দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হাতে অফুরন্ত সময়। এত দীর্ঘ সময় যে কী করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সময় অফুরন্ত হলেও কফিতো আর অফুরন্ত নয়। তাই হাতের মগটি ফেলে দিতে হলো। ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হেথায় হোথায় বসে থাকার জায়গার অভাব নেই, অভাব নেই কেনাকাটা করার মতো দোকানপাটেরও। কিন্তু আমার তো কেনাকাটার কিছু নেই। তাই হেলেদুলে হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। মানিব্যাগের পাশাপাশি পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং কার্ড সতর্কতার সাথে পকেটে পুরে মানুষের ফাঁকে ফাঁকে পথ চলছিলাম। যেনো গিজগিজ করছে মানুষ! আহা, কত ধরণের মানুষ, কত রঙের!! সাদাকালোবাদামী, ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি, কিশোরকিশোরী। মা বাবার হাত ধরে কিংবা একা ছোটাছুটি করছে এমন শিশুর সংখ্যাও কম নয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা জাতের নানা গোষ্টির সব মানুষ যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ব্যাংককে। আরব দুনিয়ার অগুনতি মানুষ দেখা গেলো। বেশভুষায় চেনা সহজ হওয়ায় বুঝতে পারছিলাম যে, এরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে এসেছেন। এদের অনেকেই পরিবার পরিজনসহ বেড়াতে এসেছেন, কেউ কেউ উড়ে এসেছেন একা। ব্যাংককে আরবের ধনকুবেরদের আনাগোনা বেশ চোখে পড়ে। ব্যাংকক শহরে আরব্য স্টাইলের বড়সড় মার্কেট রয়েছে। ওই মার্কেটের এক একটি দোকানের পণ্যের পসরা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আরবের লোকজনে নিত্যব্যবহার্য নানা জিনিস শোভা পায় এসব দোকানে। দোকানগুলোর মেঝে পুরু কার্পেটে মোড়ানো। সিসা, তামাক, গাওয়া (এরাবিয়ান কফি) এবং খেঁজুর দিয়ে আরবের শেখদের বরণ করা হয়। কোলবালিশে হেলান দেয়া শেখদের চোখে মুখে খেলা করে সুখ সুখ অনুভূতি। শুধু দোকান কিংবা শোরুমের জৌলুশই নয়, আরব্য শেখদের নিয়ে নানা রোমাঞ্চকর কাহিনীও থাইল্যান্ডের ইথারে ভাসে। শুধু ব্যাংককই নয়, ফুকেট, পাতায়া, ক্রাভি কিংবা ফি ফি আইল্যান্ডসহ থাইল্যান্ডের হরেক জায়গায় এসব শেখদের যে অগ্রযাত্রা তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। থাইল্যান্ডে আরো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকলেও অধিকাংশ পর্যটকই প্রবেশ করে এই সুবর্ণভূমি দিয়ে। এতে করে ব্যাংককের অলিগলি কিংবা চোরাগলিতে যত পর্যটক দেখা যায় তার অধিকাংশেরই এখানে সাক্ষাৎ মিলে!

পর্যটনের তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠা থাইল্যান্ডের উত্থান আরো অনেকের মতো আমাকেও চমকিত করে। মাত্র বছর কয়েক আগেও থাইল্যান্ডের আয় রোজগারের সিংগভাগ ছিল পতিতালয় এবং চোরাই মাছ থেকে। বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানায় ঢুকে তারা রাতে দিনে মাছ চুরি করতো। সেই থাইল্যান্ড মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে শুধুমাত্র পর্যটনের উপর ভর করে কৃষি, শিল্পায়ন এবং ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে যে চোখধাঁধানো উন্নয়ন করেছে তা খোলা চোখে দেখা যায়। থাইল্যান্ডের রাস্তা ঘাট, ফ্লাইওভার এবং এক্সপ্রেসওয়ের উপর দিয়ে চলার সময় মুখ হা হয়ে যায়। এই যে বিমানবন্দরে ঘুরছি, এমন একটি আলীশান অবকাঠামোতো থাইল্যান্ডের হওয়ার কথা ছিল না। অথচ হয়েছে, তারা পেরেছে। বাংলাদেশের প্রায় চারগুন বড় থাইল্যান্ডের লোকসংখ্যা আমাদের অর্ধেকেরও কম, ৭ কোটির ধারেকাছে। অথচ তারা নানা পণ্যের সাথে আমাদের কাছে চালও বিক্রি করে!

