(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাংলাদেশের সাথে হংকং–এর দূরত্ব প্রায় তেইশ’শ কিলোমিটার, সময়ের ব্যবধান মাত্র দুই ঘন্টা। সময়ের দিকে দুই ঘন্টা এগিয়ে থাকা হংকং–এর জীবনযাত্রার মান এবং আর্থসামাজিক অবস্থা আমাদের চেয়ে শত বছর এগিয়ে রয়েছে। এ যেনো সময়ের ব্যবধানটি ভুলে গিয়ে আমাদেরকে কেবল দূরত্বটিই মনে করিয়ে দিচ্ছে। হংকং আমাদের তুলনায় এতো বেশি এগিয়ে রয়েছে যে তা ঠিকঠিকভাবে সময়ের ফ্রেমে বাধাও অসম্ভব। বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে হংকং–এর যে চিত্র দেখেছি তাতে শুধু আমার চোখই বড় হয়নি, মগজেও ঝড় চলছে। সাগরপাড়ের দুইটি শহর, চট্টগ্রাম এবং হংকং। অথচ কী ভয়ংকর অমিল!! বন্ধুর সাথে আড্ডায় হংকং–এর অগ্রযাত্রা নিয়েই কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল কী করে একটি দেশ এমন তরতরিয়ে আকাশ ধরে ফেললো। সাগরের বিচ্ছিন্ন কতগুলো দ্বীপে কী করে শততলার ভবনের মিছিল শুরু হলো! ক্রমে বাড়ছিল রাত, বাড়ছিল আমাদের আড্ডাও। চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে আমরা কেবলই হংকং বন্দনা করছিলাম।
জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হলো। ভিয়েতনামি মেয়েটির রান্না নয়, ভাবীর হাতের বাঙালি রান্না। নানাপদের খাবারে কেবলই দেশীয় স্বাদ, গন্ধ। ব্যাকইয়ার্ডের বাগান থেকে তুলে আনা কাঁচামরিচ এবং লেবুও টেবিলে সাজিয়ে দেয়া হলো। ভাবীর নিজের হাতে লাগানো গাছ বলেও জানানো হলো। কথায় কথায় বলা হলো যে, আমাদের মতো অনাদরে এখানে গাছ জন্মায় না, যত্ন করতে হয়। যত্নের সাথে লালন করে ফলন ফলাতে হয়। ডিনার শেষে কফিও পেলাম।
খেয়াল করলাম যে, আমার বন্ধু ঘন ঘন হাই তুলছেন। নিদ্রাদেবী জেঁকে বসলে যেমনটা হয়। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের থেকে দুই ঘন্টা আগে রাত নামা হংকং–এর বাসিন্দাদের ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। তাছাড়া যারা সকালে উঠে স্কুল কলেজ কিংবা অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদেরকে রাতে সময়মতোই বিছানায় যেতে হয়। ছন্নছাড়া জীবন তাদের মানায় না। আমি উঠে পড়লাম। নিদ্রাদেবীর দেখা পেতে ঢের দেরি থাকলেও ‘টায়ার্ড লাগছে, ঘুম ধরেছে’ বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সকালে দেখা হবে বলে বিদায় নিলাম।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঠিক কয়টা বাজে ঠাহর করতে পারছিলাম না। ভারী পর্দায় ঢাকা জানালা দিয়ে বাইরের অবস্থা বুঝাও অসম্ভব। মোবাইল টেনে নিয়ে ঘড়িতে চোখ দিয়ে কিছুটা চমকে উঠলাম। এত বেলা! পূর্বদুয়ারী ঘরটির দরোজা খুলে ছোট্ট উঠোনটিতে দাঁড়াতে টের পেলাম যে সূর্য বেশ উপরে উঠে গেছে। এখানেও সময়ের হেরফের বড় ধরণের কাজ করেছে। দেশে আমার যখন স্বাভাবিকভাবে ঘুম ভাঙে তখন হংকং–এ সূর্য অনেক উপরে উঠে যায়। দুই ঘন্টা কম সময় নয়! আমি হংকং থাকলেও বডি ক্লক ঠিকই চট্টগ্রামের রয়ে গেছে।
সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম। ড্রয়িং রুমের টিভির সামনে আমার বন্ধু বসে আছেন। হাসলেন আমাকে দেখে। ঘুম হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। ভাবীও এগিয়ে এলেন। বললেন, টেবিলে আসুন। নাস্তা রেডি আছে। আপনার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ওনারা আরো আগে নাস্তা করেন। কিন্তু আমার জন্য দেরি হয়ে গেলো।
নাস্তার টেবিলে প্ল্যান হলো যে, বন্ধুর সাথে করে আমিও অফিসে যাবো। ওখান থেকে পরে অন্য কোথাও ঘুরতে যাবো। তবে বন্ধু নিজের শারীরিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলে রাখলেন যে, কতক্ষণ বা কতটুকু পর্যন্ত আপনার সাথে যেতে পারবো জানি না। তবে ড্রাইভার আপনাকে নিয়ে ঘুরবে। সবকিছু দেখাবে। সে হংকং এ অনেকদিন ধরে থাকে। ছোট্ট দেশটির প্রায় পুরোটাই তার নখদর্পণে।
বন্ধুর শরীরটি খারাপ হয়ে যাওয়ায় বেশ অস্বস্তি লাগছিল। এমন অসুস্থ একজন মানুষকে কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয়না। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। হোটেলে চলে যাবো কিংবা একা একা ঘুরবো বললে তিনি মনে কষ্ট পাবেন কিংবা তিনি যাচ্ছেন না বলে আমি রাগ করেছি সেটাও ভাবতে পারেন। আমার কি বলা বা করা উচিত সেটাও বুঝতে পারছিলাম না।
প্রচুর গাড়ি রাস্তায়। বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাওবা টানেল পার হয়ে ছুটছিলাম আমরা। গন্তব্য বন্ধুর অফিস। অফিসটি বাসা থেকে বেশ দূরে, হংকং–এর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় বলেও জানাতে পারলাম। আমি মনে মনে বললাম. যত দূরে হয় ততই ভালো। দেখে দেখে যেতে পারবো। কাছে হলে তো এখনি দেখাদেখি ফুরিয়ে যাবে। গাড়ি চলছিল। আমি জানালায় চোখ রেখে দেখছিলাম সবকিছু। আকাশ দেখা যাচ্ছিল না সুউচ্চ ভবনের জন্য। কতগুলো একশ’ তলা ভবন যে রয়েছে দেশটিতে! দূরে সাগর দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে বন্দর। অগুনতি জাহাজ সাগরে নোঙর করে আছে। যে বন্দর হংকং–এর সমৃদ্ধিতে অনেক বড় এবং অনেকটা একক ভূমিকা রেখেছে!
