দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কফির মগ হাতে বসেছিলাম। বোর্ডিং গেটের সামনের সোফাগুলোতে আয়েশ করে স্টারবার্কসের কফি খাচ্ছিলাম। নেই কাজতো খৈ ভাজ টাইপে সময় পার করছিলাম। কিছুই যেখানে করার নেই, সেখানে যেনো মগজের অনেককিছু করার থাকে। নানা ভাবনায় পার করছিলাম সময়। প্রতীক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়, এখানেও তার ব্যতয় ঘটেনি। মনে হচ্ছে সেই কখন থেকে বসে আছি!

অসাধারণ এক আয়োজন চারদিকে। সোফাগুলো দারুণ, নরোম তুলতুলে। হেলান দেয়ার দারুণ আয়োজন। ব্যাংকক হলেও বিমানবন্দরের ভিতরের আবহ যেনো ইউরোপ ইউরোপ! কফির মগে হালকা চুমুক দিয়ে সময় পার করছিলাম। বেশ বয়সী এক ভদ্রলোক প্রায় সমবয়সী এক ভদ্রমহিলাকে সাথে নিয়ে টুকটুক করে বোর্ডিং গেটে এগিয়ে আসলেন। কিন্তু সোফা এবং চেয়ারের একটি সিটও খালি নেই। অনেকগুলো চেয়ার এবং সোফা থাকলেও সবগুলোতেই বসে আছেন নারী পুরুষ। শিশু কিশোরও রয়েছে। ভদ্রলোক এদিকওদিক তাকালেন। চোখে মুখে দারুণ হতাশা। একটি চেয়ারের অভাব যেনো বড় বেশি বাজছিল বুড়োর অন্তরে। তার চোখে মুখে এমন এক আকুতি দেখা গেলো যে, একটি খালি জায়গা পেলে অন্তত বিবিকে বসাতে পারতাম! বেচারা বুড়ির হাত ধরে আছেন। কি কি যেনো বলছিলেন। তাদের কথাবার্তার কিছুই না বুঝলেও শেষবয়সী এই দম্পতিকে দেখে কেমন যেন ভালো লেগে গেলো। এই বয়সেও এত প্রেম!! আমি হাত ইশারায় ভদ্রলোককে ডাকলাম। নিজে দাঁড়িয়ে সোফার আসনটি ওনাদের অফার করলাম। ভদ্রলোক কিছু না বলে স্ত্রীকে বসিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাশের সিটও খালি হয়ে গেলো। এতক্ষণ আমার পাশে বসে মোবাইল টিপছিলেন যে অপরিচিত যুবক তিনিও উঠে গেলেন। বুড়োবুড়ি পাশাপাশি বসলেন। তাদের গল্প নয়া মাত্রা পেলো!

আমি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমাদের বোর্ডিং শুরু হতে মনে হয় আরো কিছুক্ষণ লাগবে। তাই দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কফির মগে আধো আধো চুমুক দিয়ে ঘুরতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। চমৎকার সব আয়োজন চারদিকে। দোকানে দোকানে উৎসবমুখর মানুষের আনাগোনা, খাবারের দোকানগুলোর সামনেও ভীড় লেগে আছে। কাচের ভিতর দিয়ে বাইরের স্বচ্ছ নীল আকাশ, সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য এয়ারক্রাফটসবকিছুই কেমন যেন মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একই সাথে কতটি এয়ারক্রাফট ঠাঁই নিতে পারে কে জানে! তবে এখন অন্তত শ’খানেক এয়ারক্রাফট দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিমানবন্দরের এখানে ওখানে অনেকগুলো এয়ারবাস, বোয়িং। থাই এয়ারের পাশাপাশি আরো কয়েকটি এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটও লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটি বোর্ডিং ব্রিজে মুখ লাগিয়ে যাত্রী নিচ্ছে, কোনটিতে লাগেজ বোঝাই হচ্ছে, কোনটি বা বোর্ডিং ব্রিজে মুখ লাগানোর অপেক্ষা করছে আবার কোন কোনটি এমনি অলস দাঁড়িয়ে আছে! আমার মনে হলো, বিশ্বের বিমান চলাচলের অন্যতম হাব হয়ে উঠা সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এর থেকে কম এয়ারক্রাফট থাকলে বেমানান হতো!

