(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কখনো টানেল, কখনো ব্রিজ কখনোবা সড়কের উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। গন্তব্য মানে আমার বন্ধুর বাড়ি। বাড়িটি শহরের এক প্রান্তে বলে মনে হলো। কারণ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে প্রায় পুরো শহর মাড়িয়ে তবেই বাড়িতে পৌঁছলাম। যাক, বাড়ির গেটেই রিসিভ করা হলো আমাকে। বন্ধু অসুস্থ থাকায় বিমানবন্দরে যেতে পারেন নি বলে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। আসতে কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা তাও মনে হয় বার কয়েক জিজ্ঞেস করে ফেললেন। গাড়ি পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, যেখানে গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে সেখানে অচিন শহর আর অচিন থাকে নাকি! বিমানবন্দর থেকে ড্রাইভারই তো আমাকে এতদূর নিয়ে আসলেন। সুতরাং কষ্ট যা করবার ড্রাইভারই করেছেন, আমি নই।
ড্রয়িং রুমে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ভাবীকে এক কাপ কড়া লিকারের চা কিংবা কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। বললাম, আর কিছু খাবোটাবো না, হোটেলে গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবো। ভাবী আড়চোখে আমার বন্ধুর দিকে তাকালেন, একটু যেনো হাসলেন বলেও মনে হলো। আমাকে বললেন, ‘আগে ভাত খেয়ে নেন, পরে চা–কফি। আপনি একটু বসুন, গল্প–টল্প করতে করতে আমি টেবিল লাগিয়ে দেবো। দুই মিনিট লাগবে।’ তিনি কী একটা নাম ধরে কাকে যেনো ডাকলেন। ভাবী কিচির মিচির টাইপের ভাষায় কি যেনো বললেন। আমাকে বললেন, কাজের মেয়ে, ভিয়েতনামী। তার মাতৃভাষা এবং হংকং এর ক্যান্টনিজ ভাষাও জানে। আমরা হংকং–এর ভাষায় তার সাথে কথা বলি। বাংলা শিখানোর চেষ্টা করছি। বাংলা রান্নাও। আজ কী তবে ভিয়েতনামী ডিস চলবে!! কিছুটা শংকিত হয়ে উঠলাম।
বিমানে নানা খাবার খেয়েছি। এতে করে আমার কোন ক্ষুধা নেই। কিন্তু ভাবী সেটি শুনলেন না। নানা পদের খাবারে টেবিল ভরে গেলো। ক্ষুধা না থাকলেও বেশ খেলাম। মনে মনে হাসলাম এজন্য যে, মানুষই মনে হয় একমাত্র প্রাণি যার ক্ষুধা না লাগলেও খায়। আমিও খেলাম। অবশ্য এক্ষেত্রে হাঁসেরও বেশ বদনাম শুনতাম! হাঁসের কথা এজন্য মনে পড়লো যে, ভাবী বেশ ঝাল করে হাঁসের মাংস রান্না করেছেন। রান্না কি ভাবী করেছেন নাকি ভিয়েতনামি মেয়েটি করেছেন কে জানে! ভাবী আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, ভিয়েতনামের মেয়েটি রান্নাবান্না খুব বেশি কিছু জানে না। তার রান্না আমরা খেতে পারি না। সে কেবল সাহায্য করে। তবে এখন তাকে রান্না শিখাচ্ছি। সে রান্না শিখে গেলে আমি কিছুটা ফুসরত পাবো বলে হাসলেন ভাবী।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে হোটেল কতদূর জানতে চাইলাম। বললাম, এখন হোটেলে চলে যাই, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার চলে আসবো। বন্ধু বললেন, হোটেল বেশি দূরে নয়। কফি শেষ করুন। আস্তে আস্তে খান, তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটি টেবিলে রাখতেই আমার বন্ধু ড্রাইভারকে হাঁক দিলেন। দেশী ড্রাইভার। ঘরের ভিতরে বেশ ঘুরঘুর করছিলেন। আমি মনে করলাম, হোটেলে রেখে আসার জন্য বলবেন। কিন্তু বন্ধু বললেন, লাগেজটি উপরে তুলে দাও। ভাইকে রুম দেখিয়ে দাও। আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম। বললাম, ‘উপরে মানে! বন্ধু বললেন, ওর সাথে যান। বাকি গল্প পরে হবে।’
আমার বন্ধুর বাড়িটি ত্রিপ্লেক্স। ড্রয়িং রুম থেকেই সিঁড়ি উঠেছে উপরের দিকে। দোতলার লিভিং রুমের পাশ দিয়ে উপরের রুমে গেছে সিঁড়ি। একটির পর একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠছিলাম আমি। লাগেজ নিয়ে উঠছিলেন ড্রাইভার। তিন তলায় উঠে রুমের ভিতরে লাগেজ রেখে ড্রাইভার চলে গেলেন। দারুণ একটি রুম। বেশ বড়সড়। সাজানো গোছানো। তারকা হোটেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এটাচড বাথ। রকিং চেয়ার থেকে শুরু করে নানা আসবাবে রুমটি দারুণ স্মার্ট। কাপলবেডের বিশাল বিছানায় নতুন চাদর পাতা, দুটো বালিশ একটির উপর একটি দিয়ে তার উপর আবার কুশন দেয়া হয়েছে। কোল বালিশটি বেশ নাদুস–নুদুস। এক পলকে রুমটি দেখে প্রথম দেখায় ভালো লেগে গেলো। কিন্তু ফ্যামিলির ভিতরে উটকো একজন মানুষের বসবাস আসলে অস্বস্তির। তাই প্রিয়বন্ধু হোটেলের পরিবর্তে তার ঘরে রাখার ব্যবস্থা করলেও বেশ অস্বস্তি লাগছিল আমার!