হংকং কি চীনের অংশ? প্রশ্নটি করেছিলাম বন্ধুকে। তিনি বললেন, হংকং অবশ্যই চীনের অংশ। তবে হংকং একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। হংকং এর আলাদা শাসক রয়েছেন, রয়েছে আলাদা মুদ্রা। কিছু নিয়ম কানুনও আলাদা। চীনের ভিসা নিয়ে হংকং ভ্রমণের সুযোগ নেই, আবার হংকং–এর ভিসা নিয়েও চীনে যেতে পারবেন না। তবে হংকং এর উপর চীনের একটি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ব্রিটেন হংকং–কে বেশকিছু শর্তে চীনের কাছে হস্তান্তর করে। চীন ‘এক দেশ দুই নীতি’ শর্তে হংকং পরিচালনা করছে।
হংকং–এর ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। গণচীনের দক্ষিণ–পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত হংকং দক্ষিণ চীন সাগরের ভেতরের দিকে প্রসারিত। এর উত্তর দিকে চীনের মূল ভূখন্ড এবং পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণে রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর। পার্ল নদীর বদ্বীপের পূর্বভাগে অবস্থিত হংকং নামের ছোট্ট অঞ্চলটি ২৬০টিরও বেশি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এই সাগরই হংকং–এর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বে সমুদ্রবাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে হংকং এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ১৮২১ সালে ব্রিটিশ বণিকেরা হংকং–কে বন্দর হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। গত শতাব্দির মধ্যভাগে হংকং নিয়ে ব্রিটিশ এবং চীন একাধিকবার যুদ্ধ করে। ১৮৪২ সালে সংঘটিত প্রথম আফিমের যুদ্ধে চীনের ছিং সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের কাছে হংকং দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়। ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের পরে উপনিবেশটির সাথে কাওলুন উপদ্বীপটিও যোগ করা হয়। পরে ১৮৯৮ সালে এসে ব্রিটিশ সরকার নতুন অঞ্চল বা নিউ টেরিটোরিজ ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিলে হংকং এর আয়তন বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুরো হংকং চীনের কাছে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় ব্রিটেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের কাছে শর্তসাপেক্ষে ফেরত দেয়া হয়। আর এই শর্তই হংকংকে চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের মর্যাদা দেয়। এতে করে বিশাল চীনের বাকী অংশের প্রচলিত সব নীতি বা নিয়ম হংকং–এ মানে না। ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ মূলনীতির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে হংকং।
হংকং–এর অনেকগুলো দ্বীপের মধ্যে প্রধান দ্বীপটির নামই হংকং। লানথাউ নামেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রয়েছে। এছাড়া কাওলুন উপদ্বীপ এবং কাওলুন উপদ্বীপের উত্তরে নতুন অঞ্চল বা নিউ টেরিটরিজ। হংকং দ্বীপের উত্তর–পশ্চিম তীরে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া নামের এলাকাটি হংকং–এর প্রধান বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র। সেই ভিক্টোরিয়ার দিকে ছুটছি আমরা। হংকং–এ বর্তমানে এক কোটির মতো মানুষের বসবাস। একসময় এই অঞ্চলটি অনেকটা জনশূণ্য ছিল। বাসিন্দাদের আয় রোজগার ছিল সাগর ও নদীতে মাছ শিকার এবং কৃষি। এখনো হংকং–এর মৎস্য সম্পদ অনেক সমৃদ্ধ। তবে ব্যবসা বাণিজ্যে হংকং অকল্পনীয় উন্নতি করেছে। একসময়কার গরীব এবং অভাবী মানুষদের আবাসস্থল হংকং এখন বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। একটি বন্দরকে কেন্দ্র করে হংকং হয়ে উঠে বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। ব্যাংকিং, বিনিয়োগ এবং সিনেমা নির্মাণে হংকং–এর সফলতা অতীতের জেলেপল্লীর দাগ পুরোপুরি মুছে দিয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যে এশিয়ায় টোকিও, সাংহাই ও সিঙ্গাপুরের কাতারে হংকং এর অবস্থান। আমি মনে মনে টোকিও, সাংহাই এবং সিংগাপুরের উন্নয়নের সাথে হংকং এর মিল–অমিলগুলোর হিসেব মিলাতে শুরু করলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।