আমাদের বোর্ডিং গেট খোলার ঘোষণা দেয়া হলো। আমি হেলেদুলে সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখন সোফার অনেকগুলো আসনই ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রায় সকলেই উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন। বোর্ডিং এর জন্য লাইন। আমি লাইনে না দাঁড়িয়ে আবারো সোফায় গিয়ে বসলাম। আমি জানি যে, সবার পরে বিমানে চড়লেও আমার সমস্যা হবে না। আমার বোর্ডিং কার্ড ঢাকা থেকে ইস্যু করা। বিমানের সিট নম্বরও আমাকে ঢাকা থেকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার হাতে কোন কেবিনব্যাগও নেই। সুতরাং আমাকে শুধু হাতপা সাথে নিয়ে নিজে বিমানে চড়লেই হবে। নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসা ছাড়া আমার আর কোন কিছুই করার নেই। আমার সিটের উপরে কেবিনে জায়গা থাকছে কি থাকছে না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকারই এই যাত্রাই আমার নেই। অতএব স্টারবার্কস খেতে থাকো। সময় হলে মগটি বিনে ফেলে দিয়ে বিমানে চড়ে বসো!

আরো কিছুক্ষণ পর জটলা ফাঁকা হয়ে গেলে আমি বোর্ডিং গেটের তরুণীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। থাই এয়ারের চ্যাপ্টা নাকের তরুণী আমার বোর্ডিং কার্ডটি স্ক্যানিং করে নির্দিষ্ট অংশ ছিঁড়ে রেখে বাকিটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। আমি আমার লাগেজগুলোর কি অবস্থা একটু দেখে দেয়ার অনুরোধ করলাম। তিনি আবারো কার্ডটি স্ক্যানিং করলেন। সামনে থাকা ট্যাবে কি কি সব টাইপ করলেন। বললেন, আপনার দুইটি লাগেজ ঠিকঠাকভাবে লোড করা হয়েছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আগেও বলেছি যে, ট্রানজিট রুটের যাত্রী হিসেবে আমার লাগেজ হারানোর ঘটনা অনেক। যেখানে এক বিমানে অর্ধেক পথ এসে অন্য কোন এয়ারপোর্ট থেকে বাকি অর্ধেক পথ অন্য বিমানে চড়া হয় সেখানে লাগেজ নিয়ে গোলমালের আশংকা থাকে। যেমনটি থাইল্যান্ড থেকে আমি মালয়েশিয়া গেলেও লাগেজ চলে গিয়েছিল সিংগাপুরে। সৌদি আরব থেকে কাতার হয়ে আসার সময় লাগেজ যে কোথায় গেছে তার হদিশই শেষতক আর মিলেনি। আবার আমাদের সাথে ট্যুর করার সময় বন্দর পতেঙ্গা আসনের এমপি লতিফ সাহেব পৌঁছেছিলেন প্যারিসে, কিন্তু উনার লাগেজ চলে গিয়েছিল জার্মানি। এই ধরনের ঘটনা প্রাত্যহিক না হলেও টুকটাক ঘটে। আর যার বেলায় ঘটে কেবল তিনিই টের পান যে যন্ত্রণা কাকে বলে! ‘কত ধানে কত চালে’র হিসেব কমবেশি সবাই জানেন, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণে বিমান জার্ণির যন্ত্রণা যে কত রকমের হতে পারে তা শুধু যার উপর দিয়ে যায় তিনিই জানেন!

নিজের দুইটি পুটলি ঠিকঠাকভাবে বিমানে আছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে গিয়ে বিমানের দরোজায় পৌঁছলাম। সেখানেও দাঁড়িয়ে আছেন দুই থাই সুন্দরী। তারা যাত্রীদের আসন দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি শুধু ‘হাই’ বলে সামনে এগুলাম। ভাবখানা এমন করলাম যে, আরে আমি তো প্রতিদিনই তোমাদের বিমানে চড়ি। ওই যে আমার আসন, সেটা আমি নিজেই চিনি।

ঢাকার ভদ্রমহিলাকে সামনে ফেলে বকা দিতাম নিশ্চয়। অন্তত চোখ গরম করে হলেও তাকাতাম। উইন্ডো সিট দিতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু একেবারে সবার পেছনে কোনার ভিতরে এনে আমাকে উইন্ডো দিতে হবে? আরো বিব্রতকর হচ্ছে আমার পাশের আইল সিটে একজন তরুণী। প্রথম দেখায় কোথাকার তরুণী বুঝতে পারলাম না, ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা বর্ণের মেয়েটির পরনে থ্রি পিস। বাঙালী না হলে ভারতীয় হবে। ‘এক্সিকিউজ মি’ বলে জায়গা চেয়ে নিয়ে আমি ভিতরের সাইডে গিয়ে জানালায় চোখ দিয়ে বসলাম। পাশে মেয়েটি বসে আছে।

ব্যাংকক থেকে হংকং এর দুরত্ব ১৬শ’ কিলোমিটারের বেশি। দুই থেকে সোয়া দুই ঘন্টার ফ্লাইটাইম। থাই এয়ারের অপেক্ষাকৃত ছোট এয়ারক্রাফটই দেয়া হয়েছে। এই ধরনের একটি এয়ারবাসে সর্বোচ্চ একশ’ সত্তর জনের মতো যাত্রী পরিবহন করতে পারে। কোন কোন এয়ারলাইন্স ভাড়া কমানোর জন্য আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়ে থাকে। থাই এয়ারের এই ফ্লাইটটিতে এক পাশে দুইটি, মাঝে তিনটি এবং অপরপাশে দুইটি সিট দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি রো তে ৭টি সিট। আমি ওই তরুণীকে নিয়ে একেবারে পেছনের দুইটি সিটে বসেছি। আমি উইন্ডোতে, তরুণী আইল সিটে।

বিমান চলতে শুরু করেছে। বাসের মতো সামনে এগুচ্ছে। আমরা পাশাপাশি বসে থাকলেও কেউ কাউকে চিনি না, পরিচয়পর্বও সাঙ্গ হয়নি। পরিচয় করার কোন গরজ মেয়েটির মাঝে নেই। আমিওবা গায়ে পড়ে কথা বলতে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কি না কি মনে করে! হোয়াটসঅ্যাপের একটি কল রিসিভ করে কথা বলছিলাম। ব্যাংকক থেকে হংকং এর পথ ধরেছি, বিমান এই ছাড়লো বলেজাতীয় কথাবার্তা বলে ফোনটি রাখতেই পাশের তরুণী উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো। বললো, আরে আপনি বাঙালি!! আমি মনে করেছিলাম। তরুণী কথা শেষ করার আগেই আমি বললাম, ‘জাপানি!’ তরুণী হাসলো। শ্যামলা মেয়েটির হাসির ঝিলিক টের পেলাম। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, বেশ ভালোই হলো। আমি একা যাচ্ছি। কাউকে চিনি না, পুরো বিমানে আর একজন বাঙালীও নেই। কী যে ভয় লাগছিল! এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি!! তরুণী এমন কলকল করে কথা বলতে শুরু করলো যে, মনে হলো সে যেনো আমার পাশের বাড়ির তরুণী। বহুবছর ধরেই আমরা পরস্পরকে চিনি, জানি। (চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌতুক
পরবর্তী নিবন্ধআলোকে আলোকময় শাহানশাহ্‌