আগেই বলেছি চট্টগ্রামের পাঁচ ভাগের একভাগ জায়গা নিয়ে হংকং। এরমধ্যেও নদ–নদীও রয়েছে। ফলে বাসযোগ্য জায়গার বড়ই আকাল হংকং–এ। সামান্য এই জায়গার মধ্যে এক কোটি মানুষ বসবাস করে। এতে করে হংকং শহর মানেই মানুষের উপর মানুষের বাস। একটির পর একটি তলা নির্মাণ করে মানুষের বসতি গড়া হয়েছে। শত তলা ভবনে ভরপুর হংকং। ছোট বাড়ি হংকং এ খুব বেশি নেই। নিজের বাড়ি কিংবা নিজের বাংলো অনেকটা রাজকীয় ব্যাপার। এগুলো পথিমধ্যে গল্প শুনেছিলাম ড্রাইভারের কাছে। ছোটখাটো বাড়ি না দেখে প্রশ্ন করায় তিনি ব্যাপারটি খোলাসা করেছিলেন। এখন বন্ধুর বাড়ির হালচাল দেখে বুঝে গেলাম যে, হংকং–এর রাজকীয় জীবনযাপনকারীদের মধ্যে তিনি একজন। টাকা কড়ি কেমোন আছে সেই খবর আমি নিইনি, তবে আমার বন্ধু একটি বাংলো টাইপের বাড়িতে একা বসবাস করেন। একটি সুসজ্জিত এবং পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার ভিতরে অনেকগুলো বাড়ি। সবগুলোই আলাদা বাড়ি। একটির সাথে অপরটির সীমানা লাগোয়া হলেও আড়াই তলা টাইপের সবগুলো বাড়িই একইরকম। হাজার বারোশ’ ফুট আয়তনের ফ্লোরের উপর আড়াইতলা। নিচতলায় ড্রয়িং ডাইনিং এবং কিচেন, দোতলায় একটি মাস্টারবেডসহ তিনটি বেডরুম ও একটি লিভিং রুম। তিনতলায় গিয়ে একটি বড়সড় গেস্টরুম। রুমের সামনে এক টুকরো খোলা ছাদ। এই রুমটিতে ইউরোপীয়ান ডিজাইনের ডর্মার ছাদ। যে ছাদের নিচে শুরু হয়েছে আমার বসবাস।
রুমটি এতোই সুন্দর যে, মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সাজানো গোছানো রুমটিতে এয়ার ফ্রেশনারের মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করছিল। রুমের সামনের এক চিলতে খোলা ছাদে অনেকগুলো টব। নানা রকমের গাছ তাতে। কয়েকটি গাছে বেশ সুন্দর ফুল ফুটে আছে। একটি গাছে দেখলাম লেবু ঝুলছে। হংকং–এ লেবু আছে!! নিজে নিজে হাসলাম। আমি রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে গেলাম। একপাশে একটি দোলনা, একই সাথে দুজনের বসার ব্যবস্থা দেখা গেলো দোলনাটিতে। বুঝতে পারলাম যে, আমার বন্ধু হয়তো চাঁদনী রাতে হাওয়া খান দোলনায় বসে। আমি দুয়েকটি দোল খেয়ে নিলাম। মাথার উপর স্বচ্ছ নীল আকাশ, অনতিদূরে সুউচ্চ পাহাড়। কী যে সুন্দর এক একটি পাহাড়!!
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিছানায় গা এলানোর অল্পক্ষণের মধ্যে বেঘোরে তলিয়ে গিয়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ঠিক ক’টা বাজে বুঝতে পারছিলাম না। কখন কোথায় ঘুমিয়েছি তা ঠাহর করতেও কিছুক্ষণ সময় লেগে গেলো। হংকং–এ বন্ধুর বাসায় ঘুমানোর কথা মনে হতেই ধড়পড় করে উঠে পড়লাম। কিছুটা শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। শব্দ এজন্য করলাম যে, লিভিং রুমের পাশ দিয়ে সিঁড়ি, পাশেই বেডরুম। বাড়িতে মহিলারা রয়েছেন। কিন্তু সিঁড়িতে বা লিভিং রুমে কাউকেও দেখলাম না। নিচে নেমে ড্রয়িং রুমে দেখি আমার বন্ধু সোফায় গা এলিয়ে টিভি দেখছেন। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশী চ্যানেলে তিনি খবর শুনছিলেন। আহা, দেশ থেকে দূরে থাকা মানুষগুলো বিনোদনের জন্য নয়, দেশের খবরাখবরের জন্যই দেশীয় চ্যানেলে চোখ দিয়ে বসে থাকেন!
বন্ধুর পাশের সোফায় বসলাম। আমার বন্ধু অচিন ভাষায় কি যেনো বললেন। ভিয়েতনামী মহিলাটি চাকাওয়ালা একটি টেবিলে চা নাস্তা এনে দিলেন। ভাবীও এসে বসলেন আমাদের সাথে। আমি নাস্তার দিকে হাত না বাড়িয়ে চায়ের কাপটি টেনে নিলাম। ভাবী বেশ জোর করলেও আমি সেমাই, নুডলস, চমুচা এবং নাগেটসহ অন্যান্য নাস্তার প্রতি কোন আগ্রহ দেখালাম না। রকমারি ফলও ছিল। কিন্তু আমি চা’র কাপে আয়েশী চুমুক দিতে লাগলাম। চীনা চায়ের সুনাম শুনেছিলাম। কিন্তু হংকং এর চা’ও যে এতো শানদার তাও যেনো আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।