(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকংয়ের এ্যাপার্টমেন্ট এবং ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখে আমার ভিমরি খাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। এতো ছোট ঘরেও মানুষ বসবাস করতে পারে! অথচ দিব্যি মানুষ বসবাস করছে। ছোট্ট ঘরটির ভিতরে টিভি ফ্রিজ থেকে শুরু করে আধুনিক জীবনধারণের সব উপকরণই রয়েছে। সবকিছু সেট করা হয়েছে একেবারে অন্যভাবে। এক ইঞ্চি জায়গাও যেনো বাদ না পড়ে সেদিকে যেনো সজাগ দৃষ্টি নির্মাতাদের। ওয়াশরুমের শ্রী দেখার পর আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে, বাংলাদেশের এ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটগুলোতে অনর্থক এতো বড় বড় ওয়াশরুম বানিয়ে রাখে। এখানে পুরো ফ্ল্যাটে একটিই ওয়াশরুম। অথচ আমাদের দেশে ফ্ল্যাটের রুমে রুমে ওয়াশরুম না থাকলে কেমোন যেনো লাগে! আমার বেশ মনে পড়ছিল জাপানের কথা। জাপানের টোকিও এবং ওসাকা শহরে যে হোটেলগুলোতে ছিলাম সেখানে জীবনে প্রথম ওয়াশরুমের এমন ‘চিকন’ ভাবের সাথে পরিচয় ঘটেছিল। লন্ডনসহ ইউরোপের বহু দেশেই তো তিন চার ফ্যামিলি মিলে একটি কমন ওয়াশরুম ব্যবহার করে।
স্বপনের গ্রামের বাড়িতে যে পরিমান আরাম আয়েশ ফ্ল্যাটটিতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু এই নিয়ে স্বপনের মাঝে কোন বিকার আছে বলে মনে হলো না। সে রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে লাগোয়া ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চায়ের পানি তুলে দিয়েছে। ফ্রিজ থেকে নানা ধরণের ফলমুল বের করে টেবিলে রাখছে। আমাকে ইশারায় খেতে শুরু করতে বললো। স্বপন নিজে একটি আঙ্গুর মুখে পুরে দিয়ে বললো, এসব একেবারে ফ্রেশ। ফরমালিন কিংবা কার্বাইডের মতো ক্ষতিকর কোন কেমিক্যাল এদেশের কোন ফলে থাকে না। তুই চোখ বন্ধ করে খেতে থাক। আমি চা করছি। দারুণ চা বানাই আমি। নাকি কফি খাবি? আমি টসটসে আঙ্গুর মুখে পুরতে পুরতে বললাম, চা–ই বানা। মাল্টা এবং কমলার স্বাদও যেনো অন্যরকম। চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। এরমধ্যে বার দুয়েক স্বপনের ফোন আসলো। বুঝতে পারছিলাম যে, সে তার বউয়ের সাথে কথা বলছে। ভাবী কোথায় যেনো ব্যস্ত আছে। স্বপন বললো, তোর ভাবীর সাথে দেখা হলো না। ওর ফিরতে দেরি হবে। কাজে আটকে গেছে।
সে অনেকটা অপরাধীর মতো মুখ করে বললো, তুই আসলি, আর তোর ভাবীর সাথে দেখা হলো না। ব্যাপারটি খারাপ হলো। কিন্তু কি করবো বল? কাজে আটকে গেছে। আসলে এখানে সবাই ব্যস্ত। কাজে ফাঁকি দিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। সবাইকেই ঝড়ের মধ্যে থাকতে হয়। কাজ আর কাজ। কাজ বন্ধ তো জীবনই অচল। এখানে আয়েশ করে গল্প করে দিন কাটানোর সুযোগ খুব বেশি মানুষের নেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমার ফোনও বেজে উঠলো। আমার যে বন্ধুর বাড়িতে হংকংয়ে এসে আস্তানা গড়েছি সেই বন্ধু দিনভর কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। কখন কোথায় আছি তার খবর নিয়েছেন। সিনেমা দেখা কিংবা শপিংমলে ঘোরার খবরে অসুস্থ শরীরেও খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। বললো, আমি তো কিছু করতে পারছি না। স্বপনের সাথে ঘুরে হলেও কিছু দেখে নিন। হংকং আসলেই খুবই সুন্দর। আমি সুস্থ থাকলে অনেক জায়গায় আপনাকে ঘুরাতে পারতাম। আমি তাকে নির্ভার থাকতে বললাম। বললাম যে, আবার আসবো। আপনি তখন ঘুরাতে পারবেন। আগে সুস্থ হয়ে যান।
স্বপন চা’টা যে দারুণ বানায় সেটা মিথ্যে বলেনি। আসলেই অসাধারণ এক কাপ চা খেলাম। এটি কি কারিগরের গুন নাকি মেটেরিয়ালের সেটি অবশ্য বুঝা গেলো না। হংকংয়ের চা পাতার নিশ্চয় আলাদা একটা ভাব রয়েছে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে স্বপন বললো, চল,বাইরে গিয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘুরি। সন্ধ্যার সময় হংকং অন্যরকমের সুন্দর হয়ে উঠে। তোর ভালো লাগবে। প্রতিটি শপিংমল আলোয় আলোয় ভরে যাবে। দিনের দেখার সাথে সন্ধ্যা বা রাতের দেখায় আকাশ পাতাল পার্থক্য চলে আসে। শুধু শপিংমলই নয়, পুরো হংকংই আলোয় আলোয় ভরে যায়। চারদিকে কেবল ঝলকানিই চোখে পড়ে। তোর ভালো লাগবে। স্বপন আমাকে আশ্বস্ত করলো যে, বেশি রাত করবো না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তোকে ওই বাড়িতে পৌঁছে দেবো।
আমার কোন কিছুতেই না নেই। কিছু বলারও নেই। পথঘাটের কিছুই চিনি না। স্বপন যেপথে নিয়ে যায় সেপথে হাঁটা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই।
স্বপনের বাসা থেকে বের হলাম। বিশাল লিফট আবারো জনারণ্য। তবে আমাদের ঠাঁই হয়ে গেলো। লিফট থেকে স্রোতের মতো মানুষ বের হওয়ার দৃশ্যটাও ছিল দেখার মতো। কত মানুষ যে হুড়মুড় করে লিফট থেকে বের হয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগলো তার ইয়ত্তা নেই। নারী পুরুষ ও শিশু কিশোরের এমন মিলনমেলা সচরাচর কোন লিফটে দেখা যায় না। স্বপন বললো, এটি হংকংয়ের প্রায় প্রতিটি বড় বড় এ্যাপার্টমেন্টের কমন দৃশ্য। বড় বড় এ্যাপাটমেন্টগুলোতে দুই দরোজারও লিফট থাকে। পঞ্চাশ থেকে ষাটজন মানুষ অনায়াসে এসব লিফটে দোতলা থেকে ষাট, সত্তর কিংবা আশি তলায় ওঠানামা করে। এক একটি এ্যাপার্টমেন্টে আট দশটি লিফট থাকে। আবার লিফটগুলোতেও রেশনিং করা হয়। কোনটি দোতলায় থামলে কোনটি থামে না। কোনটি জোড় নম্বরের ফ্লোরে আবারো কোনটি বেজোড় নম্বরে ফ্লোরে ওঠানামা করে। কোন কোনটি আবার দশ বিল তলা পর্যন্ত থামবেই না। এরপরের ফ্লোরগুলোতে থামবে। আরো কত কিছু যে হংকংয়ে দেখার বাকি আছে কে জানে! লিফট থেকে নেমে সবাই সামনের দিকে ছুটলেও আমরা হাঁটছিলাম ধীরলয়ে। আমাদের তেমন কোন তাড়াহুড়ো ছিল না, তাছাড়া ওদের মতো দৌঁড়ানোতে আমি অভ্যস্তও না। স্বপন বহুদিন ধরে হংকংয়ে থাকে। তাই দৌড়ঝাপ সে বেশ রপ্ত করেছে। তবে এখন আমার সাথে ‘জামাই হাঁটা’ হাঁটছে।
স্বপন আমাকে নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। আবারো সেই নান্দনিক ফুটপাত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখলেই চোখে শান্তি লাগে, পা ফেলতে আরাম লাগে। ফুটপাত যেনো বাসা বাড়ির ফ্লোর। উঁচু নিচু বা খানাখন্দক নেই। টাইলস করা। ফুটপাতের নান্দনিকতার মাঝে একটি বিষয় আমার খুব খটকা লাগলো। চওড়া ফুটপাতের কোথাও কোথাও বিশাল বিশাল গাছ। ফুটপাতের মাঝখানেই গাছ। কোন কোন গাছ এতো বড় যে, ফুটপাতের প্রায় অর্ধেক দখল করে রেখেছে। গাছকে ঠিক গাছের জায়গায় রেখে মুল রাস্তা থেকে কয়েক ইঞ্চি উঁচু করে ফুটপাতের জায়গায় ফুটপাত রাখা হয়েছে। গাছের জন্য ফুটপাত বাঁকা করা হয়নি, আবার ফুটপাতের জন্য গাছও কেটে ফেলা হয়নি। পথচারীরা গাছের পাশ দিয়ে পাশ কেটে যাতায়াত করছে। শহরে গাছ রক্ষার এমন কৌশলের জন্যই হংকং শহরে আজো এতো গাছ টিকে আছে। আমার মনে হলো, আমাদের দেশে ফুটপাত বা রাস্তা বানানোর সময় এমন গাছের ‘অত্যাচার’ (?) থাকলে কবেই কেটে সাবাড় করে দেয়া হতো!
বেশ চওড়া ফুটপাত ধরে শত শত নারী পুরুষ ছুটছে। পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে গাড়ি, মোটর সাইকেল, সাইকেল। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে শত শত সাইকেলের এক অনন্য যাত্রা। এটা কি ইউরোপের মতো সাইকেল লেইন। খেয়াল করলাম, মার্ক করা নেই। তবে শত শত সাইকেল দেখে ভাবতে অসুবিধা হচ্ছে না যে দ্রুতগামী গাড়িগুলো এই লাইনটিতে পারতপক্ষে হানা দেয় না। আবার রাস্তা থেকে ফুটপাত সামান্য উঁচু হওয়ায় সাইকেলের সাথেও পথচারীদের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটছে না।
গল্প করতে করতে পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা। আলোয় আলোয় ভরে আছে চারদিক। ফুটপাতে সূচ পড়লেও খুঁজে নেয়া যাবে। ভবনগুলোর দেয়ালে দেয়ালে আলোর ঝিলিক। নানা বিজ্ঞাপন চিত্র চলছে। পুরো দেয়াল যেনো এক একটি টিভি। প্রতিটি দেয়াল থেকেই ঠিকরে বের হচ্ছে বর্ণিল উজ্জ্বল আলো। কত ধরণের বিজ্ঞাপনচিত্র যে দেখানো হচ্ছে। কত ধরণের মডেল। অধিকাংশই নারী। স্বল্পবসনা নারীদের মডেল বানিয়ে রকমারি পণ্যের বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছে। বিজ্ঞাপনে নারীদের এমন জয়জয়কার অবশ্য নতুন নয়, এটি পৃথিবীর দেশে দেশে রয়েছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী