশীদের নিয়েই থাকতে হয়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তো কারো সাথে তেমন একটা দেখাও হয়না। বন্ধুর কথা শুনে আমার মনটি নিজে নিজে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আহা, কী অসহায় একাকীত্ব!
আমি কোথাও ঘুরতে যাবো কিনা জানতে চাইলেন তিনি। বললেন, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অলস বসে আছে। কোথাও গেলে নিয়ে যান। শপিং টপিং কিছু করলে আপনার ভাবীকে সাথে নিয়ে যেতে পারবেন, ও সব চিনে। আমি মাথা নাড়লাম। কোথাও যাবো না। আজকের দিনটি আমরা দুজন একসাথে বসে থাকি, এতেই আমার ভালো লাগবে। আমার বন্ধু হাসলেন, বিষন্ন হাসি।
ড্রয়িং রুমেই বসে থাকলাম আমরা। একের পর এক চা কফি উজাড় করলাম, নানা ধরনের ফলমূল এবং নাস্তা খেলাম কয়েকবার। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেলে আমাকে জোর করে তুলে দিলেন বন্ধু। বললেন, গোছল করে আসুন। নামাজ পড়ে খাবার খাবো। আবারো নানাপদের খাবারে দুপুরের পর্ব সাঙ্গ করলাম। আমাকে জোর করে রুমে পাঠিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন। রাতভর নানা ভোগান্তি পোহাতে হবে আপনাকে। আমারও মনে হলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে ভালো হবে। রাতের যন্ত্রণার কথা মনে হতেই মনটি খারাপ হয়ে গেলো। বিমানভ্রমণ কী যে যন্ত্রণা!
সন্ধ্যায় আর্লি ডিনার দেয়া হলো আমাকে। আমার বন্ধুও বসে গেলেন আমার সাথে। বললেন, আপনার সাথে যেনো এটা আমার শেষ ডিনার না হয়। আমি মনে মনে প্রমোদ গুনলাম। আমার বন্ধু কি ভয় পাচ্ছেন! মুখে জোর করে হাসি এনে বললাম, কী যে বলেন! নিশ্চয় আমরা চট্টগ্রামে আবারো একসাথে লাঞ্চ ডিনার করবো।
বন্ধু এবং বন্ধুপত্নীর দেয়া নানা উপহার এবং আমার লাগেজ সব গাড়িতে তোলা হয়েছে। বিদায়ের ক্ষণ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমার বেশ খারাপ লাগছিল। প্রিয়জনকে ছেড়ে যেতে এভাবেই বুঝি বুকের ভিতরটায় হাহাকার উঠে! গাড়ি ছুটছিল হংকংয়ের রাজপথ ধরে। বাইরে চোখ রেখে চুপচাপ বসে আছি। পেছনে এক দারুণ স্মৃতি রেখে সামনে ছুটছিলাম আমি।
বিমানবন্দরের নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে থাই এয়ারের চমৎকার বোয়িং এর উইন্ডো সিটে বসে আছি। পাইলট আকাশে উড়ার ঘোষণা দিলেন। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই বোয়িংটি রানওয়ের দিকে চলতে শুরু করলো। অতি ব্যস্ত হংকং এয়ারপোর্টের রানওয়ের ক্লিয়ারেন্স পেতেও বেশ সময় লাগছিল। একসময় আমাদের নিয়ে বোয়িংটি তীব্র বেগে রানওয়ে ধরে ছুটতে লাগলো। অল্পক্ষনের মধ্যে রানওয়ের যাত্রা শেষ করে বোয়িংটি শূস্যে ভেসে গেল। আহা, জীবন! একসময় বুঝি সবই শূন্য হয়ে যায়! সবই পেছনে পড়ে যায়।
লেখক : দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার।