দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ কাহিল লাগছিল। এত কাহিল যে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল ঘুমে। এতো ঘুম কেন আসছে বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার মনে হলো, প্রথমত সাতসকালে ঘুম থেকে জেগেছি। যতটুকু ঘুম আমার দরকার ততটুকু হয়নি। ট্রেনে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তা যথেষ্ট হয়নি। ট্রেনের সিটে হেলান দেয়ার সুযোগ ছিল না, তাই জমিয়ে ঘুমানোর মওকা পাওয়া যায়নি। গাড়ির সিটে ইচ্ছেমতো হেলান দেয়া যাচ্ছে। জুবায়ের সামনে বসায় পেছনের ৩ সিটই আমার দখলে। তাই স্বাভাবিকভাবে যতটুকু হেলান দেয়া যায় তার থেকে বেশিই দিয়েছি, যতটুকু সম্ভব হেলিয়ে পড়ে আয়েশ খুঁজছি। এছাড়া রেলওয়ে স্টেশনে হালকার উপর দিয়ে দারুণ কিছু খাবার দাবারও হয়েছে। এতে করে শরীর আরো আয়েশ খুঁজছে, ঘুমাতে চাচ্ছে!! এমনিতে নিদ্রাদেবীর দেখা না মিললেও এখন বেশ সোহাগ দেখাচ্ছে। নিজেকে নিজে ধমকালাম, কিছুটা ধমক দিলাম তন্দ্রাদেবীকেও। এতো আয়েশের কি আছে? চোখ ভরে সবকিছু দেখে নাও। এই দেখা তো শেষ দেখাও হতে পারে। জীবনে আর গুয়াংজু নাও আসতে পারি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের পূর্বমুখী যোগাযোগ বাড়লেও চীনে আমার তেমন কোন কাজ কারবার নেই। এখানে আর দ্বিতীয়দফায় আসারও কোন সম্ভাবনা নেই। তাই যতটুকু পারি চোখ জুড়িয়ে দেখে গেলেই ভালো।

সিটে হেলান না দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। হেলান দেয়ার সাথে সাথে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। জুবায়েরের কাছ থেকে পানির বোতল চেয়ে নিয়ে কয়েক ঢোক গলায় ঢাললাম। মনে মনে হাসলাম। এই যে আমি শেষ দেখা বলছি, সেটাও তো না হতে পারে। মানুষ ভাবে এক, বিধাতা অংক কষেন অন্যভাবে। মানুষ একদিকে যোগ বিয়োগ করে, অন্যদিকে বিধাতা হাসেন। কোথায় যে কাকে কিভাবে কখন নিয়ে যাবেন তা একমাত্র উনিই জানেন। উনার ছকের বাইরে গিয়ে কিছু হওয়ার জো নেই, সুযোগও নেই। মনে পড়লো স্বপ্নের শহর প্যারিসের কথা। প্যারিস ভ্রমণের স্বপ্ন আমার বহু বহু বছরের। অনেকটা স্কুল কলেজের সময়কালের বললেও ভুল হবে না। তবে এই স্বপ্নও যে কোনদিন সফল হবে তাও যেনো অনেকটা নির্ধারিত ছিল। আমার মতো চুনোপুটি একজন মানুষ আয়েশ করে প্যারিস ভ্রমন করবো, আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় বসে প্যারিস দেখার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতাম না। মনে পড়লে হাসতাম।

অথচ সেই আমি কেমন করে যেনো প্যারিস ভ্রমণে চলে গেলাম। জীবনে প্রথম যেবার প্যারিস গিয়েছিলাম সেবার আমার মনে হয়েছিল এই তো শেষ। আর কী এই সুন্দর শহর দেখা হবে!! অথচ কী আশ্চর্য, পরবর্তীতে আরো দুই দফায় আমি প্যারিসের অলি গলি রাজপথ থেকে শুরু করে আইফেল টাওয়ারের চূড়া পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছিলাম! তিন তিনবার প্যারিস ভ্রমণ করার পর আমার মনে হয়েছিল, আসলে আমাদের হাতে কিছুই নেই। যা আছে তার সবই উপরে। উনি যখন যা করাতে চান, আমরা কেবল তাই করি! অবিশ্বাসীদের অন্য যুক্তি থাকতে পারে, তারা হয়তো অন্যভাবে বলবেন। কিন্তু আমার কাছে এসবের কোন যুক্তি নেই, শুধু বিশ্বাস করি, এই যে একটির পর একটি দেশ আমি চষে বেড়াচ্ছি তার কোনটিতেই আমার কোন হাত নেই, শক্তি নেই। সবই ওই এক জায়গা থেকেই নিয়ন্ত্রিত!!

গুয়াংজু শহরের বর্ণনা আগেই দিয়েছি। এটি দারুণ একটি শহর। চীনের অতি বিখ্যাত শহর। বাণিজ্যিক শহর। চীনের তৃতীয় বৃহত্তম, জনবহুল এবং ব্যস্ততম শহর। বেইজিং এবং সাংহাইর পর বেশ গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয় গুয়াংজুর নাম। চীনের এখানে ওখানে গড়ে উঠা বিশ্বখ্যাত অনেকগুলো বন্দরের মাঝে গুয়াংজুও একটি। বিশ্বের ব্যস্ততম একশ’ বন্দরের তালিকায় গুয়াংজুর নাম বেশ উপরের দিকে, ৬ নম্বরে। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান সেখানে অনেক তলানিতে।

গুয়াংজু শহরের বিস্তারিত আগেই লিখেছি। এই শহরের হেথায় হোথায় অনেক ঘুরেছি। তবে এখন যে রাস্তাটি দিয়ে যাচ্ছি সেটি মনে হয় আগে আসিনি। যাওয়ার সময় কি এই রাস্তা দিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে এসেছিলাম! জুবায়েরও ঠিক বুঝতে পারছে না। গুয়াংজু বিশাল শহর, রাস্তার অভাব নেই, অভাব নেই গাড়ির। দেড়শ’ কোটি মানুষের দেশটিতে মানুষের তো অভাবই নেই। সর্বত্রই গিজগিজ। চীনের তৃতীয় বৃহত্তম শহরটিতে প্রতিদিনই হুমড়ি খেয়ে পড়েন হাজার হাজার পর্যটক। বাণিজ্যের স্বর্গভূমিখ্যাত গুয়াংজুতে বাজার সদাই করারও নাকি ভীষণ সুবিধা। আমি কোন শপিং করবো কিনা জানতে চাইলো জুবায়ের। বললো, আপনি তো এখান থেকে সরাসরি বাড়ি চলে যাবেন। ঘরের জন্য বাজার সদাই কিছু করবে না। অনেক ভালো ভালো জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। দামও তুলনামুলকভাবে কম। আপনি অনেককিছুই এখান থেকে নিতে পারেন, গৃহস্থালী জিনিসপত্রের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক্স নানা পণ্য সামগ্রির বিশাল সম্ভার রয়েছে শপিং মলে। মোবাইল কিংবা অন্য ডিভাইজও কিনে নিতে পারেন। দেশের তুলনায় বহু সস্তা। জুবায়ের আমাকে আরো কি কি সব বলে শপিং করলে এখন সামনে একটি বড় মার্কেটে নেমে গেলে ভালো হবে বলেও মন্তব্য করলো। আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, শপিং করার কিছু নেই। সবই বাংলাদেশে আছে। এখান থেকে বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয়না। জুবায়ের বললো, তবুও একবার ঘুরে দেখিয়েন। ভালো লাগবে। ভাবী শুনলে হয়তো নিতে বলবে। কত সুন্দর সুন্দর এবং কত ধরণের জিনিসপত্র যে এখানে রয়েছে!! দোকানে ঢুকলে মনে হবে সবই আপনার প্রয়োজনীয়। দারুণ সব জিনিস!! আমি হাসলাম, চীনা মাল আর কতটুকু দারুণ হবে! জুবায়েরের যেনো আঁতে লাগলো! বললো, কি যে বলেন ভাইয়া! চীনা মাল বলে নাট সিটকানোর দিন আর নেই। এক একটি পণ্য হাতে নিলেই বুঝতে পারবেন তারা কোথায় পৌঁছেছে। তারা কি পরিমান যত্নে যে কত উন্নত মানের পণ্য তৈরি করে তা চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করবেন না। তাদের অভ্যন্তরীন বাজারে ব্যবহার্য পণ্য ইউরোপীয়ান স্টান্ডার্ড। এখন আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এসে এখানে দর কমাতে বলে, মান কমাতে বলে। নানাভাবে কম্প্রোমাইজ করতে বলে। তারাও বানিয়ে দেয়। বাংলাদেশের জন্য যেসব পণ্য তৈরি করা হয় সেগুলো এখানে কোন শপিং মল তো দূরের কথা, ফুটপাতেও পাবেন না। চীনের অভ্যন্তরীন বাজারের পণ্যের মান অনেক উন্নত বলেও জুবায়ের মন্তব্য করলো।

টেঙি চলছিল। আমরা গল্প করছিলাম। রাস্তার দুই ধারে সব সুউচ্চ ভবন। অনেকগুলো ভবন বেশ পুরানো, অনেকগুলো একেবারে নতুন। আবার নির্মাণাধীন ভবনও দেখা গেলো। ভবনের ছাদে ছাদে ক্রেনের ব্যাপক উপস্থিতিই বলে দিচ্ছিল যে, সুউচ্চ ভবনগুলো আরো উঁচু হবে, আরো সমৃদ্ধ হবে। নির্মাণাধীন কয়েকটি ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে দোকান, শপিং মল দেখা গেলো। ভবনের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভবনগুলোর গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ কয়েক তলা চালু হয়ে গেছে। শুধু শপিং মলই নয়, জুবায়ের বললো যে, ভবনগুলোতে দুনিয়ার অফিস। বহুদেশের ব্যবসায়ীরা এখানে অফিস করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। চীনের সাথে চরম বিরোধ হংকং এবং তাইওয়ানের। এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই হংকং এবং তাইওয়ানের দিকে তাক করা। অথচ এই দুইটি দেশেরই বহু ব্যবসায়ী গুয়াংজুতে অফিস স্থাপন করে জমিয়ে ব্যবসা করেন। তাইওয়ান এবং হংকং এর বহু ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করেন, কিন্তু পণ্য ডেলিভারি দেন এই চীনের গুয়াংজু থেকে।

জুবায়ের দেশ থেকে এসেছে বেশ কয়েক মাস আগে। আমার বন্ধুর অফিসেই গুয়াংজু অফিসের কর্মকর্তা হিসেবে নানা কাজ করে সে। এতে করে গুয়াংজুর সার্বিক অবস্থা এবং চীনের ব্যবসা বাণিজ্যের বহু খবরাখবর সম্পর্কেও তার জ্ঞান বেশ টনটনে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনেকটা বিজ্ঞের মতো জুবায়ের বললো, চীন যে কোথায় যাচ্ছে তা হয়তো এখনো বুঝা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর কয়েকের মধ্যেই চীন বিশ্বের একনম্বর সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে। জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, এই হাসি অবিশ্বাসের নয়, আস্থার। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবা
পরবর্তী নিবন্ধঅনুভূতিহীন ১৫ই আগস্ট