(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এয়ারক্রাফটটি এগুচ্ছিল। আকাশে ডানা মেলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আমাদের বাহন। রানওয়ে ধরে ছুটছিলাম বোয়িং। আকাশে ভেসে যাওয়ার আগ দিয়ে প্রতিটি এয়ারক্রাফট যেমন তীব্র গতিতে ছুটে ঠিক তেমনি করে ছুটছে। বিপুল গতি, ঘন্টায় দুই আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালালে যেমন গতি টের পাওয়ার কথা, এখন এত বড় বোয়িংটি ঠিক সেভাবে ঝড়ের বেগে ছুটছে। ঘন্টায় আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে কোনদিন গাড়ি চালাইনি। দুইশ’ কিলোমিটারের কাছাকাছি গতিবেগ তোলার পর মনে হয়েছিল গাড়িটি রাস্তায় নেই, শূন্যে ভাসছি। আমি দ্রুত স্পিড কমিয়েছিলাম। অবশ্য চট্টগ্রামের কয়েকজনকে চিনি যারা দুই আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়েছিলেন, চালান।
যাক, আমাদের বাহনের ইঞ্জিনের শব্দ বাড়ছিল। তীব্র শব্দ তুলে এগুচ্ছে বোয়িং, ঝড়ের বেগে। একেবারে আচমকা যেনো ভেসে গেলাম শূণ্যে। হুঁ, বিমান ডানা মেলেছে! আমরা দুজন একেবারে পেছনের সিটে। আমাদের বোয়িং যেনো অনেকটা খাড়া হয়ে গেছে। আকাশে উড়ার জন্য সামনের দিকটি উপরের দিকে, পেছনের দিক অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি নিচে। সিট বেল্ট বাঁধা রয়েছে। তাই পেছনের দিকে অনেকটা হেলে পড়লেও খুব একটা সমস্যা হচ্ছিল না। খেয়াল করে দেখলাম যে, পাশে বসা মেয়েটি বেশ শক্ত করে সিট ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রথম বিমান ভ্রমন কিনা কে জানে!
বিমান আকাশের উপরের দিকে উড়ছে। এভাবে অন্তত ৩২ থেকে ৩৫ হাজার ফুট উপরে চলে যাবে। আহা, কী প্রযুক্তি, কী আবিস্কা!! এত মানুষ, এত লাগেজ, এত কিছু নিয়ে এত বড় বিমানটি আকাশের ৩৫ হাজার ফুট উপরে ভাসছে!! যেখানে একটি পাতা পর্যন্ত ভেসে থাকে না, সেখানে কয়েকশ’ টন ওজনের এতকিছু নিয়ে ভাসছে বিশাল বোয়িং!! বিজ্ঞান এবং আবিষ্কার নিয়ে আমার নানা ভাবনার মাঝে একেবারে আচমকা পাশে বসা মেয়েটি তীব্র স্বরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। দুইহাতে দুই কান চেপে ধরে মেয়েটি এমনভাবে চিৎকার করে কাঁদছে যে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি ভয় পেলাম, সাথে ভড়কেও গেলাম। আমি বসেছি উইন্ডো সিটে, মেয়েটি পাশের আইল সিটে। মেয়েটির কান্নার কারণ যে আমি না, সেটি কেউ বিশ্বাস করবে না। প্রথম দেখায় সবাই ভাববে যে, আমি এমন কিছু করেছি যাতে মেয়েটি কাঁদছে। আমি ভড়কে গিয়ে ‘কি হয়েছে কি হয়েছে!’ বলে লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে করুণ চোখে আমার দিকে তাকালো এবং চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। জীবনে হাজার হাজার মাইল বিমানে উড়েছি, চড়েছি নানা ধরনের বোয়িং, এয়ারবাস এবং হেলিকপ্টারে। কিন্তু কোনদিন এমন বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়নি। আমি দ্রুত মেয়েটির গা এড়িয়ে বের হয়ে মাঝের ওয়াকওয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইশারা করে ডাকলাম বিমানবালাকে। মেয়েটি কাঁদছিল সমানতালে।
তরুনীর নাম জানা হয়নি। এতক্ষণ কথা যা বলছিল সবই সেই বলছিল। আমি বেশি কিছু আগ্রহ দেখাইনি। এখন মনে হচ্ছে কোন ফাঁদে ফেলার জন্য সে এমন করছে নাতো। এয়ারহোস্টেজ তার কাছে এসে কান্নার কারণ কি জানতে চাইলে মেয়েটি বহু কষ্টে যেনো বলে, ‘কানে ব্যাথা। অসহ্য। সহ্য করতে পারছি না। আমাকে নামিয়ে দিন।’ আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিমান উপরের দিকে উঠার সময় কানে ব্যথা হয়। এই ব্যাথা তীব্রও হয়। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ব্যথা বেশি হতে দেখেছি। বিমানে বাচ্চাদের কান্নার রোল উঠতেও দেখেছি। কিন্তু কোনদিন কোন বড় মানুষের এমন তীব্র ব্যথা হতে দেখিনি। আমার হাফ ছেড়ে বাঁচার কারণ হলো যে, মেয়েটির ব্যথার কারণ যে আমি নই, সেটি অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেলো।
তরুণী তখনো কাঁদছে। দুই কান দুই হাতে চেপে ধরে আছে। পেছনের সিটের সাথে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগলো যে, আমি এবং এয়ারহোস্টেজ দুজনেই এক অস্বস্তিকর অবস্থার মাঝে পড়লাম। তরুণীকে উইন্ডো সিটে দিয়ে আমি তার সিটটিতে বসলাম। এয়ারহোস্টেজ চলে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে একটি পেইনকিলারের সাথে দুই কাপ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম।
তরুণী কাঁদছে। মুখ হা করে এমনভাবে কাঁদছে যে খুব মায়া লাগছিল। আহা, বেচারী! আমি তাকে নাক এবং মুখ বন্ধ করে প্রচুর চাপ দিয়ে শ্বাস ফেলতে বললাম। যাতে কানের ভিতর থেকে একটি চাপ তৈরি হয়। এতে তার ভালো লাগবে বলেও জানালাম। পেইন কিলার এবং কফি আসলো। বিমানও ততক্ষণে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে গেছে। তরুণীর ব্যথা কমে গেছে। এখন তাকে অনেকটা স্বাভাবিক লাগছিল। তরুণীর নাম সানজানা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্সে পড়ে। বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক আগে। স্বামী পিএইচডি করছেন হংকং–এ। স্বামীর কাছে যাওয়ার সময় কান ব্যাথার বিপত্তি! এটিই তার জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ বলেও লাজুকভাবে হাসলো সানজানা। যাওয়ার সময়ই সে ফিরতি পথেও এমন ব্যথা হবে কিনা তা জানতে চাইলো আমার কাছে। আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছিলাম যে, ফেরার সময়কার কানে ব্যাথার শংকায় সে শংকিত হয়ে উঠেছে।
দুই ঘন্টার কিছু বেশি সময়ের জার্নি। অনেকটা প্রতিবেশি দেশে যাওয়ার মতো। আমাদের বিমান নামতে শুরু করেছে। আমি বেশ তটস্থ হয়ে রইলাম যে, সানজানা আবারো কান্নাকাটি শুরু করবে। নামার সময়ও কানে লাগে। আমি তার সাথে নানা গল্প জুড়ে দিলাম। তার গল্প, বিয়ের গল্প, স্বামীর গল্প। তার স্বামী তাকে নেয়ার জন্য এয়ারপোর্টে আসবে বলে জানিয়ে সানজানা বললো, ‘ভাইয়া, আমাকে তার কাছে পৌঁছে দেয়ার পর আপনি যাবেন। নাহয় আমি হারিয়ে যাবো।’ আমি মাথা নাড়লাম। বললাম যে, ‘হারানোর সুযোগ নেই। ইচ্ছে করলেও আপনি হারাবেন না। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হয়ে একটি পথ দিয়েই সবাইকে বের হতে হয়। ওই মুখেই নিশ্চয় আপনার স্বামী অপেক্ষা করবেন। আপনি হারাবেন না।’
সানজানা আবারো কান চেপে ধরলো। তবে এবার আর আগের মতো চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিল না। দাঁত মুখ শক্ত করে দুই হাতে কান চেপে ধরে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছিল।
আমাদের বিমান ল্যান্ড করেছে। বিমানের ভিতরের ফোনগুলো বাজতে শুরু করেছে। মোবাইল আবিষ্কারের পর এটিও বিমানগুলোর নিত্য দৃশ্য। ল্যান্ডের পর বাজতে শুরু করে। বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয় স্বজন খবর নেয়ার জন্য যাত্রীদের অনেকের কাছেই ফোন করেন। আমার বা সানজানার কাছে কোন ফোন আসলো না। তার কাছে কোন ফোন আছে কিনা সেটাও আমি জানি না।
অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা বিমান থেকে নেমে আসলাম। চোখের সামনে হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কী অনন্য এক স্থাপনা। এটি ছোট্ট দেশ হংকং–এর জাতীয় বিমানবন্দর। চেক ল্যাপ কক নামের একটি দ্বীপে অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দরটিকে চেক ল্যাপ কক এয়ারপোর্টও বলা হয়। এই বিমানবন্দরটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। এতে করে মাত্র বিমানবন্দরটি এখনো অনেকটা নতুনের মতো রয়েছে। বিমান থেকে নামার পর পুরো অবকাঠামো যেনো চকচক করছিল। ইতোপূর্বে আমি জেনেছি যে, হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিমানবন্দর। পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠা হংকং এর এই বিমানবন্দর ক্যাথে প্যাসিফিক, ড্রাগন এয়ার, হংকং এয়ারলাইন্স, হংকং এক্সপ্রেস এয়ারওয়েজ এবং এয়ার হংকং হাব হিসেবে ব্যবহার করে। এই বিমানবন্দরটি বিশ্বের প্রায় দুইশ’ শহরের সাথে প্রতিদিন কয়েক হাজার ফ্লাইট অপারেট করে। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় শতাধিক এয়ারলাইন্স এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে। অর্থাৎ ব্যাংককের সুবর্ণভূমির মতো হংকং থেকেও পৃথিবীর দুয়ার খুলে যায় চারদিকে। বিমানবন্দরটিতে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করে। যাত্রী চলাচলের দিক থেকে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম বিমানবন্দর। তবে কার্গো হ্যান্ডলিং এর ক্ষেত্রে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর।
খেয়াল করে দেখলাম যে, সানজানা আমার পিছু ছাড়ছে না। বুঝতে পারছিলাম যে, তাকে স্বামীর হাতে পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত সে আমার পিছু ছাড়বে না। বিমান থেকে নামার পর দীর্ঘ পথ হাঁটতে হচ্ছিল। কখনো হাঁটা এবং কখনো মুভিং ওয়াকওয়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে সামনে এগুচ্ছিলাম। আমি যা যা করছিলাম ঠিক তাই করছিল সানজানা। একেবারে পায়ে পায়ে হাঁটা বলতে যা বুঝায় ঠিক সেভাবে। আমি এই ভেবে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, ভাগ্যিস পরিচিত কেউ নেই এখানে। হংকং এ তেমন বেশি বাঙালীও নেই। এখন যদি বাঙালী অধ্যুষিত কোন বিমানবন্দর হতো এবং দুচারজন পরিচিত মানুষ সামনে পড়তো তারা নিশ্চয় নিজেদের মতো করে একটি গল্প তৈরি করে ফেলতো। মোবাইলে ছবি বা ভিডিও করে কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলাও অসম্ভব ছিল না। পরনারী নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ!! আমি কিছুটা দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি গতি বাড়ালে সানজানাও বাড়ায়, একেবারে পায়ে পায়ে পাশে পাশে চলছিল সে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।