(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার পায়ে পায়ে হাঁটছে সানজানা। আমাদের দেখে যে কেউই মনে করবে সহযাত্রী। সানজানা যেনো আমার সাথেই বিদেশে এসেছে। কানের ব্যথায় মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে বিমানে আমাকে অস্থির করে তোলা মেয়েটি এখন দিব্যি ছুটছে। টানা বিরহের পর প্রিয়তম স্বামীর কাছে ফেরার মধ্যে মনে হয় আলাদা একটি জোর থাকে। সানজানা সেই জোরেই পা চালাচ্ছে, সামনে এগুচ্ছে। চকচকে ঝকঝকে হংকং বিমানবন্দরের এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ইমিগ্রেশনের উদ্দেশ্যে এগুচ্ছিলাম আমরা।
ভালোয় ভালোয় ইমিগ্রেশন শেষ হলো আমাদের। কোথায় যাবো, কি উদ্দেশ্যে এসেছি স্বাভাবিক দু’চারটি প্রশ্ন ছাড়া আর তেমন কিছু জানতে চাইলেন না। আমার যখন ইমিগ্রেশন হচ্ছিল তখন সানজানাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভাবখানা এমন যে আমরা একসাথে এসেছি! ইমিগ্রেশন অফিসার সানজানাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই পাসপোর্টে সীল মেরে দিলেন। এখানে বলে রাখা যায় যে, একজন যাত্রীর ইমিগ্রেশন করার সময় পেছনের যাত্রীকে নির্দিষ্ট দূরত্বে দেয়া মার্কিং লাইনের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। তবে ফ্যামিলি মেম্বারদের বেলায় এই মার্কিং লাইন কাজ করে বলে মনে হয়না। কারণ একই পরিবারের সদস্য কিংবা হাজবেন্ড–ওয়াইফ বা বাবা–মেয়ে হলে একসাথে জড়ো হয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ানো যায়। একসাথেও চার পাঁচজনের জটলাও বিভিন্ন সময় দেখেছি। সানজানাও লাইনের বাইরে অপেক্ষা না করে আমার সাথেই দাঁড়িয়ে যায় এবং একই সাথে ইমিগ্রেশন করে নেয়। পাসপোর্টের কোথাও তার সাথে আমার নামের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ইমিগ্রেশন অফিসার কিভাবে যে একইসাথে ইমিগ্রেশন করে দিলেন কে জানে! দুইটি পাসপোর্ট একই দেশের হওয়ায় ইমিগ্রেশন অফিসার কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছেন বলেও আমার মনে হচ্ছিল!
যাক, ভালোয় ভালোয় ইমিগ্রেশন শেষ করে আমরা লাগেজ কালেকশন স্পেসে চলে আসলাম। বেল্টের উপর যাত্রীদের লাগেজ ঘুরছে। আমি সানজানাকে তার লাগেজ কোনটি খেয়াল করতে বললাম, নিজের লাগেজের ব্যাপারেও সতর্ক চোখ রাখলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সানজানা লাগেজ পেয়ে গেলো। বেশ বড়সড় একটি লাগেজ। দেশ থেকে স্বামীর জন্য শুধু ভালোবাসাই নয়, বহু জিনিসপত্রও মেয়েটি বয়ে এনেছে। এতে করে তার লাগেজটি বেশ বড় হয়ে উঠেছে। এত বড় লাগেজ তার পক্ষে বেল্ট থেকে নামানো সম্ভব নয়। হংকং বিমানবন্দরে আমাদের বিমানবন্দরের মতো হেল্প করার লোকজনও নেই। এখানে সব কাজই নিজেকে করতে হয়। যার লাগেজ তাকেই বেল্ট থেকে টেনে নামিয়ে ট্রলিতে তুলতে হয়। ট্রলির জন্যও টাকা গুনতে হয়। মাগনায় ট্রলি পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। অধিকাংশ দেশেই মাটির ব্যাংকের মতো ছোট্ট মুখে কড়ি ঢুকিয়ে ট্রলি চালাতে হয়। কড়ি না ফেলা পর্যন্ত ট্রলি নড়ে না, চাকা ঘুরে না। ফেলো কড়ি মাখো তেলের ব্যাপারটি বিমানবন্দরেই প্রথম ছবক দেয়া হয়। যেন এদেশে ঘুরতে এসেছেন? খুবই ভালো। তবে পদে পদে কড়ি না ফেললে ভ্রমন নিরানন্দ হতে বাধ্য!
সানজানার ব্যাগটি আমি বেল্ট থেকে টেনে নামিয়ে ট্রলিতে তুলে দিলাম। ব্যাগ পাওয়ার পরও সে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি তাকে সামনে এগুতে বললাম। বললাম যে, দরোজার বাইরে নিশ্চয় তাকে নেয়ার জন্য স্বামী বেচারা অস্থির হয়ে আছে। সানজানা কিছু না বলে শুধু হাসলো এবং দাঁড়িয়ে থাকলো। আমার দুইটি লাগেজ নামানোর পর সে আবারো আমার পিছু নিলো।
সামাণ্য পথ এগিয়ে আমরা মুল দরোজা দিয়ে বের হয়ে আসলাম। এটিই এই বিমানবন্দরের এক্সিট পয়েন্ট। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা সব যাত্রীই এই গেট দিয়ে বের হয়ে গন্তব্যে যান। তবে এখানে কী গেট একটি নাকি দুইটি কে জানে! কোন কোন বিমানবন্দরে দুইটি তিনটি এক্সিট গেট থাকে। হংকং বিমানবন্দরেও অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরের মতো এক্সিট গেটের সামনে বেশ কিছু জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। কোন দুর্ঘটনাস্থলকে পুলিশ যেমন ফিতা দিয়ে ঘিরে দেয়, এখানেও তেমন করে ঘিরে রাখা হয়েছে। ঘেরা দেয়া স্থানটিতে শুধু বিদেশ ফেরত যাত্রীরা অপেক্ষা করছে বা দাঁড়াতে পারছে। সীমানার বাইরে অপেক্ষমান সব মানুষ।
অসংখ্য মানুষ সেখানে। তারা বিমানের যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে। এদের কেউ যাত্রীদের স্বজন, কেউবা ড্রাইভার। বিভিন্ন হোটেলের লোকজনও তাদের বোর্ডারদের নিয়ে যেতে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগই ড্রাইভার এসে থাকে। ভিআইপি কিছু লোকজনকে রিসিভ করতে আসেন অনেকেই। তারা প্রোটোকল পাস নিয়ে বিমানবন্দরের ভিতরে অপেক্ষা করেন। বাইরে সীমানার বাইরে লাইন ধরেন না। যাক, এখানে যারা অপেক্ষা করছে তারা প্রত্যেকেই সাধারণ। এরা অপেক্ষাও করছে সাধারণ যাত্রীদের জন্যই। এদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে যাত্রীর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড। তা উঁচিয়ে ধরে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফুলের তোড়া নিয়েও অপেক্ষা করছে অনেকে। প্রিয়জনের জন্য তারা তীর্থের কাকের মতো প্রহর গুনছে। সানজানার স্বামীও অপেক্ষা করছিলেন। সানজানা বেরুনোর সাথে সাথে স্বামীর চোখে চোখ পড়লো। দুজনই বেশ আবেগ নিয়ে মিলিত হলো। সানজানা তার স্বামীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো,‘এই ভাইয়াটা আমাকে খুবই হেল্প করেছেন। উনি না থাকলে সমস্যায় পড়তাম।’ আমি হাসলাম। বললাম, ‘হেল্প করার কিছু ছিল না। আমরা একসাথে গল্প করতে করতে চলে এসেছি। আপনার ব্যাপারে অনেক গল্প করেছে। অনেক ভালোবাসে আপনাকে। যত্ন করে আগলে রাখিয়েন।’ সানজানার স্বামী হাসলেন। তাদেরকে বিদায় দিয়ে আমি আমার বন্ধুর ড্রাইভারকে খুঁজতে লাগলাম।
শত শত মানুষের ভিড়ে কোনজন যে আমার কাঙ্ক্ষিত ড্রাইভার কে জানে! আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। দেশে থাকতেই ড্রাইভারের ছবি দেখেছি, হোয়াটসঅ্যাপে কথাও বলেছি। কিন্তু এখন এই ভীড়ভাট্টার মধ্যে আর চোখে পড়ছে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি। পাশ দিয়ে অসংখ্য লোক চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রিয়জনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেউবা জড়াজড়ি করে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করছে যে যেনো একজীবনে আর আলাদা হবে না। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। সবার জন্য সবাই আছে, শুধু আমি যেনো একদম একা। আহা, আসলেই একা। চারদিকে কত মানুষ, কিন্তু আমার কেউ নেই!
আমি জানিই যে ড্রাইভার অবশ্যই এসেছে বা আসবে। কোন কারণে হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আসলে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই, কোন বিকল্প নেই। আমার ইচ্ছে করছে একা একা হোটেলে চলে যেতে। কিন্তু ড্রাইভারের একটি হদিশ না পাওয়া পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফোনও চালু করতে পারছি না। ইন্টারনেট সুবিধাও নেই। পৃথিবীর বহু বিমানবন্দরে মাগনায় যৎসামান্য নেট পাওয়া যায়। হংকং এ অনেক চেষ্টা করেও সেই সুবিধা চালু করতে পারলাম না। ভাষাগত সমস্যার কারণে কারো সাথে কথাবার্তা বলে যে ফোনের সুবিধা নেবো তাও হচ্ছিল না।
এখানে বলে রাখা যায় যে, হংকং এর মানুষ ক্যান্টনিজ ভাষায় কথা বলে। এটা চীনা ভাষার মতোই। তবে পার্থক্যও নাকি অনেক। ম্যান্ডারিন এবং ক্যান্টনিজ ভাষা আমার কাছে একই হলেও ফারাক নাকি বিস্তর। আমার ধারে কাছে অনেকেই কিচির–মিচির করে কথা বলছিলো। তবে তারা কী ম্যান্ডারিন নাকি ক্যান্টনিজ ভাষা বলছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। চীনের মতো হংকংও ইংরেজী ভাষা নেই বললেই চলে। ইদানীং কিছু ইংরেজী চর্চা হলেও তা এখনো আপামর মানুষের লেভেলে আসেনি। এখন বিভিন্ন স্কুল কলেজে কিছু ইংরেজী চর্চা হচ্ছে। এ জেনারেশন যখন সবকিছু দেখভাল করতে শুরু করবে তখন হয়তো এই অঞ্চলে ইংরেজীর দুরবস্থা ঘুচবে!
আমার হাতে কোন কাজ নেই, কিছু করার নেই। লাগেজের ট্রলিটি একপাশে রেখে দাঁড়িয়ে আছি। খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সুযোগ নেই। ভিতরে থাকলে কফি খেতে পারতাম, বা এখান থেকে বেরিয়ে গেলেও কফি জুটে যাবে। কিন্তু এখানে এই ব্যারিকেডের ভিতরে থাকা অবস্থায় কোন কিছু কেনা বা খাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ব্যারিকেডের বাইরেও আমি যেতে পারছি না। অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা! অপেক্ষা সবসময়ই বিরক্তিকর। প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করতেও মানুষ অস্থির হয়ে উঠে, আর আমি তো বন্ধুর ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করছি!
‘স্যার, স্যার’ বলে কেউ যেনো চিৎকার করলো। শব্দটি শুনার সাথে সাথে কান খাড়া করলাম আমি। এটি যেনো শুধু একটি শব্দ নয়, কেমন যেনো স্বস্তি যেনো ভেসে আসছিল! বাঙালি টোনের ‘স্যার’ শব্দটি আমাকে বেশ নির্ভার করে তুলছিল। কে ডাকছে, কাকে ডাকছে জানি না, তবে শব্দটি অনুসরণ করে চোখ ফেলতেই দেখি সীমানার ওপার থেকে হাত নাড়ছে সাইফুল, আমার বন্ধুর ড্রাইভার। আমি একেবারে নির্ভার হয়ে গেলাম। বুকের পাথর যেনো নেমে গেলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।