দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সাই সাই করে ছুটছিল গাড়ি। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকলেও সমানতালে রয়েছে গতি। গাড়ির জন্য কোথাও ভয়াল জটলা চোখে পড়লো না। তবে ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে দীর্ঘ সারির পেছনে পড়তে হচ্ছিল। সবুজ বাতি জ্বলার সাথে সাথেই আবারো শুরু হচ্ছিল গতি। আমার মনে হলো গতির এমন জয়জয়কারই হংকংয়ের তাক লাগানো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে।

আমাদের গাড়ির গতি কমে আসলো। বামে ইন্ডিকেটর দেয়ায় বুঝতে বুঝতে পারছিলাম যে, ড্রাইভার গাড়ি থামাবে। আমরা হয়তো গন্তব্যে চলে এসেছি। গন্তব্য বলতে তেমন আহামরি কিছু নয়, আমাকে হংকংয়ের রাতের বাজার দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাতের বাজার, মানে নাইট মার্কেট। দুনিয়ার বহুদেশেই নাইট মার্কেট বেশ জমে উঠে। রাতে রাস্তার উপর বসা এই বাজার বেশ জনপ্রিয়ও। জীবনে প্রথম নাইট মার্কেটের নাম শুনেছিলাম মালয়েশিয়াতে। প্রথম দেখাও ওখানে। রাস্তাজুড়ে নাইট মার্কেটের জৌলুশ দেখে চোখ কপালে উঠেছিল। কী যে জমজমাট কারবার ছিল কুয়ালালামপুরের সেই নাইট মার্কেটে! এরপর আরো বহু বহু জায়গায় এই নাইট মার্কেটে ঘুরেছি। কেনাকাটার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও নাইট মার্কেট বেশ টানে আমাকে। বাহারী নানা পণ্যের পসরা দেখা যায়, দেখা যায় রঙবেরঙের মানুষ। দারুণ সব আয়োজনের পাশাপাশি রকমারি স্ট্রিট ফুড অসাধারণ লাগে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ পুরো অঞ্চলটিতে স্ট্রিট ফুডের বেসাতি জমজমাট। বিকেল থেকে শুরু করে গভীর রাত অব্দি রাস্তার পাশে, ভবনের সামনে চত্বরে, কিংবা কোন উন্মুক্ত মাঠে স্ট্রিট ফুডের দারুণ ব্যবসা চলে। স্ট্রিট ফুড বলে নাক ছিটকানোর হয়তো সুযোগ রয়েছে, তবে মুখে দিলে অন্তর ভরিয়ে তোলে। আবার স্বাস্থ্যসচেতন মানুষও অনায়াসে চোখ বন্ধ করে এসব খাবার মুখে পুরে। দারুণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাঁধুনি চোখের সামনে রান্না করে দিচ্ছেন। কোন পোড়া তেল নেই, ব্যবহৃত তেল নেই। টাটকা তেলে চোখের সামনে টাটকা রান্না!

নাইট মার্কেটগুলোতে কত ধরণের পণ্য যে সাজিয়ে রাখা হয়! দুনিয়ার সব যেনো মিলে যায় স্ট্রিট মার্কেটে। শপিং মলের তুলনায় দামও বেশ কম হওয়ায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অন্যদিকে দোকানভাড়াসহ নানা খরচ না থাকায় ব্যবসায়ীরাও অপেক্ষাকৃত সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে পারে। পণ্যসামগ্রি বেশি বেশি বিক্রির সুযোগ থাকায় কম লাভে বিক্রি করলেও দিনশেষে ব্যবসায়ীরা দারুণ মুনাফা করে। স্ট্রিট মার্কেট কিংবা নাইট মার্কেটের ব্যবসায়ীদের এটাই বড় সুবিধা। কম লাভ, বেশি বিক্রি তবে দিনশেষে বেশি মুনাফা। অর্থনীতিতে এই ব্যাপারটির কী যেনো একটি নাম আছে। বহু বছর আগে পড়েছিলাম, তাই নামধাম ভুলে গেছি। তবে পুরো বিষয়টি মাথায় ঢুকে আছে। কখনো ব্যবসায়ী হলে এই ধারণাটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। বিক্রি বেশি, মুনাফা কম দিনশেষে লাভ বেশি। আরো একটু খোলাসা করে লিখলে, কোন দোকানি একটি পণ্যে কেজিতে ১০০ টাকা লাভ করে পুরোদিনে ১০ কেজি বিক্রি করে ১০০০ টাকা মুনাফা করলেন। অপর একজন ব্যবসায়ী প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা করে লাভ করে পুরো দিনে ১০০ কেজি বিক্রি করে ৫ হাজার টাকা লাভ করলেন। এতে দিনশেষে কম মুনাফায় বিক্রি করা ব্যবসায়ীই বেশি লাভবান হলেন।

অর্থনীতির এই সূত্রটি বহু ব্যবসায়ী অনুসরণ করেন বিধায় স্ট্রিট মার্কেটে অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। মার্কেটজুড়ে থাকা পণ্যের বিশাল ভান্ডারে দেখে শুনে পণ্য কেনার অবারিত সুযোগও অনেককেই আকৃষ্ট করে। আমি হংকংয়ের রাতের বাজার দেখার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে লাগলাম।

ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করালো। আমাকে ‘একটু দাঁড়ান’ বলে সে গাড়ি পার্কিং এ রাখতে চলে গেলো। রাত নেমেছে অনেক আগে। কিন্তু তবুও রাস্তার যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে শপিং করার সুযোগ নেই। পার্কিং এ গিয়ে গাড়ি রাখতে হবে। তবে রাতের বেলায় পার্কিং চার্জ কমে যায়। পিকআওয়ার এবং অফপিকআওয়ারের ব্যবধান রয়েছে পার্কিং এ।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার ফিরে আসলো। সে আমাকে ইশারা করে সামনে হাঁটতে শুরু করলো। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর বড় বড় ভবন, চওড়া ফুটপাত। আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছি। একেবারে তকতকে ঝকঝকে ফুটপাত, টাইলস করা। ফুটপাতের কোথাও কোন ময়লাআবর্জনা দেখা গেলো না। এমন ফুটপাতে অনায়াসে বসে পড়া যায়, মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে আকাশের চাঁদ তারা গুনতেও খারাপ লাগবে না। এমন পরিস্কার এবং চওড়া ফুটপাত ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও খারাপ লাগবে না।

কিছু পথ এগুনোর পর রাস্তা জুড়ে আলোর বন্যা। বিশাল চওড়া রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশের ইলেক্ট্রিক পোলের মতো পোলে অগুনতি বৈদ্যুতিক বাতি। সামিয়ানা টাঙ্গানোর মতো করে বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে। বলাকৃতির বাতিগুলো রঙিন। নানা রঙের, নানা বর্ণের। পুরো রাস্তা জুড়ে বলের মতো বড় বড় বাতি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। যার আলোতে শুধু আলোকিতই নয়, একটি ভিন্ন আবহও তৈরি হয়েছে। সড়কের দু’পাশে শত শত বহুতল ভবন, বহুতল মানে পঞ্চাশ ষাট তলা উঁচু। কী আজব এক দেশরে ভাই! ভবন মানেই যেনো পঞ্চাশ ষাট তলা!

আমাকে আনা হয়েছে টেম্পল স্ট্রিট নাইট মার্কেটে। এটি হংকংয়ের অনেক বড় এবং সবচেয়ে ব্যস্ত নাইট মার্কেট। হংকংয়ে আরো কয়েকটি নাইট মার্কেট থাকলেও এটির মতো জৌলুশ নাকি আর কোনটিরই নেই। ড্রাইভারের কথার সত্যতা টের পেলাম প্রথম দেখাতেই। থরে থরে সাজানো নানা পণ্য দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না যে, এই নাইট মার্কেট আমাদের হকার্স মার্কেটের মতো হলেও এটির শান মান অন্যরকমের।

নাইট মার্কেট বসানো হয় রাস্তা বন্ধ করে। অফিস আদালত ছুটি হয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে নাইট মার্কেট বসানো হয়। নাইট মার্কেট পুরোপুরি অস্থায়ী একটি ব্যপার। সন্ধ্যায় বাজার বসতে শুরু করে। রাত বাড়ার সাথে সাথে জৌলুশ বাড়ে এবং রাত গভীর হলেই বন্ধ হয়ে যায়। গাড়িতে, ভ্যানে, টেক্সিতে করে সব ব্যবসায়ী নিজেদের পণ্য নিয়ে যায়। পরদিন সন্ধ্যায় আবারো আসে। এটিই নাইট মার্কেট। রাতের বাজারগুলোতে এভাবে ব্যবসা চলে।

আমরা হেঁটে হেঁটে মার্কেটজুড়ে থাকা পণ্যের পসরা দেখছিলাম। কত ধরনের পণ্য যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিলবিল করছে নারী পুরুষ। জমজমাট বিকিকিনি। মার্কেটের অদূরে নাইট ক্লাবও রয়েছে। ক্লাবের সামনে হল্লাও চোখে পড়লো। ভিতরে কি চলছে কে জানে!

নানা ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে, কত ধরণের খাবার যে তৈরি হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তবে এখানে একটু চোখে লাগলো যে, স্টলের সামনে পেতে রাখা চেয়ার টেবিলে দিব্যি শোভা পাচ্ছে মদ বিয়ারের বোতল। গলায় হট ড্রিংকস চালাতে চালাতে ডিনার টাইপের খাবার সারছে মানুষ। নানা ধরনের খাবার তৈরি হচ্ছে। ঝাল খাবার, মিষ্টি খাবার, গরম খাবার, ঠান্ডা খাবার। কফি আইসক্রিম থেকে শুরু করে সী ফুড কিংবা বনের প্রাণী কিছুই বাদ নেই খাবারের টেবিল থেকে। আড়চোখে নানা কিছু দেখছিলাম। ড্রাইভার কিছু খাবো কিনা জানতে চাইলো। বললাম, চলো, কোথাও বসে ঝাল কিছু খাই। ড্রাইভার সায় দিলো। পাকুড়া টাইপের একটি খাবার নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলাম। দারুণ টেস্টি। তবে কী যেনো একটি নাম বলা হলো এই খাবারের। পুরোটাই সবজি।

খাবারের স্টল পার হয়ে সামনে এগুলাম। দারুণ সব স্যুট বিক্রি হচ্ছিল, জুতার পসরা আসলেই মন কেড়ে নিচ্ছিল। ওমা, এক জায়গায় দেখি ড্রোন বিক্রি হচ্ছে। নেবো নাকি একটি! কিন্তু বিমানবন্দরে ধরে বসবে। তাই নেড়েছেড়ে রেখে দিলাম। রোবট বিক্রি হচ্ছে। রোবট কী সুন্দর করেই না হাঁটছে। আহা, কী অভাবনীয় ব্যাপার। ড্রোন এবং রোবট বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতে! হংকংয়ের শিল্প কোন পর্যায়ে গেছে তা যেনো এই নাইট মার্কেট চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলো। আমরা হাঁটছিলাম। যত সামনে এগুচ্ছিলাম, চোখের ঘোর যেনো ততই বাড়ছিল। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআক্ষেপ রয়ে গেল মনে
পরবর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্প বিপ্লব-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-শ্রমজীবী মানুষের ওপর তার অভিঘাত