নানাকিছু ভাবতে ভাবতে সময় পার করছিলাম। লাঞ্চ টাইম পার হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধাও লেগেছে। বিমানবন্দরের ভিতর খাওয়া দাওয়ার কোন অভাব হয়না, তবে একেবারে ধারালো ছুরি দিয়ে গলা কাটে। এতো বেশি দাম নেয় যে, মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে বাইরে গেলে এই দাম ক্ষেত্রবিশেষে এক তৃতীয়াংশে নেমে আসে। কিন্তু সেই বাইরে যাওয়ার সুযোগটিই আমার নেই। থাইল্যান্ডের ভিসা না থাকায় আমি বাইরে যেতে পারবো না। যা করতে হবে এই বিমানবন্দরের ভিতরেই করতে হবে। আবার পুরো বিমানবন্দরেও আমি ঘুরতে পারবো না। শুধুমাত্র ‘ডিপারচার এরিয়া’তেই আমাকে থাকতে হবে। এখানে যত ইচ্ছে ঘুরঘুর করলেও কোন সমস্যা হবে না, কেউ হয়তো জানতেও চাইবে না যে, কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছি।

বিশ্বের অনেক উন্নত বিমানবন্দরের মতো সুবর্ণভূমিতেও পাঁচতারকা মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে, রয়েছে ভালো মানের রেস্টুরেন্ট। আবার বিভিন্ন লাউঞ্জও রয়েছে। এত দীর্ঘসময় ঘুরঘুর করে আমি মাত্র ঘন্টা দুয়েক সময় পার করেছি। আরো দুইঘন্টা সময় আমাকে ঘুরতে হবে। সময়টা আরো দুচারঘন্টা বেশি হলে ঘুম দেয়া যেতো। এখন পরিস্থিতি এমন যে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ অর্থাৎ ঘরেও নয় ঘাটেও নয়। মাঝখানে ঝুলে থাকা এই আমার হাতে দুই ঘন্টা সময় থাকলেও তা আয়েশী কোন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফ্লাইট ছাড়ার কিছু আগে আমাকে নির্দিষ্ট গেটে পৌঁছতে হবে। অর্থাৎ সব মিলে ঘন্টা দেড়েক সময় হাতে আছে। এই দেড় ঘন্টার জন্য হোটেল নেয়ার কোন মানে হয় না। আবার দেড়ঘন্টায় ঘুমও ঠিক জমে উঠবে না। তার থেকে লাঞ্চ করে নিলে মনে হয় ভালো হবে। ক্ষুধা বেশ জানান দিচ্ছে। হংকং এর ফ্লাইটে কতক্ষণে খাবার দেবে কিংবা আদৌ দেবে কিনা কে জানে!

পৃথিবীর বহু এয়ারলাইন্সই তাদের বহু রুটে এক ফোটা পানিও দেয়না। কিনে খেতে হয়। বাজেট এয়ার খ্যাত ওসব ফ্লাইটে কেবিনক্রুরা রীতিমতো দোকানদারি শুরু করে। এদের কেউ কেউ খুচরা কড়ি নিয়েও মাতামাতি করে। আবার কেউ কেউ নগদ টাকায় কোনকিছুই বিক্রি করেনা, সবই করে ব্যাংক কার্ডে। থাইল্যান্ডের এয়ার এশিয়া এবং আমেরিকায় আটলান্টিক এয়ারলাইন্সের এমন দুইটি ফ্লাইটে চড়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককহংকং ফ্লাইট কী ধরনের আচরণ করে কে জানে!

রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। বেশ শানদার। আসলে একটি বিমানবন্দর হচ্ছে ওই দেশের আয়না। যেদেশের বিমানবন্দর যত সুন্দর সেই দেশটি সম্পর্কে পর্যটকদের ধারণা ততই ভালো হয়। থাইল্যান্ডের আনাচে কানাচে হয়তো বহু ময়লা আবর্জনা বা খারাপ জিনিসপত্র রয়েছে। তবে এই বিমানবন্দর দেখে দেশটি সম্পর্কে খারাপ ধারণা করার কোন সুযোগই থাকবে না। চারদিক যেনো চকচক করছে। থাই তরুণী ম্যানু এগিয়ে দিলেন। মুখে হাসি ঝুলিয়ে অর্ডার নেয়ার জন্য তিনি তৈরি। কিন্তু ম্যানুতে আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে একটি খাবারও চিনতে পারলাম না। কী সব নাম লিখে রেখেছে! তরুণীকে বুঝালাম যে, আমি কোন মাংস খাবো না। সী ফুডের মধ্যে অক্টোপাস, স্কুইড, ব্যাঙ এবং শামুকঝিনুক খাবো না। শামুকঝিনুকের ইংরেজী ভুলে যাওয়ায় কিছুটা বেকায়দায় পড়লাম। তবে অল্পক্ষণের মধ্যে গুগলের সহায়তায় সংকট সুরাহা করে মেয়েটিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। শুধুমাত্র ভেজিটেবল জাতীয় খাবার দিয়েই লাঞ্চ সারতে চাই বলে তরুণীর চোখে চোখ রাখলাম। একবাটি ক্লিয়ার ভেজিটেবল স্যুুপেরও অর্ডার করলাম। মুখে হাসি ঝুলিয়ে তরুণী মাথা নাড়লেন। বললেন, আমাদের হালাল ফুড আছে। আপনি চাইলে মাংসও নিতে পারেন। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হরদম আরব্য শেখের আনাগোনা চলে। এই বিমানবন্দরে নামাজের জন্য এবাদতখানাও রয়েছে। আমি হাসলাম। তাকে বুঝালাম যে, মাংস আমি পছন্দ করিনা। আপনি ভেজিটেবলই দিন। তিনি সবজি, ডাল এবং ভাতের দারুণ একটি প্লেটার সাজিয়ে দিলেন। সাথে ক্লিয়ার স্যুপ। ভিনদেশে এর থেকে বেশি খাবারের কোন দরকার আছে বলে আমার মনে হলো না।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পর স্টারবাকসের দিকে চোখ পড়তে পরানটা আনচান করে উঠলো। দুনিয়ার সেরা কফির একটি স্টারবাকস। এমন পোড়া শহরে বসবাস করি যে যেখানে দুনিয়ার সেরা কফিগুলো নেই বললেই চলে। ঢাকায় গ্লোরিয়া জিন্স থাকলেও স্টারবাকস আছে বলে শুনিনি। চট্টগ্রামে তো এসবের প্রশ্নই উঠে না। তাই বিদেশে সুযোগ পেলে আমি দুনিয়ার সেরা কফিগুলোতে চুমুক দেয়ার চেষ্টা করি। ভ্রমণসঙ্গিরা বিরক্ত হন, কখনো কখনো অসন্তুষ্টও। কিন্তু দিনে আট দশ মগ কফি না হলে আমার সন্তুষ্টি আসে না।

স্টারবাকসে তিন সাইজের মগে কফি বিক্রি করে। ছোট, মাঝারী এবং বড়। আমি বড় সাইজের মগ নিলাম। বেশ দাম, বাংলা টাকার সাথে বিনিময় করলে একেবারে বুকের গভীরে গিয়ে লাগে। কিন্তু উপায় নেই। স্টারবাকস দেখবো, অথচ নেবো না তা কী হয়! বড় মগ নেয়ার সুবিধা হলো অনেকক্ষণ ধরে রয়ে সয়ে খাওয়া যায়। আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় হাতে আছে। আমি গেটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। গেটে পৌঁছে একটি চেয়ারের জন্য চোখ বুলালাম। আমার আগে অনেকেই পৌঁছে গেছেন। এদের কেউ কেউ ট্রানজিটের যাত্রী, আবার কেউবা ব্যাংকক থেকে হংকং যাচ্ছেন। এখানেও দুনিয়ার নানা দেশের নানা জাতের মানুষ। সবাই ফ্লাইটের অপেক্ষা করছেন। এখনো বোর্ডিং শুরু হয়নি। সবাই দুয়ার খোলার অপেক্ষা করছেন। পর্যটনের রাজধানী থাইল্যান্ড থেকে বাণিজ্যের রাজধানী হংকং ছুটছেন মানুষ। এই ছোটার যে শেষ কোথায় কে জানে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকল্প পরিকল্পনায় গলদের দায়ভার কার